স্কটল্যান্ডের রহস্যময় লাইট হাউস। কোনও অদৃশ্য শক্তির ইশারা!
এই মহাবিশ্বে প্রতিনিয়ত এমন অনেক ঘটনা ঘটে যার কোন ব্যাখা পাওয়া যায়না অনেক সময়। ঠিক যেন কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এসব ঘটনা সংঘটিত হয়। ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটে স্কটল্যান্ডের নির্জন এক দ্বীপে যাতে তিনজন মানুষ রাতারাতি উধাও হয়ে যায়, অনেক খুঁজেও তাদের কোনও সন্ধান পাওয়া যায়নি আজ পর্যন্ত। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে তারা।
স্কটল্যান্ড দেশটির পশ্চিম প্রান্তে আটলান্টিক মহাসাগরে সাতটি ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে যাদের একত্রে ফ্ল্যানান ইসলে দ্বীপপুঞ্জ বলা হয়। সপ্তম শতকের এক মহান আইরিশ সাধু ফ্ল্যানানের নাম অনুসারে এই দ্বীপপুঞ্জের নাম ফ্ল্যানান ইসলে দ্বীপপুঞ্জ রাখা হয়েছে। ১৯৭১ সাল থেকে এসব দ্বীপে কেউ বসবাস করে না। এই দ্বীপপুঞ্জের অবস্থান স্কটল্যান্ডের মূল ভূভাগ থেকে বেশ দূরে প্রায় সমুদ্রের মাঝামাঝি। যার কারনে এখান দিয়ে প্রতিদিনই প্রচুর জাহাজ যাতায়াত করে। ফ্ল্যানান ইসলে দ্বীপপুঞ্জ সমুদ্রের মাঝামাঝি হওয়ায় ১৮৯৯ সালে নর্থান লাইটহাউস বোর্ড নামক একটি সংস্থা এখানের একটি দ্বীপে একটি লাইট হাউস তৈরি করে। সমুদ্রে রাতে জাহাজকে পথ দেখানোর জন্য সমুদ্রের তীরে অথাব সমুদ্রের মাঝে কোন দ্বীপে একটি বড় টাওয়ার তৈরি করা হয়, তাতে আলো জ্বালিয়ে রাতে জাহাজকে পথ দেখানো হয়, একেই লাইট হাউস বলে। জাহাজ যাতে রাতে সমুদ্রের তীরে কোন পাথরে ধাক্কা না খায় তার জন্য লাইট হাউস ব্যবহার করা হয়। আগে লাইট হাউসে আলোর জন্য অনেক মোমবাতি, কেরোসিন ব্যবহার করা হত, এখন বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়।
১৮৯০ সালে এই লাইট হাউস তৈরির কাজ শুরু হলেও আটলান্টিক মহাসাগরের তীব্র ঢেউ ও খারাপ আবহওয়ার কারনে এটা সম্পন্ন হতে নয় বছর লেগে যায়। ফ্ল্যানান ইসলে দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ আইলিন মোর দ্বীপে এই লাইট হাউস তৈরি করা হয়। এই লাইট হাউস চালানোর জন্য তিনজন লোকের প্রয়োজন হতো। যার কারনে ১৯০০ সালের ৭ ডিসেম্বর আইলিন মোর দ্বীপে ডোনাল্ড ম্যাকার্থার, থমাস মার্শাল এবং জেমস ডুকাট এই তিনজন লোককে পাঠানো হয়। নর্থান লাইট হাউস বোর্ডের প্রধান রবার্ট মুরহেড নিজে তাদের আইলিন মোর দ্বীপে পৌঁছে দিয়ে আসে। রবার্ট মুরহেডই শেষ কোন ব্যাক্তি যে ওই তিনজনকে জীবিত অবস্থায় দেখেছিল শেষ বারের জন্য। আইলিন মোর দ্বীপে ওই তিনজনের জন্য কুড়ি দিনের মতো রসদ মজুত ছিল, এরপর আবার তাদের রসদ পাঠানো হতো। ওই তিনজন নির্জন দ্বীপে লাইট হাউস নিয়ন্ত্রনের দায়িত্বে থেকে যায়। ১৫ ডিসেম্বর রাতে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া থেকে একটি জাহাজ স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ শহরের লিথ বন্দরে আসছিল। রাতে জাহজটি যখন ফ্ল্যানান ইসলে দ্বীপপুঞ্জের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন লাইট হাউসে আলো জ্বলতে না দেখে জাহাজের কর্মীরা অবাক হয়ে যায়। ১৮ ডিসেম্বর লিথ বন্দরে পৌঁছানোর পর জাহাজের কর্মীরা এই ঘটনা নর্থান লাইট হাউস বোর্ডকে জানায়। এরপরেই ২০ ডিসেম্বর নর্থান লাইট হাউস বোর্ড হেসপেরাস নামের একটি জাহাজ পাঠায় আইলিন মোর দ্বীপের উদ্দেশ্যে। কিন্ত খারাপ আবহাওয়ার কারনে জাহাজটি সঠিক সময়ের অনেক পরে ২৬ ডিসেম্বর দুপুর নাগাদ দ্বীপের কাছে পৌঁছায়। হেসপেরাসের ক্যাপ্টেন জিম হার্ভি জাহাজের হুইসেল বাজায় কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কেউ বাইরে আসেনি। জিম হার্ভি তার হেসপেরাস জাহাজে কুড়ি দিনের প্রয়োজনীয় রসদও নিয়ে এসেছিল কিন্তু তা নেবার জন্য তীরে কাউকেই পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকবার হুইসেল বাজানোর পরও কেউ বাইরে না আসায় বাধ্য হয়ে জোসেফ মুর নামে এক ব্যাক্তিকে ছোট নৌকা করে দ্বীপে পাঠানো হয়। জোসেফ মুর দেখে লাইট হাউসের দরজা বন্ধ রয়েছে, বিছানা ভাজ করা নেই যেন কোউ শুয়েছিল, দোওয়াল ঘড়িটা একটি নির্দিষ্ট সময়ে বন্ধ হয়ে আছে এবং আলোর ল্যাম্প পুরো পরিষ্কার করা। এরপর হেসপেরাস থেকে আরও দুইজন লোক আসে লাইট হাউসে। অনেক অনুসন্ধান করেও সেই তিনজন ব্যাক্তির কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি যার কারনে হেসপেরাস ফিরে আসে এবং জাহাজের ক্যাপ্টেন জিম হার্ভি নর্থান লাইট হাউস বোর্ডকে ২৬ ডিসেম্বর টেলিগ্রাম করে জানায় ফ্ল্যানান ইসলে দ্বীপপুঞ্জে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে গেছে। লাইট হাউসে কাজ করা তিন ব্যাক্তি কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। সম্ভবত এক সপ্তাহ আগেই এই ঘটনা ঘটেছে। হেসপেরাস জাহাজের কর্মীরা পুরো দ্বীপে অনুসন্ধান করে দেখে দ্বীপটির পূর্ব প্রান্তে সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিন্তু পশ্চিম প্রান্তে সামুদ্রিক আবহওয়ার প্রভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পশ্চিম প্রান্তে সমুদ্র তল থেকে প্রায় ১০৮ ফুট উচ্চতায় একটি বড় বাক্স রাখা ছিল তা ভেঙে গিয়ে তার ভিতরের সমস্ত জিনিস ছড়িয়ে গেছে। পশ্চিম তীরে একটি রেল লাইন পাতা ছিল যাতে জাহাজ থেকে জিনিস দ্বীপে পৌঁছানো হত সেটাও ভেঙে গেছে পুরো। প্রায় ২০০ ফুট উচ্চতায় থাকা ঘাস পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে এবং প্রায় একহাজার কিলোগ্রাম ওজনের একটি বড় পাথরের খন্ড তার পূর্বের জায়গা থেকে অন্যত্র সরে গেছে যা প্রমান করে পশ্চিম প্রান্তে সমুদ্রের তীব্র ঢেউ বারবার আছড়ে পড়েছিল। কিন্তু ওই তিন ব্যাক্তি এই খারাপ আবহওয়ার কারনে যে সমুদ্রে তলিয়ে গেছে এমন ব্যাপারও নয় কারন লাইট হাউসের খাতায় ১৫ ডিসেম্বর সকাল নয়টা অবধি ঘটা সমস্ত ঘটনা লিপিবদ্ধ করা ছিল এমনকী ১৫ ডিসেম্বর রাতে হওয়া খারাপ আবহওয়া সম্পর্কেও লেখা আছে। যার অর্থ খারাপ আবহাওয়ার পরও ওই তিন ব্যাক্তি লাইট হাউসে ছিল। তারপর তাদের সাথে কী হল তা আজও জানা যায়নি। ২৯ ডিসেম্বর রবার্ট মুরহেড নিজে আসে ওই লাইট হাউসে এবং তিনি অনুসন্ধান করে বলেন তার মত অনুযায়ী তারা খারাপ আবহাওয়ার সময়ে পশ্চিম প্রান্তে ছিল, যার কারনে জলে তলিয়ে গেছে। কিন্ত এই তথ্য যথেষ্ট ছিলনা তাদের উধাও হয়ে যাবার প্রকৃত কারন সম্পর্কে। বহু খোঁজার পরও তাদের মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।
যখন কোন ঘটনার কারন জানা যায় না তখন সেই ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্ন রকম মতবাদ ছড়িয়ে পড়ে। ফ্ল্যানান ইসলে দ্বীপপুঞ্জের এই ঘটনা সম্পর্কেও এমন অনেক মতবাদ তৈরি হয়েছে। একটি খবর অনুযায়ী ওই তিন ব্যাক্তি কোনও কারনে দ্বীপের কিনারায় চলে গিয়েছিল এবং তাদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল সেসময় তারা পা পিছলে সমুদ্রে পড়ে যায়। আর একটি মত অনুযায়ী ওই তিনজনের মধ্যে কোনও একজন বাকী দুজনকে খুন করে নিজেও সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছিল। আরও একটি তথ্য অনুযায়ী লাইট হাউসে কাজ করবার সময়েই সামুদ্রিক দুর্যোগের কারনে তিনজনেই সমুদ্রে তলিয়ে যায়। এগুলোতো সাধারন মতবাদ। কিছু অদ্ভুত তথ্যও ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। কারও মতে সমুদ্র থেকে আসা কোনও দানব তাদের মেরে ফেলেছে আবার কারও মতে মহাকাশ থেকে আসা কোনও এলিয়েন তাদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে। স্কটল্যান্ডের অনেক মানুষ মনে করে ফ্ল্যানান ইসলে দ্বীপপুঞ্জ অভিশপ্ত, এখানে রাত কাটানো উচিত নয়। এখানে নাকী আত্মারা বসবাস করে। এক ব্যাক্তি এটাও জানিয়েছিল এই দ্বীপের দিকে সে আত্মাদের একটি নৌকা দেখেছিল, সেই আত্মারাই হয়ত ওই তিন ব্যাক্তিকে নিয়ে গেছে। কারন যাই হোক না কেন ফ্ল্যানান ইসলে দ্বীপপুঞ্জে আসলে কী হয়েছিল এবং ওই তিনজন ব্যাক্তি কোথায় গেল তা হয়ত কোনওদিনও জানা যাবে না। এই ঘটনা এত রহস্যময় যে এর উপর হলিউডে দুটি বিখ্যাত সিনেমাও তৈরি করা হয়েছে দি লাইট হাউস এবং দি ভ্যানিশিং।