ফিচার আর্টিকেল

উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতারা কেন ট্রেনেই বিদেশ সফর করে?

সময়টা ২০০৪ সাল, চীনের সীমান্তের কাছে উত্তর কোরিয়ার রিয়ংচন স্টেশনে এক বিশাল বিস্ফোরন হয়। এই বিস্ফোরনে ১৬০ জন লোকের মৃত্যু হয় এবং ১৩০০ লোক আহত হয়। কিন্তু এই বিস্ফোরনের লক্ষ্য এসব মানুষ ছিলনা ছিল একটি ট্রেন যার নাম তাইয়াংহো। উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে রহস্যময় ট্রেন এই তাইয়াংহো সবসময় বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ান কম্যান্ডো ফোর্স থাকে, তাছাড়া বুলেটপ্রুফ এই ট্রেনটিতে মেশিনগান, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, অ্যান্টি ট্যাঙ্ক মিসাইল সহ একাধিক ভারী অস্ত্র থাকে। ট্রেনটিকে অনুসরন করে উত্তর কোরিয়ান সেনাবাহিনীর গাড়ির একটি বড় বহর। এমনকী ট্রেনটি যে লাইনে যায় সেই লাইনে তাইয়াংহোর আগে আরেকটি শক্তিশালী বুলেটপ্রুফ ট্রেন এবং তাইয়াংহোর পিছনেও একটি সেনাবাহিনীর ট্রেন চলাচল করে। ট্রেনটির মেঝে পর্যন্ত বিস্ফোরন প্রতিরোধী। ট্রেনটি তার গন্তব্যে যাওয়ার সময় সবসময় কিছু কমব্যাট হেলিকপ্টার ট্রেনটিকে অনুসরন করে। এই বিশেষ রহস্যময় ট্রেনটি ব্যবহার করে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা। উত্তর কোরিয়া বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানকার সর্বোচ্চ নেতা বিমানের বদলে ট্রেন ব্যবহার করে একদেশ থেকে অন্যদেশে যেতে। 

গোটা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন উত্তর কোরিয়া এমন একটি দেশ যার সম্পর্কে তথ্য তেমন কিছুই পাওয়া যায়না। স্বৈরাচারী শাসক কিম জং উনের দ্বারা শাসিত দেশটির সাথে একমাত্র চীন ও রাশিয়ার সুসম্পর্ক রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার সমস্ত সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বেশ কিছু বিশেষ রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে যেগুলো সাধারন নাগরিকদের ব্যবহারের জন্য নয়, এইসব স্টেশন শুধুমাত্র তাইয়াংহো ট্রেনের জন্য তৈরি করা হয়েছে। ট্রেনটিতে সমস্তরকম সুযোগ সুবিধা রয়েছে যার মাধ্যমে কিম জং উন ট্রেনে থেকেও দেশ চালাতে পারে। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং উন তেয়াংহো ট্রেনে করে রাজধানী পিয়ংইয়ং থেকে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা হয় রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে বৈঠকের জন্য। পিয়ংইয়ং থেকে মস্কো পর্যন্ত ১০০০ কিলোমিটার যেতে ট্রেনটির সময় লাগে দুই দিন। মাত্র ১০০০ কিলোমিটারের পথ অতিক্রম করতে দুই দিন অনেক বেশী সময় মনে হলেও আদতে পিয়ংইয়ং থেকে মস্কো যাওয়া এটা কোনও সাধারন ট্রেনের সফর নয়। শক্তিশালী কবচ ও ভারী অস্ত্রশস্ত্র থাকার কারনে তাইয়াংহো ট্রেনের গতিবেগ অনেকটাই কম হয়ে যায়। তাছাড়া কিম জং উনের বিরুদ্ধে আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলোর ইনটেলিজেন্স সংস্থাগুলির নজর রয়েছে। সেজন্য পিয়ংইয়ং থেকে মস্কো পর্যন্ত দীর্ঘ পথে অসংখ্য জঙ্গল এলাকা সহ সম্পূর্ন পথে বিশেষ নজরদারি করে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী সহ ইনটেলিজেন্স বিভাগ যার জন্য ট্রেনের গতি আরও কমে যায়। উত্তর কোরিয়ার রেলওয়ে পরিকাঠামো নিম্নমানের এসব কারনে তাইয়াংহো ট্রেনের গড় গতিবেগ ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার হয়ে যায়। তেয়াংহোর আগে যে ট্রেন থাকে সেই ট্রেনটি রেললাইনে থাকা সম্ভাব্য বিস্ফোরক কিংবা কিম জং উনের বিরুদ্ধে হতে চলা সম্ভাব্য আক্রমনকে প্রতিহত করে। তাইয়াংহো কোনও একটি নির্দিষ্ট ট্রেনের নাম নয়, কিম জং উনের জন্য এরকম বেশ কয়েকটি তাইয়াংহো ট্রেন রয়েছে। তিনি কোন ট্রেনে যাতায়াত করবেন সেটা অত্যন্ত গোপনীয় থাকে। 

