ফিচার আর্টিকেল

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ২০ বছরের মধ্যে কিভাবে জার্মানী আবার একটি বিশ্বযুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে গেছিল?

বিগত একশো বছরে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে নৃশংস যুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে মানব সমাজের যা ক্ষতি হয়েছিল তা এর আগে কোনও যুদ্ধে হয়নি। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পঁচিশ বছর আগে আরও একটি মহা বিনাশক যুদ্ধ ঘটে ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল অবধি যাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধে ইউরোপের অন্যতম শক্তিশালী দেশ জার্মানি পরাজিত হয়। 

১৯১৯ সালে ভার্সাইলের চুক্তি হয়, ঠিক এর কুড়ি বছর পর ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও প্রধান শক্তি হিসাবে জার্মানি ইউরোপে আগ্রাসন শুরু করে। ভার্সাইলের চুক্তির জন্য জার্মানিকে প্রায় ২৬৯ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক জরিমানা করা হয়েছিল এবং আরও অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এত মহা বিনাশক ও আর্থিক নিষেধাজ্ঞা কিভাবে জার্মানি মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে আবার একটি মহা যুদ্ধের জন্য প্রস্তত হয়ে গেল তা সত্যিই অবাক করার মতোন। অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে মাত্র দুই দশকের মধ্যে ইউরোপের সুপার পাওয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ ঘটে জার্মানির।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় জার্মানির। প্রথমত যুদ্ধে ব্যাপক ব্যায় তার উপর প্রচুর আর্থিক জরিমানা, সব মিলিয়ে জার্মানি ঋনে ডুবে গিয়েছিল। যার কারনে তৎকালীন জার্মান সরকার প্রচুর নোট ছাপাতে শুরু করে। যখন কোন দেশে তার সম্পদের তুলনায় অতিরিক্ত নোট ছাপা হয় তখন সেই দেশটিতে মারাত্মক মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। ঠিক এটাই হয় জার্মানির সাথে। সেসময় জার্মানির উইমার রিপাবলিক বা জার্মান রিইচের নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায় জার্মান অর্থনীতি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৩ সালে জার্মানিতে ভয়ানক মুদ্রাস্ফীতি ঘটে যার ফলে পুরো জার্মানির অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ে। এক আমেরিকান ডলারের মূল্য সেসময় হয়ে দাঁড়ায় ৪.২ ট্রিলিয়ন জার্মান মার্কস! 

বার্লিনে ১৯২২ সালে একটুকরো পাঁউরুটির দাম ১৬০ মার্কস তা ১৯২৩ সালে হয়ে দাঁড়ায় ২ ট্রিলিয়ন ডলার! জার্মানির অবস্থা বর্তমানে ভেনিজুয়েলার থেকেও খারাপ হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় জার্মানিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে আমেরিকা। চার্লস ডস নামে এক ব্যক্তিকে আমেরিকা জার্মানি পাঠায় ১৯২৪ সালে, যে ব্যক্তি ডস প্ল্যান নামে একটি পরিকল্পনা তৈরি করে যাতে আমেরিকা জার্মানিকে অর্থ দেয় যা দিয়ে জার্মানি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষতিপূরন ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে দেয় সেই অর্থ পরে আমেরিকার কাছেই ফেরত আসে। এভাবে আমেরিকা জার্মানির অর্থনীতি পুনরায় মজবুত করতে সাহায্য করে। 

১৯২৮ সালে জার্মানির উপর ক্ষতিপূরনের হার কিছুটা কমানো হয় যা তাদের অর্থনৈতিক কাঠামো পুনর্গঠনে আরও সাহায্য করে। ডস প্ল্যান জার্মানিতে এতটা সফল হয় যে পরে চার্লস ডসকে আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতি করা হয় এবং তিনি নোবেল পুরস্কারও পান। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বিশেষ করে ১৯২০ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়, প্রচুর শিল্প কারখানা গড়ে ওঠে। কিন্তু ১৯২৯ সালে আমেরিকাতে শুরু হয় গভীর অর্থনৈতিক মন্দা যাকে গ্রেট ডিপ্রেশন বলা হয়। একের পর এক কারখানা বন্ধ হতে শুরু করে আমেরিকায়, মানুষের কাজ চলে যায়, স্টক মার্কেট প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিকাঠামো প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। ইউরোপ থেকে আমেরিকা বহুদূরে অবস্থিত হওয়া সত্বেও গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রভাব ইউরোপেও পড়ে। কারন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের প্রধান অর্থনৈতিক সাথী আমেরিকাই হয়ে ওঠে। আমেরিকার আর্থিক মন্দায় সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয় জার্মানি। কারন জার্মানিকে আর্থিক সহায়তা একমাত্র আমেরিকাই করতো। জার্মানির অবস্থা এতটা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ায় যে দেশটির বেকরত্বের হার ত্রিশ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায় অর্থাৎ দেশটির এক তৃতীয়াংশ জনসংখ্যাই কর্মহীন হয়ে পড়ে। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানির ভেঙে পড়া অর্থনীতি দশ বছরে সবে মজবুত হতে শুরু করেছিল কিন্তু তার মধ্যে আবারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরকম সময় জার্মানির রাজনীতিতে এক ব্যক্তির উদ্ভব হয় যে পরে নিষ্ঠুরতার সব সীমা অতিক্রম করে ফেলে। ব্যক্তিটির নাম অ্যাডলফ হিটলার। জার্মানির ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে হিটলার জার্মান জনগনকে ভুল বোঝাতে শুরু করে। হিটলার জার্মানদের বোঝায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মান সেনা হারেনি, কিছু রাজনৈতিক নেতা চুক্তি করে জার্মানির হার নিশ্চিত করে। হিটলার বলে জার্মানির অর্থনৈতিক দুর্দশার প্রধান কারন ইহুদিরা। কারন ইহুদিরা সেসময় জার্মানদের থেকেও ধনী ছিল। ইহুদিদের ইউরোপে এর আগেও অত্যাচার করা হত কারন ইহুদিরা তাদের অসাধারন বুদ্ধিমত্তায় বড় বড় ব্যাবসায়ী হয়ে উঠত যা দেশগুলোর অন্যান্য জনগোষ্ঠী সহ্য করতে পারত না। হিটলার খুব দক্ষ বক্তা ছিল, ফলে তার কথায় জার্মানিতে ইহুদিদের প্রতি ঘৃনা আরও বৃদ্ধি পায়। এছাড়া হিটলার জার্মান জনগনকে বোঝায় সে যদি ক্ষমতায় আসে চার বছরের মধ্যে বেকরত্ব দূর করে দেবে। ফলে জার্মান জনগন হিটলারকে পূ্র্ন সমর্থন করে। যার কারনে  ১৯৩৩ সালে জার্মানির ক্ষমতায় আসে অ্যাডলফ হিটলার। ক্ষমতায় এসেই হিটলার জার্মানির অর্থনীতি মজবুত করায় জোর দেয়।

হিটলার প্রথমেই পুরো জার্মানি জুড়ে বড় বড় স্থাপত্য, হসপিটাল তৈরি শুরু করে, এতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ১৯৩৬ সালে জার্মানিতে অলিম্পিক হয় যাতে ব্যাপক আয়োজন ও বড় স্টেডিয়ামও করা হয়েছিল। হিটলার জার্মানিতে অটোবান প্রজেক্ট শুরু করে করে যাতে প্রায় বারো হাজার কিলোমিটার লম্বা রাস্তা নির্মান করবার লক্ষ্য নেওয়া হয় এবং এতে প্রচুর গাড়ি চলবে বলে ঠিক করা হয়। যদিও এত লম্বা রাস্তা নির্মান করা সম্ভব হয়না তবে এই প্রকল্পে আশি হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়৷ হিটলার জার্মানদের কর্মসংস্থান দিচ্ছিল কিন্তু তাদের বেতন ছিল খুবই কম যার কারনে অনেকে কাজ করতে চাইত না। 

১৯৩৫ সালে এই কারনে হিটলার একটি আইন তৈরি করে যাতে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী সকল জার্মান পুরুষকে বাধ্যতামূলক ভাবে কাজ করতেই হবে। যারা তারপরেও কাজ করতে চাইত না তাদের নাজি পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করতো। হিটলার শিল্প প্রতিষ্ঠানের উপর জোর দেয়। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি হেরে গেলেও এতে জার্মানিতে তেমন ক্ষতি হয়নি কারন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিল মূলত জার্মানির বাইরে, ফ্রান্স, বেলজিয়াম ও রাশিয়াতে যুদ্ধ হয়েছিল ফলে জার্মানির তেমন কোন ক্ষতি হয়নি। হিটলার ক্ষমতায় আসার কিছু বছরের মধ্যেই ভার্সাইলের চুক্তি বাতিল করে দেয়। এই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানিকে যে ক্ষতিপূরন দিতে হচ্ছিল তা দিতে অস্বীকার করে হিটলার। ভার্সাইলের চুক্তি অনুযায়ী জার্মানিকে সামরিক ভাবে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছিল। এই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি এক লাখের বেশী সেনা রাখতে পারবেনা, বায়ুসেনা গঠন করতে পারেবেনা, সাবমেরিন, ট্যাঙ্ক তৈরি করতে পারবেনা। হিটলার প্রত্যেকটির বিরোধীতা করে ট্যাঙ্ক, সাবমেরিন, যুদ্ধবিমান ব্যাপক আকারে তৈরি করতে শুরু করে এবং জার্মান সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে শুরু করে। যার কারনে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়। হিটলার রীতিমতো আইন তৈরি করেছিল যে ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী জার্মান যুবকদের সেনাতে ভর্তি হতেই হবে। অ্যাডলফ হিটলার সেসময় জার্মানিতে প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করেছিল ঠিকই কিন্তু কাজের পরিস্থিতি এবং বেতন ভাল ছিলনা। নাজি পুলিশের ভয়ে মানুষকে কাজ করতে হত। 

ইহুদিদের প্রতি তীব্র ঘৃনার কারনে ১৯৩৫ সালে হিটলার ইহুদিদের জার্মান নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়, তাদের কাজ থেকে বের করে দেয়, তাদের জায়গায় জার্মানদের কাজে রাখে। হিটলারের ধারনা ছিল একবার সামরিক শক্তিশালী হলেই পাশ্ববর্তী দেশ আক্রমন শুরু করবে এভাবেই জার্মানির অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আবারো মজবুত হবে। ১৯৩৯ সালে অ্যাডলফ হিটলার জার্মান সাম্রাজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করে। এভাবেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পরবর্তী দুই দশকের মধ্যে আরও একটি মহা বিনাশক যুদ্ধের জন্য প্রস্তত হয়ে যায় জার্মানি। প্রথমদিকে জার্মানির একের পর এক জয়ে জার্মান জনগন খুশি ছিল তবে শেষপর্যন্ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতোন জার্মানি পরাজিত হয় আবারও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *