হিটলারকে বোকা বানিয়েছিল যে গোয়েন্দা
শুধু অস্ত্রের মাধ্যমেই যুদ্ধ জেতা সম্ভব না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে যুদ্ধে ইনটেলিজেন্স সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, যার কারনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সমস্ত শক্তিশালী দেশগুলো তাদের ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরি করতে বিশেষ অর্থ ব্যয় করে। ইনটেলিজেন্স সংস্থা গুলোতে এমন অনেক ব্যাক্তি আছে যারা নিজের দেশের পাশাপাশি একই সাথে অন্যান্য দেশের হয়েও কাজ করে এদের ডবল এজেন্ট বলা হয়৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এমনই এক ডবল এজেন্ট ছিল স্পেনের যে স্পেনের পাশাপাশি জার্মানির হয়েও কাজ করে উভয় দেশ থেকেই সর্বোচ্চ সম্মান পেয়েছিল৷ জুয়ান পুয়োল গার্সিয়া নামে এই ব্যাক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী শাসক অ্যাডলফ হিটলারকেও বোকা বানিয়েছিল। জুয়ান জার্মনিকে এটা বলেছিল যে সে ২৭ জন গুপ্তচর নিয়োগ করেছে যারা জার্মানির হয়ে কাজ করছে। এই পুরো ঘটনা একটি মিথ্যা ছিল। এর বিনিময়ে পুয়োল জার্মানির থেকে প্রচুর অর্থ পেয়েছিল। বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পেছনেও এই ডবল এজেন্ট জুয়ান পুয়োল গার্সিয়ার ভূমিকা রয়েছে।
জুয়ান পুয়োল গার্সিয়ার জন্ম হয়েছিল স্পেনের বার্সেলোনা শহরে। তার বাবা তুলোর কারখানার মালিক ছিল এবং সেক্যুলার চিন্তাধারার মানুষ ছিল। তার মা একজন রোমান ক্যাথলিক ছিল। ১৩ বছর বয়সে জুয়ানকে বার্সেলোনার একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু তিন বছরের মধ্যে শিক্ষকের সাথে ঝামেলার কারনে জুয়ান স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং একাধিক ব্যবসা শুরু করে। ১৯৩১ সালে তার বাবার মৃত্যু হয়। বাবা মারা গেলেও জুয়ানের জন্য তার বাবা যথেষ্ট অর্থ রেখে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় তাদের তুলো কারখানা কেড়ে নেয় মানুষ।
১৯৩১ সালে তৎকালীন স্পেনের নিয়ম অনুযায়ী জুয়ান স্পেনের সেনাবাহিনীর সপ্তম ইউনিট লাইন আর্টিলারি রেজিমেন্টে ছয় মাসের জন্য কাজ করে। তবে সেনাবাহিনীর নিয়ম, ঘোড়ায় চড়া কোনটাই তার পচ্ছন্দ না হওয়ায় সেনাবাহিনী থেকে বেড়িয়ে নিজের ব্যবসা শুরু করে জুয়ান। কিন্তু ১৯৪০ সাল থেকে তার জীবন অন্যদিকে মোড় নেয়। সেই বছর ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স সংস্থার হয়ে কাজ করবার ইছা প্রকাশ করে। সেসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল যার কারনে প্রত্যেক দেশেরই সেনা ও এজেন্টের দরকার ছিল৷ কিন্তু জুয়ান গার্সিয়ার কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স সংস্থা তার আবদেন নাকচ করে দেয়। এরপর আরও তিনবার ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স সংস্থার কাছে আবেদন করে জুয়ান কিন্তু প্রতিবারেই তাকে ব্যার্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়। বাধ্য হয়ে একটি হোটেলে কাজ শুরু করে জুয়ান। কাকতালীয় ভাবে একদিন সেই হোটেলে উপস্থিত হয় স্পেনের রাজবংশের কিছু সদস্য। সেসময় স্পেনে গৃহযুদ্ধ চলছিল, ফলে স্পেনের অবস্থা খুব খারাপ ছিল। রাজবংশের সদস্যরা হোটেলে একটি বিশেষ ব্র্যান্ডের ছয়টি স্কচের বোতল অর্ডার করে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সেই বিশেষ ব্রান্ড পাওয়া যায়নি। এই খবর জানার পরে জুয়ান গার্সিয়া সেই বিশেষ ব্র্যান্ডের ছয়টি স্কচের বোতল সেই রাজপরিবারের কাছে নিয়ে যায়। এর বদলে জুয়ান সেই রাজপরিবারের কাছে নিজের পাসপোর্টের দাবি করে। পাসপোর্ট পাওয়ার পরেই জুয়ান নকল ব্রিটিশ এক্সিট ভিসা জোগার করে। জুয়ান এটা বুঝে যায় যে ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স সংস্থার হয়ে তার কাজ করা সম্ভব নয় তাই সে স্পেন ফিরে যায়। স্পেনে সেসময় জার্মানদের প্রভাব ছিল। একদিন স্পেনে একটি ট্রেনে ভ্রমনকালে জুয়ান জানতে পারে সেই ট্রেনে অ্যাডলফ হিটলারের খুব বিশ্বস্ত এক নাজি অফিসার রয়েছে। সাথে সাথে জুয়ান সেই অফিসারের কাছে গিয়ে হিটলার ও জার্মানির প্রশংসা করে ভাব জানায়। জুয়ান সেই অফিসারকে আরও জানায় ব্রিটেনে তার যাওয়া আসা আছে এবং সেখানে তার নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা সম্পূর্ন মিথ্যা। সেই নাজি অফিসার জুয়ানের কথায় বিশ্বাস করে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে জার্মান গুপ্তচর হিসাবে জুয়ানকে নিয়োগ করে। অবশেষে জুয়ানের গুপ্তচর হবার স্বপ্ন পূরন হয়।
জার্মান ইনটেলিজেন্স সংস্থা জুয়ান পুয়োল গার্সিয়ার কোড নেম অ্যালেরেক রাখে। মাদ্রিদে এক জার্মান এজেন্ট ফ্রেডরিচ তাকে গুপ্তচরবৃত্তির প্রশিক্ষন দেয়, কিভাবে সাংকেতিক চিঠি লেখা যায়, অদৃশ্য কালি ও অর্থও তাকে দেওয়া হয়। এরপর জুয়ান গার্সিয়াকে নির্দেশ দেওয়া হয় ব্রিটেন চলে যেতে। কিন্তু জুয়ান গার্সিয়া ব্রিটেন না গিয়ে পর্তুগালের লিসবন চলে যায় নিজের স্ত্রীকে নিয়ে। আসলে জুয়ান জার্মানদের সম্পর্কে তেমন কোন চিন্তাই ছিলনা তার দরকার ছিল অর্থ। জুয়ান লিসবনের গ্রন্থাগারে গিয়ে ব্রিটেন সম্পর্কিত তথ্য জোগার করত এবং খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন থেকে গুরুত্বপূর্ন তথ্য নিয়ে জার্মানদের পাঠাত। জার্মান ইনটেলিজেন্স বিভাগ ভাবতো জুয়ান হয়ত সত্যিই ইংল্যান্ডে রয়েছে। একদিন জুয়ান জার্মানিকে জানায় অ্যালায়েড ফোর্সের একটি জাহাজ মাল্টা রওনা হবে, ঠিক তাই হয়। এই ঘটনায় জার্মানদের জুয়ানের উপর বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। আসলে জুয়ান এসব তথ্য খবরের কাগজ থেকে জোগাড় করতো। এরপর জুয়ান জার্মান ইনটেলিজেন্স বিভাগকে জানায় তার আরও অর্থ লাগবে কারন সে আরও ২৭ জন নতুন এজেন্টকে নিয়োগ করেছে। জুয়ান এটাও জানায় ব্রিটিশ সংসদেও তার এজেন্ট আছে। জার্মানরা খুব সহজে জুয়ানকে বিশ্বাস করে নেয় এবং তাকে মোটা অর্থ দেয়। এদিকে ব্রিটেনের এমআই ফাইভ এবং এমআউ সিক্স দুটি সংস্থা ব্রিটেন ও তার বন্ধু দেশ গুলোর বিরুদ্ধে কাজ করা এজেন্টদের খুঁজছিল। তারা ১৯৪২ সালের ২৪ এপ্রিল জুয়ানকে গ্রেফতার করে।
ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্সকে জুয়ান জানায় তাকে তিনবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং জুয়ান ব্রিটেনকে ২৭ জন মিথ্যা এজেন্ট নিয়োগের ঘটনাও জানায়। এবার ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স বিভাগ সরাসরি জুয়ানের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স সরাসরি জুয়ান গার্সিয়াকে ডবল এজেন্ট হবার প্রস্তাব দেয় এবং জুয়ানের পরিবারকে লন্ডনে আনা হয়। জুয়ান গার্সিয়ার নতুন সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় গার্বো।
জুয়ান গার্সিয়া আগের মতোই জার্মানিকে তথ্য পাঠাতে থাকে তবে এবারে জুয়ানকে সমস্ত তথ্য সরবরাহ করতে থাকে এমআই ফাইভ। ২৭ জন এজেন্টের নাম থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে অন্তত ৩১৫ টি চিঠি পাঠায় জুয়ান জার্মান ইনটেলিজেন্সকে। এতে জার্মানির জুয়ান গার্সিয়ার উপর বিশ্বাস আরও মজবুত হয়। নভেম্বর, ১৯৪২ জার্মানিকে জুয়ান একটি চিঠি পাঠায় যাতে বলা হয় অ্যালায়েড ফোর্স অপারেশন টর্চের মাধ্যমে উত্তর আফ্রিকা অভিযান করবে। ইচ্ছে করে এই চিঠি অপারেশন হবার পর পাঠানো হয় কিন্তু চিঠিতে তারিখ লেখা ছিল অপারেশন হবার তিন সপ্তাহ আগের। জুয়ান একবার তার এক মিথ্যে এজেন্টের নকল মৃত্যুর খবরও পাঠায় যা দেখে জার্মানি সেই এজেন্টের স্ত্রীকে অর্থও পাঠায় যা আদতে আসে জুয়ানের কাছেই। ১৯৪৪ সালের ৬ জুন অ্যালয়েড ফোর্সের আক্রমনের গতিবিধি সম্পর্কে জুয়ান গার্সিয়া জার্মান ইনটেলিজেন্স সংস্থাকে জানাবে বলে। যদিও জুয়ান ভুল তথ্য দিত কিন্তু সেদিন জুয়ানের ভাগ্য এতটা সুপ্রসন্ন ছিল যে ৬ জুন ভোর তিনটে থেকে আটটা অবধি জুয়ান গার্সিয়া যখন রেডিওর মাধ্যমে খবর দেবার চেষ্টা করে তখন বিপরীত দিকে জার্মান রেডিও অপারেটর ঘুমিয়ে পড়েছিল ফলে জুয়ানকে কিছু মিথ্যা বলতেই হয়নি উপরন্তু জুয়ানকে আরও বিশ্বাস করা শুরু করে জার্মানি। এরপরে জুয়ান গার্সিয়া একদিন জানায় অ্যালায়েড ফোর্স ক্যেলে শহর হয়ে আক্রমন করবে ফ্রান্সে।
হিটলার জার্মান সেনাবাহিনীকে অ্যালয়েড ফোর্সের গতিবিধির উপর নজর রাখতে বলে। জার্মান ইনটেলিজেন্স বিভাগ জানায় ক্যেলে শহরের বাইরে অ্যালায়েড ফোর্সের বিশাল সেনা, ট্যাঙ্ক রয়েছে। এই খবরে হিটলার এতটাই আনন্দিত হয়ে পড়ে যে হিটলার জুয়ান গার্সিয়াকে জার্মানির সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান আয়রন ক্রস দেয়। প্রায় দেড় লাখ জার্মান সেনা ক্যেলে শহরের মধ্যে অপেক্ষা করতে শুরু করে। প্রায় কয়েক সপ্তাহ পরেও অ্যালয়েড ফোর্স না আসায় জার্মান ইনটেলিজেন্সের সন্দেহ হয় এবং তারা পুনরায় নজর রেখে বুঝতে পারে অ্যালায়েড ফোর্স অন্যদিক দিয়ে শহরে প্রবেশ করে বিশাল অংশ দখল করে নিয়েছে। ক্যেলে শহরের বাইরে যে বিশাল সংখ্যা অ্যালায়েড ফোর্সের সেনা ও ট্যাঙ্ক ছিল সেগুলো আসলে নকল ছিল যা জার্মানদের নজর ঘোরানোর জন্য রাখা হয়েছিল। সাথে সাথে জার্মানি বুঝতে পেরে যায় এর পেছনে রয়েছে জুয়ান গার্সিয়া কিন্তু ততক্ষনে তাদের আর কিছু করার ছিলনা। এই হারের পর থেকে আর জার্মানি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর এক বছরের মধ্যে জার্মানি ইউরোপে কোনঠাসা হয়ে পড়ে এবং অ্যাডলফ হিটলার আত্মহত্যা করে জার্মানির পরাজয় নিশ্চিত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জুয়ান গার্সিয়া গুপ্তচরবৃত্তির কাজ ছেড়ে দেয়, ব্রিটেন তাকে বিশেষ সম্মান দিয়েছিল। জুয়ান সবসময় ভয়ে থাকত হয়ত কখনও নাজিরা তাকে ধরে ফেলবে। ১৯৪৯ সালে ম্যালেরিয়া রোগে জুয়ান গার্সিয়ার মৃত্যু হয়। তবে ১৯৭১ সালে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ রুপার্ট এলসন গার্বোর ব্যাপারে নতুন করে অনুসন্ধান শুরু করে। কারন তিনি বিশ্বাস করতেন গার্বো মারা যায়নি। অবশেষে ১৯৮৪ সালের ২০ মে নিউ ওরিলন্স শহরে গার্বো ওরফে জুয়ান পুয়োল গার্সিয়াকে খুঁজে বের করে রুপার্ট এলসন। পুয়োল গার্সিয়া মারা যায়নি আসলে ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স বিভাগ জুয়ানকে নাজিদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তার মৃত্যুর খবর রটিয়ে দেয়। রুপার্ট এলসনের অনুরোধে জুয়ান গার্সিয়া লন্ডনে আসেন। সেখানে বার্কিংহাম প্যালেসে প্রিন্স ফিলিপ জুয়ান গার্সিয়াকে সম্মানিত করেন। অবশেষে ১৯৮৮ সালে ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডবল এজেন্ট জুয়ান গার্সিয়া শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।