যৌতুক দেওয়া হয়েছিল গোটা মুম্বাই শহরকে
ভারতের স্বপ্নের নগরী, মায়া নগরী মুম্বাই যাকে ভারতের বানিজ্যিক রাজধানী বলা হয়। বিশ্বের অন্যতম বড় চলচিত্র কেন্দ্র বলিউডের শহর মুম্বাই বর্তমানে যতটা আকর্ষনীয় এর ইতিহাস তার থেকেও বেশী অসাধারন। বলা হয় প্রায় কুড়ি মিলিয়ন জনসংখ্যার মুম্বাই নগরীতে সবার জন্য কিছু না কিছু রয়েছে। কিন্তু মুম্বাই শহরের ব্যাপারে একটা অদ্ভুত তথ্য আছে যে কিছু বছর আগে এই গোটা শহরকেই যৌতুক হিসাবে উপহার দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় সমাজে একটি প্রথা চলে আসছিল যে বিয়ের সময়ে মেয়ের বাবাকে পাত্রপক্ষকে ধনসম্পদ, মূল্যবান জিনিস দিতে হয় যাকে যৌতুক প্রথা বলে। বর্তমানে যৌতুক নেওয়া এবং দেওয়া দুটোই অপরাধের পর্যায়ে বলা ধরা হয়। এখন যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে শক্ত আইন রয়েছে। কিন্তু কয়েকশো বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছিল যা এখন প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। কিন্তু আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো বছর আগে এক বিদেশী রাজা অন্য আরেক বিদেশী রাজাকে গোটা মুম্বাই শহরকেই যৌতুক হিসাবে দিয়েছিল।
আজকের মুম্বাই অতীতে সাতটি ছোট ছোট দ্বীপে বিভক্ত ছিল। অর্থাৎ মুম্বাই বা বোম্বে একটি দ্বীপপুঞ্জ ছিল যাতে মাহিম, ওরলি, বোম্বে, প্যারেল, মাজগাঁও, লিটিল কোলাবা ও কোলাবা প্রধান ছিল। অতীতে এই সাতটি দ্বীপ একসাথে যুক্ত ছিলনা ফলে প্রত্যেক দ্বীপের মধ্যে যোগাযেগ রাখা খুবই মুস্কিল ছিল। বলা হয় প্রস্তর যুগ থেকে এসব দ্বীপের অস্তিত্ব ছিল। উত্তর মুম্বাইয়ের কান্ডিভেলির কাছে এমন অনেক প্রমান পাওয়া গেছে যাতে জানা গেছে এখানে ২৩০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে মানুষ বসবাস করে। অতীতে মুম্বাইকে হেপ্টানেসিয়া বলা হত অর্থাৎ সাতটি দ্বীপের সমষ্টি। তৃতীয় শতক থেকে ১৩৪৮ পর্যন্ত বিভিন্ন হিন্দু রাজা এসব দ্বীপের শাসক ছিল। ৩২১ থেকে ১৮৫ বিসিই পর্যন্ত এসব দ্বীপ মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এরপরে এখানে সাতবাহনদের শাসন চলে। ১৩৯১ থেকে ১৫৩৪ পর্যন্ত বোম্বে দ্বীপ ও উত্তর কোঙ্কন উপকূল গুজরাটের শাসক সুলতান বাহাদুর শাহের অধীনে ছিল। এইসময়ই এখানে ইউরোপীয়ানদের আসা যাওয়া শুরু হয়।
১৪৯৮ সালে পর্তুগীজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা ইউরোপীয়ান বনিকের বেশে ভারতে আসে। এরপর থেকেই পর্তুগীজরা উত্তর কোঙ্কন উপকূলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে।
১৫১০ সালে বিজাপুরের সুলতানকে পরাজিত করে গোয়াতে নিজেদের শক্ত ঘাঁটি তৈরি করে পর্তুগীজরা। এরই মধ্যে পর্তুগীজ ভ্রমনকারী ফ্রান্সিসকো ডি আলমেডা বোম্বে পৌঁছায় তার জাহাজ নিয়ে। ১৫০৯ সালের ২১ জানুয়ারি ফ্রান্সিসকো ডি আলমেডা গুজারাটের সুলতানের থেকে মাহিম ক্রিক দখল করে। জানুয়ারি, ১৫৩৩ আসতে আসতে মাহিম, বান্দ্রা ও বোম্বে দ্বীপ সহ সমস্ত দ্বীপই পর্তুগীজরা দখল করে নেয়৷
অন্যদিকে মধ্যভারতে ষোল শতকে মুঘল আধিপত্য শুরু হয়৷ মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের প্রভাব বৃদ্ধিতে ভীত হয়ে পড়ে গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ। ১৫৩২ এর পর থেকে হুমায়ুন ও বাহাদুর শাহের মধ্যে একাধিক ছোট ছোট সংঘর্ষ হতে থাকে। অবশেষে হুমায়ুন গুজরাট দখল করে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে পর্তুগিজরা বাহাদুর শাহকে ১৫৩৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর বেসিনের চুক্তি করতে বাধ্য করায়। চুক্তি অনুযায়ী বোম্বে সহ সাত দ্বীপ এবং বেসিন পর্তুগীজদের অধীনে চলে আসে এবং সেখানে পর্তুগীজ শাসন শুরু হয়। পর্তুগীজরা এখানে বানিজ্য কেন্দ্র তৈরি করে। সাথে সাথে এখানে প্রচুর গীর্জা এবং দুর্গ তৈরি করা হয়। সতেরো শতকের প্রথমদিক অবধি বোম্বে পর্তুগীজদের অধীনেই ছিল। বোম্বেকে পর্তুগীজরা বোম বাহিয়া বলতে যার অর্থ ভালো উপসাগর। এখান থেকেই এর নাম বোম্বে হয়।
১৫৮০ থেকে ১৬৪০ এর মধ্যে এখানে ডাচদের আগমন শুরু হয়। ধীরে ধীরে এই এলাকার বানিজ্যে ডাচদের একচ্ছত্র আধিপত্য শুরু হয়। তখনই এই এলাকার উপর নজর পড়ে ব্রিটিশদের। এই এলাকার স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব বুঝতে পারে ইংরেজরা। ১৫৮৩ সালে প্রথম কোন ইংরেজ বনিক বোম্বে এসেছিল। গুরুত্বপূর্ন বানিজ্যিক কেন্দ্র ও নৌ বন্দর হিসাবে বোম্বে ব্রিটিশদের কাছে আদর্শ জায়গা ছিল। ১৬১২ সালে ব্রিটিশ ও পর্তুগীজদের মধ্যে সোয়ালির যুদ্ধ হয় যাতে পর্তুগীজরা পরাজিত হয়। এরপরে ভারতের ব্রিটিশদের আরও প্রভাব বৃদ্ধি পায়। ১৬৫২ সালে ব্রিটিশ সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বোম্বেকে পর্তুগীজদের থেকে কেনবার নির্দেশ দেয়।
১৬৬০ সালে পর্তুগালের রাজা ছিল জন চতুর্থ। চতুর্থ জনের লক্ষ্য ছিল খ্রীষ্টান ধর্মকে যতটা সম্ভব প্রচার করার। যার কারনে বোম্বে সহ বিস্তীর্ন এলাকার বানিজ্য ও শাসনে তার ততটা নজর ছিলনা। ২৩ জুন, ১৬৬১ সালে এক পর্তুগীজ কুটনীতিবিদ পর্তুগালের রাজা চতুর্দিকে জনের কন্যা ক্যাথেরিন ব্রাগেন্জার সাথে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের সাথে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। এই বিয়েতে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে বোম্বে সহ তিন লাখ পাউন্ড নগদ এবং ভূমধ্যসাগরে মরোক্কর একটি তেনজিয়ের নামে একটি শহর দেওয়া হয় যৌতুক হিসাবে। দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগীজদের স্পেন ও ডাচদের থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। চতুর্থ জনও পর্তুগালে থাকা ব্রিটিশদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয়।
১৬৬১ সালের ২৮ আগস্ট উভয় পক্ষের মধ্যে রীতিমতো চুক্তি হয় এই সমস্ত বিষয়ে। ১৬৬২ সালের ৩১ মে অবশেষে এই বিয়ে সম্পন্ন হয়। কিন্তু বোম্বে হস্তান্তর এতটা সহজ হয়নি কারন পর্তুগীজ ভাইসরয় প্রথম থেকেই বোম্বেকে ব্রিটিশদের দেওয়ার বিরুদ্ধে ছিল। এম ভি কামাথ তার বই টাইডস অফ টাইমে লিখেছেন এইসময় মুম্বাইয়ের এক ব্রাহ্মন ব্রিটিশদের জানিয়েছিল পর্তুগীজ শাসনে হিন্দুদের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল এখানে যার কারনে যদি ব্রিটিশরা বাইরে থেকে আক্রমন করে পর্তুগীজদের উপর তাহলে তারা বোম্বেতেই পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে আভ্যন্তরীন বিদ্রোহ করবে। ব্রিটিশদের পচ্ছন্দ হয় এই পরিকল্পনা। একটি জাহাজে করে ৪৫০ ব্রিটিশ সেনা রওনা হয় বোম্বে আক্রমনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু জাহাজের সেনারা অতিরিক্ত মদ্যপান করায় এবং আবহওয়া অত্যন্ত খারাপ হওয়ায় প্রায় তিনশো সেনা মারা যায় জাহাজেই। ফলে এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৬৬৫ সালে সরকারি ভাবে বোম্বে ব্রিটিশদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা থাকলেও তা বারবার দেরী হচ্ছিল কারন স্থানীয় পর্তুগীজ সেনা রাজি হচ্ছিলনা। ব্রিটিশরা বোম্বের জন্য এতটা উদগ্রীব ছিল যে তারা সমস্ত দ্বীপের অধিকার বাদ দিয়ে শুধু বোম্বেই দাবি করছিলো। এরই মধ্যে পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে পর্তুগালের রাজা একটি চিঠি পাঠিয়ে জানায় বিবাহের জন্য যে চুক্তি হয়েছিলো তা বাতিল করা হচ্ছে কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল।
১৬৬৬ সাল আসতে আসতে ব্রিটিশরা একে একে সব দ্বীপ দখল করে নেয়। ব্রিটিশ সরকার বোম্বেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বার্ষিক ১০ পাউন্ডের চুক্তিতে দিয়ে দেয়। সাথে সাথে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসকে ৫০,০০০ ডলার লোন দেয়। এখান থেকেই মুম্বাইয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শুরু হয়। প্রথম দিকে এখানে রোগের প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত বেশী ছিল। ধীরে ধীরে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখানে রোগ দূর করা হয়।
১৬৬১ সালে এখানে জনসংখ্যা ছিল দশ হাজার। এর চারবছর পর জনসংখ্যা বেড়ে হয় প্রায় ষাট হাজার। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুরাট থেকে বোম্বে পরিচালনা করতো। কিন্তু সুরাটে বারবার মুঘল ও মারাঠাদের চাপে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের কার্যালয় বোম্বেতে নিয়ে আসে। ১৬৬৮ সালে বোম্বের দায়িত্ব নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জেরাল্ড অ্যানগুয়ের। ১৬৭৭ সাল অবধি তার সময়ে বোম্বেতে প্রথম আদালত, খবরের কাগজের কেন্দ্র গড়ে ওঠে। সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের অন্যতম প্রধান বানিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে বোম্বে, বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক এসে এখানে বসতি তৈরি করতে থাকে। এরই মধ্যে ১৭৫৭ সালে বাংলার নবাব সিরাজ উদ দৌলার মধ্যে পলাশীর যুদ্ধ হয় যাতে ব্রিটিশরা জয়লাভ করে এবং বাংলা ব্রিটিশদের অধীনে আসে ফলে ভারতে নিজেদের অবস্থান আরও মজবুত করে ব্রিটিশরা। জনবসতি বাড়ার সাথে সাথে এবং আরও বড় বানিজ্যিক কেন্দ্রের জন্য ব্রিটিশদের জমির দরকার হয়৷ যার কারনে সাতটি দ্বীপকে একত্রিত করে বড় ভূভাগ তৈরির কাজ শুরু হয়। তৎকালীন বোম্বের গভর্নর উইলিয়াম হর্নবে এই কাজ শুরু করে। তারই নাম অনুসারে এই প্রজেক্টের নাম হর্নবে ভেলার্ড হয়। এই পুরো প্রজেক্ট সম্পন্ন হতে প্রায় দেড়শো বছর লেগে যায়৷ ১৮৪৫ সালে আধুনিক মুম্বাই শহর তৈরি শুরু হয়। ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল মুম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত ভারতে প্রথম রেললাইন তৈরি হয়। উনিশ শতক আসতে আসতে বোম্বে শুধু ভারতের নয় বরং গোটা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ন বানিজ্যিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিনত। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামেও বোম্বের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল। ১৮৮৫ সালে দাদাভাই নৌরেজি বোম্বে প্রেসিডেন্সি অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করেছিল এখানে। এই বছরই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বোম্বেতেই। এক সময়ের দ্বীপপুঞ্জ থেকে আধুনিক, অর্থনৈতিক শক্তিশালী মুম্বাই নগরী গড়ে ওঠার যাত্রা সত্যিই অভাবনীয়।