উত্তর কোরিয়াতে তাইয়াংহো শব্দের অর্থ সূর্য। একটি তাইয়াংহো ট্রেনে কুড়িটি বিশেষ কামরা থাকে এবং ট্রেনটির মোট দৈর্ঘ্য হয় ৫৭৬ মিটার। নিরাপত্তাজনিত কারনে এই ট্রেনটি উত্তর কোরিয়াতেই তৈরি করা হয়। ট্রেনটি সম্পূর্নরূপে হেভি মেশিনগানের গুলি ও বিস্ফোরন প্রতিরোধ করতে সক্ষম। কিন্তু তারপরেও কিম জং উন তার নিরাপত্তা নিয়ে এতটাই চিন্তিত যে তাইয়াংহো দুটি মেশিনগান, সারফেস টু এয়ার মিসাইল এবং অ্যান্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল সহ ভারী অস্ত্র রয়েছে। ট্রেনটিতে এমন কিছু কামরা আছে যেগুলি শুধু মাত্র কিম জং উনই ব্যবহার করে। ট্রেনটিতে দুটি বিশেষ বুলেটপ্রুফ মার্সেডিজ গাড়ি রয়েছে কিমের ব্যবহারের জন্য। তাছাড়া জরুরী অবস্থার জন্য আমেরিকার তৈরি দুটি এমডি ৫০০ সি হেলিকপ্টারও আছে। উত্তর কোরিয়ার সাথে রাশিয়া ও চীন ছাড়া কোনও দেশেরই বানিজ্যিক সম্পর্ক নেই। আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলো কোনও বিলাসবহুল দ্রব্যই উত্তর কোরিয়াকে বিক্রি করেনা তাও কিম জং উন পশ্চিমা বিলাস বহুল জিনিস ঘুরপথে কিনে আনায় দেশে। এই জন্য তাইয়াংহো বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ ট্রেন বলা হয়। এই ট্রেনটি যেই স্টেশন দিয়ে যায় সেখানকার আশপাশের বিদ্যুৎ পরিবহন ব্যবস্থা সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

 ২০২০ সালে অনলাইনে এই ট্রেনটির ভিতরের একটি ভিডিও সামনে এসেছিল যাতে দেখা যায় ট্রেনটির ভিতরে অধিকাংশ এলাকা সাদা রঙের, ট্রেনটিতে রকমারী ফুল সহ জেব্রা রঙের কাঠের আসবাবপত্র রয়েছে। পিয়ংইয়ং থেকে মস্কো বিমানে যেতে যেখানে দুই ঘন্টা সময় লাগে সেখানে এইপথ ট্রেনের মাধ্যমে যায় কিম জং উন এটা বড়ই আশ্চর্যজনক হলেও এটা সত্যি যে উত্তর কোরিয়ার ইতিহাসে ট্রেন পরিবহন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ। শুধু কিম জং উন নয় উত্তর কোরিয়ার ইতিহাসে প্রায় সমস্ত নেতাই ট্রেনেই যাতায়াত করতো। উত্তর কোরিয়ার প্রথম সর্বোচ্চ নেতা কিম ইল সুং গোটা দেশে ব্যাক্তিগত রেলওয়ে স্টেশন তৈরি করিয়েছিল যেখানে শুধু তার ট্রেনই যেত। ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার শাসক থাকাকালীন কিম জং ইল বা বর্তমান শাসক কিম জং উনের বাবাও ট্রেনে যাতায়াত করতো কারন তার বিমানে যাতায়াত করতে ভয় লাগতো। ২০১১ সালে উত্তর কোরিয়ারই বিভিন্ন অঞ্চলে সফরকালে ট্রেনেই মৃত্যু হয় তার। কিম জং ইলের মৃতদেহ ও ওই ট্রেনের কামরা আজও উত্তর কোরিয়াতে সংরক্ষন করে রাখা আছে। তাইয়াংহো ট্রেনের আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল যে এটি কখন কোনপথে যাবে তা একমাত্র উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা কর্মীরা ছাড়া কেউ জানেনা। ২০০৪ সালে চীন সীমান্তের কাছে উত্তর কোরিয়ার রিয়ংচন স্টেশনে যে বিশাল বিস্ফোরন ঘটেছিল তার লক্ষ্য ছিল কিম জং ইল, কারন কয়েক ঘন্টা আগেই তার ট্রেন ওই স্টেশন দিয়ে গিয়েছিল। তারপর থেকেই তাইয়াংহো ট্রেনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী করা হয়। 

উত্তর কোরিয়াতে এই ট্রেনের ছবি তোলাও নিষেধ। এমনকী আন্তর্জাতিক স্তরেও এই নিয়ম মানা হয়। ২০০৯ সালে কিম জং ইল যখন রাশিয়া গিয়েছিল তখন রাশিয়ান সরকার সাইবেরিয়া অঞ্চলে লোকেদের ঘর থেকে বেরোতেই নিষেধ করেছিল যতক্ষননা এই ট্রেন অতিক্রম করে সেখান দিয়ে। এই জন্য উত্তর কোরিয়ার কিম পরিবারের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত এই ট্রেন। ১৯৮৪ সালে কিম ইল সুং পূর্ব ইউরোপের প্রায় সমস্ত কমিউনিস্ট দেশে যাতায়াত করেছিল এই তাইয়াংহো ট্রেনের মাধ্যমে। উত্তর কোরিয়া থেকে শুরু হয়ে এই সফর চীন হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, পূর্ব জার্মানি, চেকস্লাভিয়া, হাঙ্গেরি, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া এবং রোমানিয়া পর্যন্ত ছিল। সেসময় ইউরোপ ও উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক এতটা খারাপ ছিলনা। কিন্তু কিম জং ইলের শাসনকাল থেকেই উত্তর কোরিয়ার সাথে আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক খারাপ হওয়া শুরু হয়। কিম জং উনের সময়ে একের পর এক পরমানু অস্ত্রের পরীক্ষা উত্তর কোরিয়াকে বিশ্বে এক ঘরে করে দিয়েছে। ২০১১ সালে কিম জং উন উত্তর কোরিয়ার শাসনক্ষমতায় এসে প্রথম ছয় বছর অর্থাৎ ২০১৭ সাল পর্যন্ত কোনও দেশেই যায়নি। ২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কিম জং উন দশটি বিদেশ সফর করেন যার মধ্যে চারবার চীন, দুইবার রাশিয়া, দুইবার দক্ষিন কোরিয়া এবং একবার করে সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামে গিয়েছিলেন। এই সমস্ত সফরের মধ্যে সাতবার তিনি ট্রেনেই গিয়েছিলেন এবং বাকী তিনটি সফর চীনের দ্বারা ব্যবস্থা করা বিশেষ বিমানে গিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কিম জং উনের সবচেয়ে বিশেষ আন্তর্জাতিক সফর ছিল জুন, ২০১৮ সালের সিঙ্গাপুর সফর। চীনের এয়ার চায়নার ৭৪৭ বিমানে কিম জং উন সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। এই সফরে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে কিম জং উনের বৈঠক হয়। গোটা বিশ্বের নজর ছিল এই ঐতিহাসিক বৈঠকের উপরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *