ভারতবর্ষের অন্যতম ভয়ঙ্কর পৃথ্বী মিসাইল রেঞ্জ এবং ওজন জানা আছে?
ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু দুটি দেশ হচ্ছে পাকিস্তান ও চীন। ইতিহাস সাক্ষী আছে যতবারই ভারত এই দুই দেশের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ততবারই এই দেশ দুটি ছল করে ভারতের ক্ষতি করবার চেষ্টা করেছে। ১৯৬২ সালের আগে কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি চীন ও ভারতের যুদ্ধ হবে। ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯ এ সরাসরি ভারতের সাথে যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হবার পরও দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রধান হাতিয়ার সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ইন্ডিয়ান মুজাহদ্দিন, লস্কর ই তৈবার মতোন কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন পাকিস্তান তৈরি করেছে, যাদের রীতিমতো সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষন দিয়ে ভারতে শান্তিভঙ্গ করতে পাঠানো হয়। পাকিস্তানকে এসব ব্যাপারে অর্থ সাহায্য করে চীন। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও ইনটেলিজেন্সের কারনে বারবার পাকিস্তান ও চীনের পরিকল্পনা ব্যার্থ হয়। পাকিস্তান ও চীনের বিরুদ্ধে নিজেদের আরও শক্তিশালী করতে ভারত তার তিন বাহিনীকে যথেষ্ট শক্তিশালী করছে। বর্তমানে ভারত সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ। ভারতের কাছে অত্যাধুনিক রকেট লঞ্চার থেকে শুরু করে, ক্রুজ মিসাইল, ব্যালিস্টিক মিসাইল, আধুনিক যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার সহ নিউক্লিয়ার মিসাইল মজুত আছে। বিশেষ করে ভারতের মিসাইল ভান্ডার সবচেয়ে সমৃদ্ধ, এর মধ্যে বিভিন্ন পাল্লার অত্যাধুনিক মিসাইল রয়েছে যার মধ্যে স্বল্প দূরত্ব থেকে শুরু করে দীর্ঘ দূরত্বের ব্যালেস্টিক, ক্রুজ, রেডার ধ্বংসকারী ও এয়ারডিফেন্স মিসাইল রয়েছে। এদের মধ্যে পৃথ্বী মিসাইল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিসাইল। পৃথ্বী মিসাইল এবং তার প্রকারভেদ ও ভারতের মিসাইল তৈরির যাত্রা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
একটা সময় বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কোনদিন সূর্যাস্ত হয়না। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে হতে ব্রিটিশদের সেই গর্ব ভেঙে যায় কারন যুদ্ধের কারনে ব্রিটেন সহ গোটা ইউরোপের অর্থনৈতিক কাঠামো পুরো ভেঙে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে দুটি সুপার পাওয়ারের উদয় হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধের অধ্যায়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর ঠান্ডা যুদ্ধ শেষ হয় এবং শুধু আমেরিকা বিশ্বের একমাত্র সুপার পাওয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু বিশ্ব জুড়ে আরও বেশ কয়েকটি দেশ নিজেদের সামরিক ক্ষমতা বাড়িয়ে নেয় এই সময়। যার মধ্যে ভারত অন্যতম। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে ভারত এইসময় শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ১৯৭৪ এবং ১৯৯৪ সালে ভারত দুবার পরমানু বোম্ব পরীক্ষা করে বিশ্বের সামনে পরমানু শক্তিশালী দেশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।
বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ হিসাবে ভারতের কাছে ত্রিশূল, অগ্নি, ব্রাহ্মস, প্রলয়, পৃথ্বী, নাগ সহ একাধিক মিসাইলের সম্ভার রয়েছে যা শত্রুর রাতের ঘুম উড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট। এদের মধ্যে অগ্নি-৫ মিসাইল প্রায় গোটা চীনকেই তার রেঞ্জের মধ্যে এনে ফেলেছে। পৃথ্বী মিসাইলের তিনটি ভার্সন রয়েছে যার প্রতিটি ভার্সনেরই আলাদা আলাদা ক্ষমতা রয়েছে। মিসাইল টেকনোলজিতে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য ভারত সরকার ১৯৮৩ সালে আইজিএমডিপি বা ইন্ট্রিগেটেড গাইডেড মিসাইল ডেভেলপমেন্ট পোগ্রাম শুরু করে। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও মিসাইল ম্যান বিখ্যাত ডঃ এপিজে আব্দুল কালাম ছিলেন এই প্রজেক্টের প্রধান। এই প্রজেক্টে তৈরি হওয়া প্রথম মিসাইলের নামই পৃথ্বী। ডিআরডিও পৃথ্বী মিসাইলের তিনটি ভার্সন পৃথ্বী ১, পৃথ্বী ২ ও পৃথ্বী ৩ তৈরি করেছে যাতে ভারতীয় সেনাবাহিনী, বায়ুসেনা ও নৌসেনা এই মিসাইল ব্যবহার করতে পারে।
পৃথ্বী ১:— এই মিসাইল তৈরি করা হয়েছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য তবে বর্তমানে এটিকে অবসরে পাঠানো হয়েছে। ১৯৯৪ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এটি প্রথম যুক্ত করা হয়েছিল। ৪.৫ টন ওজনের এই মিসাইলটি ১ টন ওজনের বোম্ব বহনে সক্ষম ছিল। ভূমি থেকে ভূমিতে আক্রমনে সক্ষম এই মিসাইলটির রেঞ্জ ছিল ১৫০ কিলোমিটার। কম রেঞ্জের কারনেই এটিকে বর্তমানে অবসরে পাঠানো হয়েছে।
পৃথ্বী ২:— এই ব্যালেস্টিক মিসাইলটিকে তৈরি করা হয়েছে বায়ুসেনার জন্য। এটি যেকোনও অ্যান্টি ব্যালেস্টিক মিসাইলকে ফাঁকি দিতে সক্ষম। এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৩৫০ কিলোমিটার। ১৯৯৬ সালের ২৭ জানুয়ারি এর প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছিল। ২০০৩ সালে এই মিসাইল স্ট্রাটেজিক ফোর্স কম্যান্ডের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বায়ুসেনার জন্য এটি বিশেষভাবে তৈরি করা হলেও নৌসেনাতেও এটি পরে যুক্ত করা হয়। ৪৬০০ কিলোগ্রাম ওজনের এই মিসাইলটি ৫০০ কেজি পেলোড বহনে সক্ষমে। আইজিএমডিপি প্রোজেক্টে তৈরি এটিই প্রথম কোন মিসাইল যাতে ১০০ শতাংশ ভারতীয় টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে। দিন ও রাত, উভয় সময়েই ব্যবহার যোগ্য এই মিসাইলের আওতায় অর্ধেক পাকিস্তান রয়েছে।
পৃথ্বী ৩ :— পৃথ্বী সিরিজের সর্বাধুনিক এই মিসাইলের রেঞ্জ ৬০০ কিলোমিটার। এটি এক টন ওজনের পেলোড বহনে সক্ষম। পৃথ্বী ৩ কে যুদ্ধবিমান থেকেও লঞ্চ করা সম্ভব। এই মিসাইলটি নৌবাহিনীর জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে। আইএনএস সুভদ্রা থেকে ২০০০ সালে প্রথম এর পরীক্ষা হয়েছিল। ভারতের অন্যান্য সব মিসাইলের মতোন এটিও দিন রাত উভয় সময়েই ব্যবহারযোগ্য।
ধানুশ:— পৃথ্বী ৩ মিসাইলেরই একটি ভার্সন হল ধানুশ মিসাইল। এটিও ভারতীয় নেভি ব্যাবহার করে। এই মিসাইলটির সর্বোচ্চ রেঞ্জ ৩৫০ কিলোমিটার। এই মিসাইলটি সাধারন বোম্বের পাশাপাশি পরমানু বোম্ব বহন করেও আক্রমনে সক্ষম। শত্রুর বন্দর সহ এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে সক্ষম এই মিসাইলটি। অ্যান্টিশিপ মিসাইল হিসাবে ধানুশ মিসাইল ভূমিতে থাকা টার্গেটকেও ধ্বংস করতে সক্ষম।
ভারতের দুই প্রতিবেশী ও সবচেয়ে বড় শত্রু চীন ও পাকিস্তান উভয়েই পরমানু শক্তিশালী দেশ সেজন্য ভারতও বাধ্য হয়েছে তার পারমানবিক সক্ষমতা বাড়াতে।
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারত মহাকাশ ও পরমানু বিজ্ঞানে বিশেষ জোর দিয়েছিল। ১৯৫৬ সালে হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার নেতৃত্বে ভারতে প্রথম পরমানু চুল্লী তৈরি হয়েছিল। ১৯৬২ সালে চীনের সাথে যুদ্ধ এবং ১৯৬৫ ও ১৯৭১ তে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের পর ভারত বুঝতে পেরেছিল শান্তি রক্ষা করতে হলে নিজেদের আরও শক্তিশালী হতে হবে। সেজন্য সেইসময় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বে আইজিএমডিপি পোগ্রাম শুরু হয়। ইন্দিরা গান্ধি এর জন্য ৩০০ কোটি টাকা বাজেট দিয়েছিল। তিনি এপিজে আব্দুল কালামকে বলেছিলেন এমন মিসাইল বানাতে যা চীন পর্যন্ত যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যু হয়। তবে এপিজে আব্দুল কালাম ওনার স্বপ্ন সফল করেছিলেন। তিনি ৫৩০০ কিলোমিটার রেঞ্জের অগ্নি ৫ মিসাইল তৈরি করেছেন। এপিজে আব্দুল কালামের খুব কাছের লেখক ডঃ ভূপেন্দ্র যাদব বলেছেন যখন অগ্নি ৫ এর প্রথম সফল পরীক্ষা হয় তখন এপিজে আব্দুল কালাম বলেছিলেন এসব কিছুর কৃতিত্ব শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির।
১৯৮৮ সালে পৃথ্বী ১ পরীক্ষা করার পর থেকে এখনও পর্যন্ত ভারত আধুনিক মিসাইল তৈরি করেছে। যার মধ্যে রয়েছে শব্দের গতির তুলনায় তিনগুন বেশী গতি সম্পন্ন সুপারসনিক ব্রাহ্মস ক্রুজ মিসাইল। বর্তমানে ডিআরডিও শব্দের গতির তুলনায় ছয়গুন বেশী গতিশীল হাইপারসনিক মিসাইল টেকনোলজি তৈরি করছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ডিআরডিও হাইপারসনিক টেকনোলজি ডেমনস্ট্রেটর পরীক্ষা করেছিল। হাইপারসনিক মিসাইল টেকনোলজি খুবই জটিল প্রযুক্তি, বিশ্বের মাত্র তিনটি দেশ আমেরিকা, রাশিয়া ও চীনের কাছে এই প্রযুক্তি আছে। এবার আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের কাছেও এই প্রযুক্তি চলে আসবে।