ফিচার আর্টিকেল

ভারতের নেপোলিয়ন। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত শাসক সমুদ্রগুপ্ত

প্রাচীন ভারতে কুষান সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়। অনেক ছোট ছোট রাজ্য তৈরি হয়। পশ্চিম পাঞ্জাবে কুষান এবং গুজরাটে শকদের রাজত্ব থাকলেও গোটা ভারতকে একসূত্রে বাঁধার মতো কোন শক্তিশালী সাম্রাজ্য তৈরি হচ্ছিলনা। ঠিক এইরকম সময়েই ধ্বংসাবশেষের উপর একটি নতুন সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে যার নাম গুপ্ত সাম্রাজ্য। উত্তর ভারতের মগধে তৈরি হওয়া এই সাম্রাজ্য উত্তর ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যকে কয়েকশো বছরেরও বেশী অক্ষুন্ন রেখেছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কে ভারতের স্বর্নযুগ বলা হয়। এই গুপ্ত সাম্রাজ্যে এমন এক রাজা ছিল যাকে ভারতের নেপোলিয়ন বলা হত, ঐতিহাসিক ভিনসেণ্ট স্মিথ এই কথা বলেছিলেন।

বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তার জীবনের শেষ যুদ্ধ ব্যাটেল অফ ওয়াটারলুতে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু সমুদ্রগুপ্ত তাঁর জীবনকালে কোন যুদ্ধে পরাজিত হয়নি। সমুদ্রগুপ্ত তাঁর জীবনকালে একশোটির বেশী যুদ্ধ করেছিল এবং প্রত্যেকটিতে বিজয়ী হয়েছিলেন। সমুদ্রগুপ্ত সম্পর্কে বলা হয় তিনি রাজাদেরও রাজা ছিলেন। প্রাচীন ভারতের এই বিখ্যাত শাসক সমুদ্রগুপ্ত সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

৩৩৫-৩৮০ খ্রিস্টাব্দে (এডি) উত্তর ভারতে শাসন করতেন সমুদ্রগুপ্ত। গুপ্ত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শাসক ছিলেন তিনি। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রথম শাসক প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পুত্র ছিলেন তিনি। তবে গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রথম দুই শাসক ছিল শ্রীগুপ্ত ও ঘটোতকচ, তবে এরা রাজা ছিল কিন্তু প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত ছিল মহারাজাধিরাজ। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কে ভারতের ইতিহাসে স্বর্নযুগ বলা হয় কারন এই সময়ে ভারতে কলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, স্থাপত্য শিল্পে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল। আক্ষরিক ভাবে স্বর্নযুগের সূচনা হয়েছিল সমুদ্রগুপ্তের সময় থেকেই। সমুদ্রগুপ্তকে কবিরাজ বলা হত কারন সাহিত্য চর্চায় তিনি সুনিপুন ছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেনের লেখা এলাবাদ প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের ব্যাপরে বিস্তারিত জানা যায়। তাঁর সময়ে বিভিন্ন স্বর্নমুদ্রায় সমুদ্রগুপ্তের বীনবাদনরত ছবি দেখতে পাওয়া যায়, যা দেখে ধারনা করা হয় তিনি সংগীত প্রেমীও ছিলেন। 

জাভার ইতিহাসে সমুদ্রগুপ্তকে তান্ত্রিকামানডাকা বলা হয়েছে। সমুদ্রগুপ্তের মায়ের নাম ছিল কুমারদেবী। লিচ্ছবি বংশের রাজকন্যা কুমারদেবীকে বিবাহের পরই প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তবে বলা হয় সমুদ্রগুপ্ত প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবীর প্রথম পুত্র ছিলনা, কিন্তু তাঁর যোগ্যতার জন্য তাঁকেই রাজা করা হয়। কিছু কিছু ঐতিহাসিকরা বলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্তের বড় ছেলে ছিল কচ্ছ গুপ্ত, তাঁকে সরিয়ে রাজা হয় সমুদ্রগুপ্ত তবে আবার অনেকের ধারনা কচ্ছগুপ্তই সমুদ্রগুপ্ত উপাধি নিয়েছিল যার অর্থ সমুদ্র দ্বারা সুরক্ষিত। ভারতের রাজবংশের নিয়ম অনুযায়ী রাজার প্রথম পুত্রই রাজা হয়, কিন্তু সমুদ্রগুপ্তকে রাজা করবার জন্য প্রথম চন্দ্রগুপ্ত তার বাকী ছেলেদের প্রথম থেকেই রাজ্যপাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। ভারতের বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কৌটিল্য বা চানক্য বলেছিলেন শক্তিমান ব্যাক্তি যুদ্ধ করবে এবং শত্রুকে ধ্বংস করবে। তাই সমুদ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেই দ্বিগবিজয় শুরু করে।

পশ্চিমে রবি নদীর তীর থেকে পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীর পর্যন্ত এবং উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিনে চেন্নাই উপকূল পর্যন্ত সমুদ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য বিস্তার ছিল। এমনকী সিংহলের রাজাকেও পরাস্ত করেছিলেন তিনি। গোটা ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত ছিল গুপ্ত সাম্রাজ্য। সমুদ্র গুপ্ত যুদ্ধে জেতার পর সেই রাজ্যকে আংশিক স্বাধীনতা দিয়ে নিজের অধীনে করে নিত। সমুদ্রগুপ্তের অপ্রতিরথ, সর্বরাজোচ্ছেত্তা, মহারাজাধিরাজ, বিক্রমাংক, মহাপরাক্রমাঙ্ক ও কবিরাজের মতোন উপাধি ছিল।

সমুদ্রগুপ্ত ভারতীয় বৈদিক মত অনুযায়ী অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিল। এই যজ্ঞে একটি ঘোড়ার গায়ে রাজার পতাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং সাথে কিছু সেনাও যায়। যদি কেউ সেই ঘোড়াকে আটকে ফেলে তাহলে তাঁকে সেই রাজার সাথে যুদ্ধ করতে হত। ঘোড়া চারদিক ঘুরে ফিরে আসার পর তার মাংস দিয়ে যজ্ঞ করা হত। সমুদ্রগুপ্তের ঘোড়াকে আটকাবার সাহস হয়নি কারও।  এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে আরও জানা যায় প্রথম চন্দ্রগুপ্ত সমুদ্রগুপ্তকে চক্রবর্তী সম্রাট হবার নির্দেশ দিয়েছিল অর্থাৎ বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার। বাবার কথা অনুযায়ী উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া ছোট রাজ্যকে বিশাল সাম্রাজ্যে পরিনত করেছিলেন সমুদ্রগুপ্ত। একশোর বেশী যুদ্ধে অপারেজয় সমুদ্রগুপ্তের শরীরে একশো ক্ষত হয়ে গিয়েছিল যুদ্ধের ফলস্বরূপ, এই কারনেই মহাপরমাঙ্ক উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। মধ্যপ্রদেশের মালবে এরানের শিলালিপি থেকে জানা যায় সমুদ্রগুপ্ত আশেপাশের সমস্ত রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। তাঁর প্রভাব এতটাই ছিল যে আশেপাশের রাজারা স্বপ্নে সমুদ্রগুপ্তকে দেখে ভয় পেত এবং অনেকে বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পন করেছিল।

বৌদ্ধ গ্রন্থ আর্যমঞ্জুশ্রীকল্পেও সমুদ্রগুপ্তের বীরত্বের কাহিনী পাওয়া যায়। গয়া ও নালন্দার তাম্রলিপিতেও সমুদ্রগুপ্ত সম্পর্কে বর্ননা করা হয়েছে। সমুদ্র গুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত মথুরা শিলালিপিতে বলেছেন তাঁর বাবাকে হারানোর ক্ষমতা কোন রাজার ছিলনা। সমুদ্র গুপ্তের সভাকবি হরিষেনের লেখা থেকে জানা যায় সমুদ্র গুপ্ত দ্বিগবিজয়ের উদ্দেশ্যে একবার উত্তর ভারতে ও একবার দক্ষিন ভারত অভিযান করেছিলেন৷ উত্তর ভারতে সেসময়ের শক্তিশালী নয় জন রাজা ও দক্ষিন ভারতে এগারো জন রাজাকে পরাজিত করেছিলেন তিনি। উত্তর ভারত অভিযানে সমুদ্রগুপ্ত অচ্যুত, নাগসেন, গনপতিনাগ, রুদ্রদেবা, মাতিলা, নাগাদত্তা, নন্দিনী, চন্দ্রবর্মন ও বলবর্মনকে পরাজিত করেছিলেন। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে সমুদ্রগুপ্তের দক্ষিন ভারত অভিযান সম্পর্কে বলা হয়েছে সর্বদক্ষিনাপথরাজ পরাস্ত হয়েছিল অর্থাৎ দক্ষিন ভারতের সমস্ত রাজা সমুদ্রগুপ্তের কাছে পরাজিত হয়েছিল। এদের মধ্যে বারোজন শক্তিশালী রাজা ছিল কোসলের (আধুনিক ওড়িশা ও ছত্রিশগড়ের কিছু অংশ) মহেন্দ্র, মহাকান্তারের ( মধ্যপ্রদেশ ও ছত্রিশগড়ের কিছু অংশ) ব্যাঘ্ররাজ, কাঞ্চির বিস্নুগোপ, অবমুক্তের নীলরাজ, বেঞ্জির হস্থিবরমন, পৃষ্ঠপুরমের মহেন্দ্রগিরি, কোট্টুরের স্বামীদত্ত, এরন্ডপল্লের দমন, কুরলের মন্থরাজ, পলাক্কের উগ্রসেন, দেবরাষ্ট্রের কুবের, কুস্থলপুরের ধনঞ্জয়। 

ভারতবর্ষ ছাড়াও বর্তমান পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় অন্তত ৩০-৩৫ টি প্রদেশ তিনি জয় করেছিলেন। সমুদ্রগুপ্ত চানক্যর অর্থশাস্ত্র অনেকাংশ মেনে চলত এবং সুশাসক কিভাবে হওয়া যায় সেই নীতিও মানত। সাম্রাজ্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সমুদ্রগুপ্তের রীতি অনেকটা অদ্ভুত ছিল। তিনি মনে করতেন তাঁর রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে বিশাল সাম্রাজ্য পরিচালনা করা যথেষ্ট সমস্যার। সেই জন্য তিনি যখন যুদ্ধ করতেন প্রতিপক্ষ রাজাকে হত্যা করতেন না বরং সেই রাজাকে পরাস্ত করে তাঁর রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া হত এবং সেই রাজাকে আংশিক স্বাধীনতা দেওয়া হত কিন্তু প্রধান ক্ষমতা সমুদ্রগুপ্তের হাতেই থাকত। সমুদ্রগুপ্ত ব্রাহ্মন ধর্মের অনুসারী হলেও সব ধর্মের প্রতিই সহনশীল ছিলেন।

বিখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত বসুবন্ধু ছিল তাঁর বন্ধু ও মন্ত্রী। শ্রীলঙ্কার তৎকালীন রাজা মেঘাবর্মা বৌদ্ধগয়াতে বৌদ্ধমঠ তৈরি করবার অনুমতি চেয়েছিলেন, সমুদ্রগুপ্ত তাতে রাজি হয়েছিলেন। সমুদ্রগুপ্তের সময়ে সাত ধরনের মুদ্রা ছিল এবং সব মুদ্রাতেই সমুদ্রগুপ্তের বিভিন্ন ধরনের ছবি ছিল। কখনও তিনি বাঘ শিকার করছেন, কখনও বীনা বাজচ্ছেন আবার কখনও কুঠার হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। সমুদ্রগুপ্তের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না, শুধু এটুকু জানা যায় ওনার একমাত্র স্ত্রী ছিলেন দত্তাদেবী। ৪৫ বছর ভারত শাসন করবার পর ওনার পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ভারতের সিংহাসনে বসেন, যিনি তার বাবার থেকেও মহান ও শক্তিশালী শাসক ছিলেন। চক্রবর্তী সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের মতো শক্তিশালী শাসক ভারতবর্ষের ইতিহাসে খুব কমই ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *