বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়া, চীন, ইরান ও উত্তর কোরিয়ার জোটের উত্থান হওয়ার পথে!
ভূরাজনীতি এতটাই জটিল যে আগে থেকে কিছু অনুমান করা সম্ভব নয়। বিশ্বরাজনীতিতে শক্তিশালী দেশ গুলো তাদের স্বার্থে একইরকম ঘটনার দুইরকম সিদ্ধান্তও নিতে পারে। সম্প্রতি ইতালিতে আর্থিকভাবে শক্তিশালী বিশ্বের প্রথম সাতটি দেশ বা জি৭ সম্মেলন হয়। সেখানে ভারত সহ আরও বেশ কিছু দেশের আমন্ত্রন ছিল। কিন্তু এই জি৭ সম্মেলনের পরেই সুইজারল্যান্ডে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে একটি শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল যাতে ইউক্রেনে রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি উপস্থিত ছিল কিন্তু এই সম্মেলনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কোনও দেশই উপস্থিত ছিলনা যার জন্য এই সম্মেলনে কোনও লাভ হয়নি। এই সম্মেলনে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন গাজাতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনকে রাশিয়ার দেওয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে না করে দেওয়ার কথা জানিয়েছে। অর্থাৎ একদিকে জো বাইডেন আসন্ন নির্বাচনের জন্য গাজাতে যুদ্ধবিরতি চাইছে আবার একইরকম পরিস্থিতির জন্য ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি চাইছেনা। উপরন্তু পশ্চিমা দেশ গুলো ইউক্রেনকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে আক্রমনের অনুমোদন দিয়েছে। ঠিক এই জন্যই রাশিয়া ১৯৬০ এর দশকের পর আবারও আমেরিকার কাছে কিউবাতে কিছু দিন আগে তাদের পরমানু সাবমেরিন, ফ্রিগেট পাঠিয়েছে, রাশিয়া তার যুদ্ধজাহাজ বহরের সাথে ক্যালিবার ক্রুজ মিসাইল, ওনিক্স অ্যান্টিশিপ মিসাইল ও জিরিকন হাইপারসনিক মিসাইলও পাঠিয়েছিল কিউবাতে। কিউবাতে পাঁচদিন থাকার পর রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ রাশিয়া ফিরে যায়। এই ঘটনাকে কিউবান মিসাইল সংকটের সাথে তুলনা করা হচ্ছে। একের পর এক এমন ঘটনায় মনে হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শীতলযুদ্ধে বিশ্ব যেমন দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল বর্তমানেও সেরকমই একটি অবস্থা তৈরি হচ্ছে।
বিশ্ব যখন জি৭ নিয়ে ব্যস্ত ছিল তখন খানিকটা অকস্মাৎ ভাবেই উত্তর কোরিয়া সফরে চলে গেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন। দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকা সহ ইউরোপীয়ান দেশগুলো যেসব দেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যেমন ভেনিজুয়েলা, ইরান, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, চীন এসব দেশগুলো বর্তমানে একত্রিত হয়েছে যা স্বভাবতই অস্বস্তির কারন পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য। বিগত কয়েকবছর ধরে রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়ার মধ্যে ক্রমশ একটি জোট তৈরি হচ্ছে। এই জোটের প্রতিটি সদস্য সামরিক ক্ষেত্রে, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতায়, অর্থনৈতিক খাতে মিলিত ভাবে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে আমেরিকা ও ইউরোপীয়ান শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে। যেমন আজ বিশ্বে অর্থনীতিতে আমেরিকাকে টেক্কা দিচ্ছে চীন। পশ্চিম ইউরোপের অর্থনীতি ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে। পাশপাশি রাশিয়া ও চীনের মিলিত সামরিক ক্ষমতার সামনে আমেরিকাও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বর্তমান বিশ্বে যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন অঙ্গ হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র। যুদ্ধে যে পক্ষ মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবে তাদের সুবিধা বেশী। গোটা বিশ্ব যখন ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, এক্স, হোয়াটসঅ্যাপের নেশায় পড়েছে তখন চীন ও রাশিয়াতে এসব অ্যাপ নিষিদ্ধ। চীনে উইচ্যাট, টিকটকের মতোন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম রয়েছে যাতে পশ্চিমা দেশগুলোর নিয়ন্ত্রন নেই। চীন বহুদিন ধরে পশ্চিমা দেশগুলোর যুদ্ধাস্ত্রের প্রযুক্তি নকল করে আসছে এজন্য আমেরিকা সহ ইউরোপীয়ান দেশগুলো চীনের অনেক সংস্থার উপরেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আজ গোটা বিশ্ব জুড়ে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে, প্রযুক্তিতে, অর্থনীতি সহ সব বিভাগেই অদৃশ্য বানিজ্য যুদ্ধ বা ঠান্ডা লড়াই চলছে। যেমন বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্কের টেসলা সংস্থা ইলেকট্রনিক, স্বয়ংক্রিয় গাড়ি নির্মান করছে। সারা বিশ্ব আবহওয়া পরিবর্তনকে আটকাতে শূন্য কার্বন নির্গমনের উপর কাজ করছে, এর জন্য আগামী দশকে ইলেকট্রনিক গাড়িই ভবিষ্যত হতে চলেছে। এই ইলেকট্রনিক গাড়ির বিভাগে টেসলার সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী চীনের বিওয়াইডি। চীন বিআরআই বা বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত সর্বত্র পরিকাঠামো মির্মান করছে যা ভূরাজনীতিতে আমেরিকার একাধিপত্যের জন্য বড় হুমকী।
বিশ্ব ব্যাঙ্ক, আইএমএফের মতোন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর বিকল্প হিসাবে চীনের কাছে রয়েছে সাংহাই কোঅপারেশন সংস্থা। এই চীন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় সহযোগী ও বানিজ্যিক সাথী। এই জন্য রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে রাশিয়ার উপর প্রচুর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা সত্বেও রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়েনি। রাশিয়া চীন বলয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন সাথী ইরান। সামরিক শক্তি ও অর্থনীতির দিক দিয়ে ইরান রাশিয়া ও চীনের সমতুল্য নয়, কিন্তু ইরানের স্ট্রাটেজিক অবস্থান তাকে গুরুত্বপূর্ন করেছে। মধ্যপ্রাচ্যে তেল উত্তলনকারী দেশগুলোর মধ্যে দুটি দেশ সবচেয়ে শক্তিশালী সৌদি আরব ও ইরান। সৌদি আরব আমেরিকার ঘনিষ্ঠ। বহু বছর ধরেই নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত ইরান সামরিক ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরশীল হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরানের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। ইরানে সাম্প্রতিক কালে রাশিয়া ও চীন উভয়েই বিনিয়োগ করছে যা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নতুন সমীকরন তৈরি করছে। ইসরায়েল গাজাতে পূর্ন সামরিক অভিযান চালিয়ে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করছে কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অন্য স্ট্রাটেজি নিয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিন অনেকটা দাবার গুটির মোতন খুবই চিন্তাভাবনা করে প্রতিটা পদক্ষেপ নিচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধে। পুতিনের লক্ষ্য পুরোনো সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোন রাশিয়াকে শক্তিশালী করা৷ সেজন্য পুতিন সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধু দেশগুলোর সাথে পুনরায় কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করছে। চীন, উত্তর কোরিয়ার পর ভ্লাদিমির পুতিন ভিয়েতনাম সফরেও যাবে। আবার কিউবা থেকে রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ বহর ভেনেজুয়েলা যাচ্ছে। সুতরাং খুব দ্রুত বিশ্ব ক্রমাগত দুটি মেরুতে বিভক্ত হয়ে পড়ছে।
