রাশিয়ার ঠান্ডার কাছে হার মেনেছিল নেপোলিয়নকেও
বিশ্বের ইতিহাসে যত মিলিটারি জেনারেল রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বলা হয় নেপোলিয়ন বোনাপার্টকে। শত্রুকে তার অসাধারন রননীতি দ্বারা পরাজিত করতেন তিনি। কিন্তু একটি ভুল সিদ্ধান্তের কারনেই তার বিজয়রথ আটকে যায়। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট একটি যুদ্ধে প্রকৃতিকে শত্রু হিসাবে নির্বাচন করে যা তার পতনের সূচনা করে। ইতিহাসে দেখা যায় যত বড়ই রন নায়ক হোক না কেন প্রকৃতির সামনে সবাই অসহায়, ঠিক এমনটাই ঘটে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের সাথে।
সময়টা ১৭৯৯, সদ্য সমাপ্ত হয়েছে ফরাসী বিপ্লব। এই সময় ফ্রান্সের একচ্ছত্র নায়ক বা একপ্রকার ফ্রান্সের রাজাই হয়ে ওঠে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট। ফরাসী বিপ্লব খুবই রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ ছিল যা অনেক বছর ধরে চলেছিল। ক্ষমতা পাওয়ার পরেই নেপোলিয়ন ফ্রান্সের আশেপাশের সমস্ত দেশের সাথে যুদ্ধ শুরু করে একে নেপোলিয়নিক যুদ্ধ বলা হয়। ১৮১০ আসতে আসতে ইউরোপে সুপার পাওয়ার হিসাবে উত্থান ঘটেছিল ফ্রান্সের। জার্মানি, বেলজিয়াম, ইটালি, পোল্যান্ড, স্পেনের অধিকাংশ অঞ্চল সরাসরি নেপোলিয়নের অধীনে চলে আসে। তার ক্ষমতা দেখে অনেক দেশ ফ্রান্সের সাথে বন্ধুত্ব করে। রাশিয়াও সেসময় ফ্রান্সের বন্ধু দেশ ছিল। ইউরোপে ফ্রান্সের মজবুত অবস্থান সত্ত্বেও একটি এমন দেশ ছিল যাকে নেপোলিয়ন তখনও পর্যন্ত হারাতে পারেনি। দেশটি হল ব্রিটেন, ১৮০৬ সালে বিনাযুদ্ধে ব্রিটেনকে পরাজিত করবার জন্য নেপোলিয়ন একটি কৌশল তৈরি করে। ভৌগোলিক ভাবে ব্রিটেন একটি দ্বীপ দেশ অর্থাৎ চারপাশে সমুদ্র বেষ্ঠিত। ব্রিটেনকে বাইরের দেশগুলো থেকে জরুরী জিনিস আনতেই হয় সমুদ্রপথে। নেপোলিয়ন ইউরোপের সমস্ত দেশকে ব্রিটেনের সাথে বানিজ্য করতে বারন করে দেয়। নেপোলিয়ন ভেবেছিল এভাবে ব্রিটেনকে ঘেরাবন্দি করলে একটা সময় ব্রিটেন বাধ্য হয়ে আত্মসমর্পন করবে। কিন্তু ১৮১০ সাল পর্যন্ত ঘেরাবন্দি করার পরেও ব্রিটেন নেপোলিয়নের কাছে আত্মসমর্পন করেনি যার প্রধান কারন রাশিয়া।
সব দেশের সাথে বানিজ্য বন্ধ হলেও রাশিয়ার সাথে বানিজ্য চলছিল ব্রিটেনের। কারন রাশিয়ার জার আলেকজান্ডার প্রথম জানতো রাশিয়ায় প্রচুর খনিজসম্পদ আছে কিন্তু সেগুলো উত্তোলন করে ব্যবহার করা কিংবা ভারী কোন শিল্প কারখানা নেই রাশিয়ায়। উপরন্তু রাশিয়ান মুদ্রা রুবেলের দামও কমে যাচ্ছিল। তাই রাশিয়া ব্রিটেনের সাথে বানিজ্য করেই যাচ্ছিল। এই ঘটনায় ক্রুদ্ধ হয় নেপোলিয়ন, এছাড়া রাশিয়ায় সেসময় ফ্রান্সের পন্যের উপর অতিরিক্ত কর নেওয়া হত। যার কারনে নেপোলিয়ন ঠিক করে জার আলেকজান্ডার প্রথমকে একটা শিক্ষা দেবে এবং রাশিয়া আক্রমন করবে। নেপোলিয়নের লক্ষ্য ছিল গোটা রাশিয়া দখল করা নয় বরং রাশিয়ার একটি বড় অঞ্চল দ্রুত আক্রমন করে দখল করা যাতে রাশিয়ার জার বাধ্য হয়ে তার সাথে এসে চুক্তি করে। রাশিয়ার সম্রাটকে সেসময় জার বলা হত।
১৮১২ সালে নেপোলিয়ন রাশিয়ায় আক্রমনের জন্য বিশাল সেনাবাহিনী তৈরি করে। একে গ্র্যান্ড আর্মি বলা হত। তার সেনাবাহিনীতে সাড়ে চার লাখের বেশী সেনা ছিল। তবে সবাই ফ্রান্সের অধিবাসী ছিলনা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে লোক নিয়ে এই বাহিনী তৈরি করা হয়েছিল। ১৮১২ সালের ২৪ জুন নেপোলিয়নের বাহিনী রাশিয়ায় প্রবেশ করে। নেপোলিয়ন ঠিক করেছিল রাশিয়ায় তিন সপ্তাহের অভিযান করে জারকে বাধ্য করবে তার সাথে চুক্তি করতে। নেপোলিয়ন রাশিয়ার ভিলনা শহরে প্রবেশ করে যুদ্ধের জন্য কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে সেখানে কোনও রাশিয়ান সেনা ছিলনা। তারা আগেই পিছিয়ে গিয়েছিল। নেপোলিয়নের সেনা ভেবেছিল রাশিয়ানরা হয়ত ভয় খেয়ে পালিয়েছে। কিন্তু রাশিয়ান সেনাবাহিনী অন্যরকম কৌশল অবলম্বন করে। রাশিয়ান সেনা ভিলনা ছেড়ে চলে যাবার আগে সেখানে সব ফসল, খাদ্য নষ্ট করে দিয়ে যায়। নেপোলিয়ন যুদ্ধ করবার সময় বেশী খাদ্য বহন করতো না, নেপোলিয়ন যেখানে যুদ্ধ করতে যেত সেখান থেকেই সবকিছু লুঠ করতো। রাশিয়ানরা এটা জানতো, তাই তারা সবকিছু নষ্ট করে দেয় যাতে নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী খাদ্য না পায়। ভিলনা শহর থেকে একটু দূরে আরও একটি শহর উইটবেস্ককেও সব খাদ্য, ফসল নষ্ট করে দেয় রাশিয়ানরা।
রাশিয়ান সাধারন মানুষ নিজেরাই এসব নষ্ট করে দিত নেপোলিয়নকে প্রতিরোধ করবার জন্য। নেপোলিয়ন এর আগে লড়াই করেছিল মধ্য ইউরোপে, সেখানে জনসংখ্যা খুবই বেশী ছিল ফলে সহজেই খাদ্যশস্য পেয়ে যেত তার সেনাবাহিনী। কিন্তু রাশিয়ায় জনসংখ্যা এতটাই কম ছিল যে কয়েকশো কিলোমিটার জুড়ে শুধু ফাঁকা এলাকা, যদিও জনবসতি থাকতো সেখানে কিছুই পাওয়া যেত না সব পরিত্যক্ত ছিল। জুলাই মাসে অবশেষে সোমেলেন্সক শহরে নেপোলিয়নের সেনা ও রাশিয়ান সেনাবাহিনীর মধ্যে লড়াই হয়। তবে এখানেও কম সংখ্যক রাশিয়ান সেনা হঠাৎ লড়াই করে সব কিছু নষ্ট করে পেছনে চলে যায়। রাশিয়ান সেনাবাহিনীর সাথে নেপোলিয়নের প্রধান লড়াই হয় বোরোদিনোর যুদ্ধে। মস্কো থেকে ৭৫ মাইল দূরে বোরোদিনো নামক জায়গায় দুপক্ষের লড়াই হয় যাতে উভয়পক্ষেই প্রচুর ক্ষতি হয়।
প্রথমদিনের যুদ্ধে নেপোলিয়ন জিতে যায়। কিন্তু পরেরদিন যুদ্ধের আগেই রাশিয়ান সেনা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। ১৮১২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর মস্কো উপস্থিত হয়। নেপোলিয়ন ভেবেছিল মস্কো রাশিয়ানদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন শহর এখানে হয়ত জার আলেকজান্ডার বা তার কোন প্রতিনিধির সাথে চুক্তি হবে তার। কিন্তু মস্কো পৌঁছে নেপোলিয়ন অবাক হয়ে যায় দেখে শহরে আগুন জ্বলছে, কেউ নেই সেখানে, সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। নেপোলিয়নের মস্কো পৌঁছানোর আগে এক রাশিয়ান জেনারেল মস্কোর সব জেল খুলে দিয়ে কয়েদিদের নির্দেশ দেয় গোটা শহর জ্বালিয়ে দেবার। মস্কোতে একমাস থাকার পরেও জারের কোন প্রতিনিধির দেখা না পেয়ে নেপোলিয়ন বুঝতে পারে এখানে তার আর থাকা যাবেনা। কারন তার সেনাবাহিনীর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নেই, নেপোলিয়ন তিন সপ্তাহের জন্য রাশিয়ায় আসার জন্য এলেও তার রাশিয়াতে ততদিন চার মাস হয়ে গেছে। নেপোলিয়ন ঠিক করে দক্ষিনে কলুগা হয়ে ফিরবে কারন যে পথে এসেছিল সে পথে ফিরলে কিছুই পাবেনা তার সেনা৷ কিন্তু কলুগাতে বিশাল রাশিয়ান সেনা থাকায় বাধ্য হয়ে পূর্বের পথেই ফেরারা সিদ্ধান্ত নেয় নেপোলিয়ন। এইসময় নেপোলিয়নের কাছে যুদ্ধপযোগী মাত্র এক লাখ সেনা ছিল। তার সাড়ে চার লাখ বিশাল সেনার অধিকাংশ অনহারে বা যুদ্ধে মারা গেছিল, বাকীরা অর্ধাহারে কিংবা আহত অবস্থায় ছিল। সোমেলেন্সক শহরে যখন পুনরায় নেপোলিয়নের সেনা পৌঁছায় তখন নভেম্বর মাস শুরু হয়ে গেছে, যার কারনে ঠান্ডায় তার আরও কিছু সেনা মারা যায়।
এদিকে সোমেলেন্সকে নেপোলিয়ন বিশ্রাম নিতেও পারতনা, কারন পিছনে রাশিয়ান সেনা তাদের ধাওয়া করছিল। এদিকে নভেম্বর মাসে চারদিকে তীব্র তুষারপাত শুরু হয়ে গেছে কিন্তু তার মধ্যেই নেপোলিয়নের সেনাবাহিনীকে বাধ্য হয়ে চলতে হচ্ছে।
নেপোলিয়নের সেনার কাছে ঠান্ডার পোষাক ছিলনা, বরফে চলার মতোন জুতোও ছিলনা। যার ফলে আরও লোক মারা যাচ্ছিল। তার উপর কিছু বিচ্ছিন রাশিয়ান দুষ্কৃতি সেনাবাহিনীর উপর ঝটিকা আক্রমন করছিল। ঠান্ডা ও খাদ্যের অভাব এমন দাঁড়ায় যে মরে যাওয়া সেনাদেরই খেতে শুরু করে বাকী সেনাবাহিনী এবং ঘোড়া গুলোকে মেরে ফেলে তাদের মাংস খাওয়ার পাশাপাশি ঘোড়ার চামড়া গায়ে জড়িয়ে নেওয়া হয়। এরকম অবস্থায় নভেম্বরের শেষে বেরেজোনা নদীর তীরে এসে পৌঁছায় গ্র্যান্ড সেনা। বরফ গলা নদী পেরোতো গিয়ে ঠান্ডায় এবং নদী থেকে ওঠার পর তীব্র ঠান্ডায় আরও কিছু সেনা মারা যায়। এদিকে নেপোলিয়ন খবর পায় প্যারিসে তার অনুপস্থিততে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র চলছে। বাধ্য হয়ে নেপোলিয়ন ৫ ডিসেম্বর অন্য একজনকে সেনার দায়িত্ব দিয়ে বেশ কিছু অনুচর নিয়ে প্যারিসের দিকে রওনা দেয় নেপোলিয়ন। তার বাকী সেনাবাহিনী দশদিন পর প্যারিস পৌঁছায়। নেপোলিয়ন সাড়ে চার লাখের বিশাল সেনা নিয়ে রাশিয়া গিয়েছিল কিন্তু তার নয় ভাগ সেনাই রাশিয়ায় সেরকম কোন যুদ্ধ ছাড়াই খাদ্যাভাবে ও তীব্র ঠান্ডায় মারা যায়৷ মাত্র ৪৫,০০০ থেকেও কম সেনা ফিরে এসেছিল। এরপরের বছর ১৮১৩ সালের ১৬ অক্টোবর লিপজিগের যুদ্ধে নেপোলিয়ন পরাজিত হয়। এর দুইবছর পর ১৮১৫ সালের ১৮ জুন ওয়াটারলুর যুদ্ধেও নেপোলিয়ন পরাজিত হয় যার পর জেলেই তার মৃত্যু হয়। এত বড় জেনারেল নেপোলিয়ন শুধুমাত্র রাশিয়ার তীব্র ঠান্ডায় বাধ্য হয় হার মানতে যা শেষপর্যন্ত তার পতন ঘটায়।