ফিচার আর্টিকেল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের তৈরি সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার গোটা বিশ্বকে কেন অবাক করে দিয়েছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ঘাতক যুদ্ধ বলা হয়। তবে এই যুদ্ধে এমন কিছু প্রযুক্তির উদ্ভব হয়েছিল যা রীতিমতো অকল্পনীয় ছিল। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বা বিমানবাহী রনতরী যেকোনও দেশের নৌবাহিনীর গুরুত্বপূর্ন সম্পদ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান এমন এক এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করেছিল যা জলের নীচে চলাচল করতো! আই ৪০১ নামে জলের নীচে থাকা এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আদতে একটি বিশালাকার সাবমেরিন ছিল যাতে সাড়ে চার টন ওজনের তিনটি বিমান থাকতো। এই সাবমেরিনটির বৈশিষ্ট্য ছিল এটি শত্রুর রেডারে ধরা না দিয়েই শত্রুদেশের সীমানায় গিয়ে শত্রুদেশে বিমানে করে বোম্বিং করতে পারতো। সাবমেরিনটির জলের উপরে না এসেই একবার জ্বালানি ভরে প্রায় পুরো বিশ্বের জলভাগে যাওয়ার ক্ষমতা ছিল। ১৯৪৪ সালে জাপান বিশ্বের সামনে এই অসাধারন প্রযুক্তি প্রকাশ করে যাতে আমেরিকা ও জার্মানির মতোন সুপার পাওয়ার পর্যন্ত অবাক হয়ে যায়। পশ্চিমা বিশ্ব জাপানকে সর্বদা এশিয়ার একটি ছোট দেশ মনে করতো কিন্তু মাত্র তিন বছরে জাপান এতটাই সামরিক ক্ষমতা অর্জন করেছিলো যে পশ্চিমা দেশগুলোও চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল। সেসময় ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল বা আইসিবিএম ছিলনা, কিন্তু জাপান তার এই সাবমেরিনের সাহায্যে বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে আক্রমন করতে পারতো। কিন্তু তাসত্বেও জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জিততে পারেনি। আই ৪০১ সাবমেরিন তৈরির একবছর পরেই ১৯৪৫ সালে জাপানের আই ৪০১ এবং আমেরিকার সিগুন্ড সাবমেরিন মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ন হয় কিন্তু এই যুদ্ধে আমেরিকা জাপানের এই সাবমেরিনকে তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয় এবং ধ্বংস করে দেয় পরবর্তীকালে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করলেও এই পরিকল্পনা প্রথম জার্মানি করেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় সমগ্র ইউরোপ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একদিকে থাকে কেন্দ্রীয় শক্তি যাতে জার্মানি, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, অটোম্যান সাম্রাজ্যের মতোন দেশ ছিল। অন্যদিকে ছিল মিত্রশক্তি যাতে ব্রিটেন, ফ্রান্স, আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া, জাপানের মতোন দেশ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ইউরোপের সবদেশের উপর সহজেই আক্রমন করতে পারলেও একমাত্র ব্রিটেনে আক্রমন করতে পারছিলোনা কারন ব্রিটেন ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে ৬৫০ কিলোমিটার লম্বা ইংলিশ চ্যানেল দ্বারা আলাদা একটি দ্বীপ রাষ্ট্র ছিল। এজন্য ব্রিটেনে আক্রমনের জন্য জার্মানি একটি বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করে। জার্মানি একটি সাবমেরিন তৈরি করে এবং তার উপর যুদ্ধবিমান আটকে দেয় এভাবে বিশ্বের প্রথম সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের প্রযুক্তি সামনে আসে। কিন্তু জার্মানির এই পরিকল্পনা ততটা কার্যকর হয়নি কারন যুদ্ধবিমানগুলো সাবমেরিনের উপরে আটকানো থাকতো যা জলের উপরে ছিল ফলে সাবমেরিনকে সহজেই খুঁজে পাওয়া যেত, তাছাড়া তখন স্টেলথ প্রযুক্তি না থাকায় জার্মান সাবমেরিন সহজেই ব্রিটিশ রেডারে ধরা পড়ে যেত। ব্রিটেনের নৌবাহিনী বরাবরই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী নৌবাহিনী ছিল যার জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে যায়। জার্মানির বেশীরভাগ যুদ্ধাস্ত্র আমেরিকা দখল করে নেয় এবং আমেরিকা নিজে সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের উপর কাজ করা শুরু করে। আমেরিকা জানতো সাবমেরিনের উপর বিমান আটকানোর পরিকল্পনা জার্মানির ব্যর্থ হয়েছে। সেজন্য আমেরিকান বিজ্ঞানীরা সাবমেরিনের মধ্যেই একটি হ্যাঙ্গার তৈরি করে যেখানে বিমানকে রাখা যেত। কিন্তু এটারও একটা সমস্যা ছিল তা হল বিমান শত্রুর ভূমিতে আক্রমনের পর পুনরায় সাবমেরিনে ল্যান্ড করতে পারতোনা। এই জন্য আমেরিকা সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নির্মানের পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়। জার্মানি ও আমেরিকার ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপান এই সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরির কাজ শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি সম্পূর্ন ইউরোপের নিয়ন্ত্রন চাইছিলো, অন্যদিকে জাপানের লক্ষ্য ছিল এশিয়া দখল করা। কিন্তু আমেরিকাই ছিল এশিয়াতে জাপানের আধিপত্য বিস্তারে প্রধান বাধা। এজন্য জাপান ১৯৪১ সালে ডিসেম্বর মাসে আমেরিকার পার্ল হারবার বন্দরে আক্রমন করে। এরপরেই আমেরিকা ও জাপানের যুদ্ধ শুরু হয় আমেরিকার আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য জাপান আমেরিকাতে আক্রমনের পরিকল্পনা তৈরি করে। জাপানি নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতু ১৮টি সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরির সিদ্ধান্ত নেন, এগুলোর নাম দেওয়া হয় আই ৪০০ শ্রেনীর সাবমেরিন বা সেনটোকু শ্রেনীর সাবমেরিন।  

১৯৪১ সালে জাপান এই সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরির কাজ শুরু করে এবং মাত্র তিনবছরে এই সাবমেরিন ক্যারিয়ার তৈরির কাজ সম্পূর্ন করে ফেলে। জাপান যা তিনবছরে করে দেখায় তা জার্মানি ও আমেরিকা বহু বছরেও করতে পারেনি। জার্মানি ও আমেরিকার সাবমেরিন প্রজেক্টের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে জাপান তাদের সাবমেরিন ক্যারিয়ারে বিশেষ কিছু পরিবর্তন করে। জাপান সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে অ্যানেকোয়িক কোডিং ইনস্টল করে। এই সিস্টেম যেকোনও ধরনের শব্দকে শুষে নিত যার কারনে শত্রুদেশের সোনার সিস্টেম পর্যন্ত জাপানের সাবমেরিনকে খুঁজে পেতনা। যুদ্ধের সময় সাবমেরিনের আক্রমনের থেকে রক্ষা পেতে সবদেশই তাদের জলভাগে ম্যাগনেটিক মাইন লাগাতো যা সাবমেরিনের সংস্পর্শে এসেই বিস্ফোরিত হত। জাপান তাদের সাবমেরিন ক্যারিয়ারকে মাইনের থেকে রক্ষা করতে তাতে ডিম্যাগনেটাইজেশন কেবিল লাগায়। এসব কারনে জাপানের সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে সেসময় কোনও দেশ খুঁজে পেতনা সহজে। জাপান তাদের সাবমেরিন ক্যারিয়ারে সিলিন্ডার আকৃতির হ্যাঙ্গার তৈরি করেছিল। এই হ্যাঙ্গারে তিনটি আইচি এমসিক্সএওয়ান বোম্বার বিমান থাকতে পারতো। এই বিমানগুলো এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে সাবমেরিনের ভিতর তার ডানা ভাঁজ করে থাকতে পারে। একটি গুলতি থেকে কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পাথর যেভাবে ছোঁড়া হয় ঠিক সেভাবেই সিলিন্ডারে চাপ তৈরি করে বিমানগুলিকে শত্রুর দিকে লঞ্চ করা হত। আই ৪০০ শ্রেনীর এই সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলির মোট দৈর্ঘ্য ছিল ১২২ মিটার, প্রতিটি ক্যারিয়ারের মোট ডিসপ্লেসমেন্ট ছিল ৬,৫৬০ টন। চারটি ডিজেল ইঞ্জিন যুক্ত এসব সাবমেরিনের সর্বোচ্চ গতি ছিল ১৮.৭৫ নটস। সামুদ্রের ১০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত যেতে সক্ষম এই সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলির রেঞ্জ ছিল প্রায় ৭০,০০০ কিলোমিটার! যা রীতিমতো অবাক করার মতোন। তিনটি বিমান ছাড়াও এইধরনের সাবমেরিন ক্যারিয়ারে আটটি ৫৩৩ মিলিমিটার টর্পেডো টিউব ছিল যাতে ২০টি টাইপ ৯৫ টর্পেডো ছিল। এছাড়া একটি শক্তিশালী নেভ্যাল গান ও চারটি হেভি মেশিনগান ছিল এই সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলিতে। আই ৪০০ শ্রেনীর প্রথম সাবমেরিন আই ৪০১ ১৯৪৫ সালের ৮ জানুয়ারিতেই জাপানি নৌবাহিনীতে যুক্ত করা হয়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল জাপানের কাছে সেসময়ের সবচেয়ে আধুনিক সাবমেরিন থাকা সত্বেও জাপান এগুলো তেমনভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারেনি এবং যুদ্ধে পরাজিত হয় জাপান। 

১৯৪২ সালে মিডওয়ে দ্বীপে যুদ্ধে জাপানকে পরাজিত করে আমেরিকা এবং ১৯৪৩ সালের এপ্রিল মাসে আমেরিকার আক্রমনের জপাানি অ্যাডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোতুর মৃত্যু হয়। ইসোরোকু ইয়ামামোতুর কারনেই এই সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি হয়েছিল, তাই তার মৃত্যুতে এই প্রজেক্ট ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আঠারোটি সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরির পরিকল্পনা থাকলেও জাপানি সরকার মাত্র পাঁচটি সাবমেরিন ক্যারিয়ার তৈরির অনুমোদন দিয়েছিল এবং তার মধ্যে মাত্র দুটি সাবমেরিন ক্যারিয়ার জাপান তৈরি করেছিল। ১৯৪৫ সালের ২৫ জুলাই জাপানের এই দুটি সাবমেরিন ক্যারিয়ার আমেরিকার উলেঠি দ্বীপে আক্রমনের জন্য রওনা হয়। কিন্তু উলেঠি দ্বীপে আক্রমনের আগেই সাবমেরিন দুটির কম্যান্ডার জানতে পারে জাপান আত্মসমর্পন করে দিয়েছে। বাধ্য হয়ে তারা ফিরে আসার জন্য রওনা দেয় জাপানে। হঠাৎই আই ৪০১ সাবমেরিন ক্যারিয়ারের সামনে আমেরিকার সীগুন্ড শ্রেনীর সাবমেরিন চলে আসে এবং আই ৪০১ এর কম্যান্ডার বাধ্য হয় আত্মসমর্পনে। তখনই গোটা বিশ্ব জাপানের এই গোপন সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার সম্পর্কে জানতে পারে। এই সাবমেরিন এতটাই আধুনিক ছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকার থেকে এই সাবমেরিন চেয়ে বসে ডিজাইন ও প্রযুক্তি সম্পর্কে গবেষনার জন্য। কিন্তু আমেরিকা তার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী দেশকেই এই সাবমেরিন দেয়নি। আমেরিকা দাবী করে তারা এই সাবমেরিন ধ্বংস করে দিয়েছে। তবে এর পরবর্তী সময়ে কোনও দেশ সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার তৈরি করেনি কখনও কারন ১৯৬০ এর দশকে আইসিবিএম প্রযুক্তি সামনে আসে। যার মাধ্যমে অনেক কম খরচে, কম সময়ে অন্য দেশে আক্রমন করা সম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া জাপানের এই সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল এটা থেকে বিমান লঞ্চ করতে প্রায় ৪৫ মিনিট সময় লাগতো। এত দীর্ঘ সময় জলের উপরে থাকা সাবমেরিনকে শত্রুদেশ সহজেই খুঁজে পেয়ে যেত। তাছাড়া ১৯৭০ এর দশক থেকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন অনেক অত্যাধুনিক সাবমেরিন তৈরি করে ফেলেছিল যার জন্য সাবমেরিন এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের প্রয়োজনীয়তা পড়েনি আর কখনও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *