আজও জীবিত পৃথিবীর সবথেকে বিপজ্জনক সন্ত্রাসবাদী ইল্চ রামিরেজ স্যানচেজ। কে এই ব্যাক্তি?
পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষই চায় বিখ্যাত হতে, তবে সবার ভীড়ে এমনও কিছু মানুষ আছে যারা তাদের অদ্ভুত খেয়ালের কারনে একটু বেশীই আলোচনায় থাকে। ঠিক তেমনই ভেনিজুয়েলার এমনই এক ব্যাক্তি আছে যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে এমন কিছু কাজ করা যাতে প্রত্যেকটি মানুষ তাকে চেনে তবে এক্ষেত্রে তার চিন্তাভাবনা ছিল একটু ভিন্ন। সাধারনত প্রত্যেক মানুষই চায় তার নিজের নাম বিখ্যাত হোক কিন্তু এই মানুষটি বিখ্যাত হওয়ার জন্য একটি ছদ্মনাম গ্রহন করেছিল। বিখ্যাত হওয়ার জন্য সে অপরাধের পথ বেছে নিয়েছিল যার জন্য তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। ফ্রান্সের এক জেলে ৭২ বছর বয়সী এই ব্যাক্তিটি আজ মৃত্যুর জন্য দিন গুনছে। এই ব্যক্তিটির নাম হচ্ছে ইল্চ রামিরেজ স্যানচেজ কিন্তু সে তার নিজের দেওয়া নাম কার্লোস দ্য জ্যাকেলই ব্যাবহার করত। বিশ্বের অন্যতম কুখ্যাত এই সন্ত্রাসবাদীকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইনটেলিজেন্স বিভাগ প্রায় আঠারো বছর ধরে খুঁজেছিল। শেষপর্যন্ত আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিস সংস্থা সিআইএ তাকে গ্রেফতার করে সুদান থেকে। কার্লোস দ্য জ্যাকেইল এবং তাকে সিআইএর গ্রেফতার করা সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
১৯৪৯ সালে ভেনিজুয়েলায় জন্ম হয় ইল্চ রামিরেজ স্যানচেজের। আর পাঁচজন সাধারন যুবকের মতোই জীবন কাটছিল তার কিন্তু ধীরে ধীরে স্যানচেজ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৩ সালে ৩০ ডিসেম্বর তাকে প্রথম মিশন দেওয়া হয় লন্ডনে জোসেফ এডওয়ার্ডকে হত্যা করার। বিখ্যাত পোষাক নির্মান সংস্থা মার্কস এন্ড স্পেন্সারের মালিক এই জোসেফ এডওয়ার্ড জাতিগতভাবে ইহুদি, যে কারনে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। ৩০ ডিসেম্বর জোসেফের বাড়িতে গিয়ে তার উপর গুলিও করেছিল রামিরেজ কিন্তু প্রানে বেঁচে যায় জোসেফ, ফলে রামিরেজের প্রথম মিশন ব্যার্থ হয়ে যায়। এরপর রামিরেজ ফ্রান্সে বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসবাদী হামলা করেছিল যাতে কয়েকজনের মৃত্যুও হয়েছিল। সত্তরের দশকে মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলের খেলোয়াড়দের উপর আক্রমনের অন্যতম মাস্টার মাইন্ডও ছিল এই রামিরেজ। তবে তাকে গোটা বিশ্ব চিনতে পারে ১৯৭৫ সালের ২১ ডিসেম্বরের পর। অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে প্রতিবছর ওপেক বা অর্গানাইজেশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং দেশ গুলোর মন্ত্রীদের মধ্যে সম্মেলন হতো।
১৯৭৫ সালে ২১ ডিসেম্বর এই সম্মলন হবার কথা ছিল। ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে রামিরেজকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এই সম্মেলনে যোগ দেওয়া সৌদি আরবের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী এবং ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে হত্যা করার। এই কাজের জন্য রামিরেজ ছয় সদস্যের একটি দল গঠন করে এবং ২১ ডিসেম্বর সাধারন মানুষের মতো ব্যাগ নিয়ে সম্মেলন স্থলে প্রবেশ করে ব্যাগ থেকে বন্দুক ও গ্রেনেড বের করে সেখানে থাকা সমস্ত মানুষকে বন্দী করে ফলে। সেইসময় ওই স্থানে বিভিন্ন দেশের ৬০ জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল যাদের প্রত্যেককেই বন্দী করে রামিরেজ। এরপর অস্ট্রিয়ার সরকারের সাথে যোগাযোগ করে রামিরেজ বলে প্রতি দুই ঘন্টা অন্তর ফিলিস্তিন আন্দোলনের খবর অস্ট্রিয়ার জাতীয় মিডিয়াতে প্রচার করতে এবং তাকে একটি বুলেটপ্রুফ বাস ও বিমান দিতে। অস্ট্রিয়া সরকার তার সমস্ত দাবী মেনে নেয় এবং পরেরদিন অর্থাৎ ২২ ডিসেম্বর বাসে করে বন্দীদের নিয়ে রামিরেজ ও তার দল এয়ারপোর্টে যায় এবং সেখান থেকে নির্দিষ্ট বিমানে করে আলজেরিয়া চলে যায়। আলজেরিয়া সেসময় ছিল ফিলিস্তিনের সমর্থক ফলে সেখানে রামিরেজ ও তার দলকে রীতিমতো অভ্যর্থনা জানানো হয়। আলজেরিয়াতে পৌঁছে রামিরেজ সব বন্দীদের মুক্ত করে দিয়ে তার দল নিয়ে চলে যায়। পুরো সিনেমার কায়দায় এই পুরো অভিযান পরিচালনা করা হয় অনেকটা নেটফ্লিক্সের বিখ্যাত মানি হেইস্ট সিরিজের মতোন। এরপরই তার নাম হয় কার্লোস দ্য জ্যাকেলই।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল সৌদি আরবের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ও ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে হত্যা করা কিন্তু রামিরেজ তাদের হত্যা করেনি। পরে জানা যায় সৌদি আরব ও ইরান এর জন্য রামিরেজকে পাঁচ কোটি ডলার দিয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকে কার্লোস যেন পশ্চিমা বিশ্বের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পশ্চিমা দেশ গুলোর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও ইসরায়েলি নাগরিকদের নিশানা করতে শুরু করে কার্লোস দ্য জ্যাকেলই। এই কারনে সিআইএ, মোসাদ, এমআই৬, ইন্টারপোল সহ বিশ্বের বিভিন্ন ইনটেলিজেন্স সংস্থা বিশেষ করে ফ্রান্সের ডিজিএসসি কার্লোসকে বেশী করে খুঁজছিল, কারন রামিরেজ ওরফে কার্লোস তার জীবনে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছিল ফ্রান্সেরই।
কিন্তু দশ বছর ধরে সিরিয়া থেকে শুরু করে লিবিয়া, ভেনিজুয়েলা, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া সর্বত্র অনুসন্ধান করেও কার্লোসকে খুঁজে পাওয়াতো দূরের কথা তার একটা ছবিও সংগ্রহ করতে পারেনি বিশ্বের তাবড় তাবড় গোয়েন্দা সংস্থা গুলি। শেষে ১৯৯৩ সালে সিআইএ খবর পায় সুদানের রাজধানী খার্তুমে লুকিয়ে আছে কার্লোস। জর্ডানের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএকে এই খবর দিয়েছিল। তবে সুদানে অভিযান চালানো আমেরিকার জন্য খুবই মুশকিল ব্যাপার ছিল কারন দেশটিতে আইন বলতে তখন কিছুই ছিলনা, সর্বত্র বিভিন্ন হিংস্র গোষ্ঠীর রাজত্ব চলছিল এবং সবথেকে বড় কথা সুদানের মানুষ সেসময় আমেরিকাকে শত্রু মনে করত। এরকম অবস্থায় সেই বছর ১৩ ডিসেম্বর সুদানের খার্তুম বিমানবন্দরে উপস্থিত হয় এক আমেরিকান ব্যাক্তি যার কাছে দুটি ব্যাগ এবং আমেরিকার কুটনৈতিক পাসপোর্ট ছিল। এই ব্যাক্তিটি হচ্ছে সিআইএর এজেন্ট বিলি ওয়াহ এবং তার ব্যাগে ছিল নেগেটিভ থেকে ফটো তৈরির কেমিক্যাল। বিলি ওয়াহকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল কার্লোসকে গ্রেফতার করবার। কিন্তু খার্তুমে কার্লোসকে খোঁজার অর্থ অনেকটা খড়ের গাদায় ছুঁচ খোজবার মত, কারন সিআইএর হাতে আটবছর আগে কার্লোসের একটি ছবি ছিল মাত্র যেটা ১৯৮৫ সালে হাঙ্গেরিতে তোলা হয়েছিল, এছাড়া আর কোন তথ্য ছিলনা। এইসময় জর্ডানের ইনটেলিজেন্স বিভাগ সিআইএকে একটি তথ্য দেয় যে কার্লোস জর্ডানের একটি মেয়ে লানা আব্দেল সালেমকে বিয়ে করে খার্তুমে রয়েছে। লানার ছবি সিআইএকে দিয়েছিল জর্ডান। এইসময় কার্লোস পরপর তিনটি ভুল করে বসে যা তার পতনের সূচনা করে। প্রথমত লানাকে বিয়ে করা, দ্বিতীয়ত স্থানীয় এক দোকানদারের সাথে বন্দুক নিয়ে ঝগড়া করা এবং তৃতীয়ত যা ছিল সবচেয়ে বড় ভুল তা হল, কার্লোস ঠিক করে নিজের জন্য একটি বিদেশী দেহরক্ষী রাখবে, তার জন্য নিজের এক বন্ধুকে ফোন করে কার্লোস, কিন্তু সে জানতনা সেই ফোন ট্রাপ করছে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। সিআইএকে মোসাদ জানায় ইরাক থেকে তারেক নামে একজন দেহরক্ষী আসছে কার্লোসের জন্য এবং তারেকের ছবিও মোসাদ দিয়েছিল সিআইএকে। তখন সিআইএ বিলিকে দায়িত্ব দেয়, বিলি তারেককে খার্তুম বিমানবন্দর থেকেই অনুসরন করা শুরু করে। কিন্তু খার্তুম বিমানবন্দরে নিরাপত্তা রক্ষীর মাধ্যমে তারেককে সরিয়ে নেয় কার্লোস। এরপর একবছর ধরে তারেক কিংবা কার্লোসের কোন খোঁজ পায়নি সিআইএ।
অবশেষে ১৯৯৪ সালে খার্তুমের এক অভিজাত হোটেলের লবিতে সিআইএ তারেককে খুঁজে পায়৷ সাথে সাথে বিলি ও গ্রেগ নামে আরেক এজেন্ট তারেকের উপর নজর রাখতে শুরু করে। তারেক হোটেল থেকে বেড়িয়ে একটি সাদা টয়োটা গাড়ি চালাতে শুরু করে, বিলি ও গ্রেগ তার পিছু নেয় কিন্ত কিছুক্ষন পর তারেক তাদের ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যায়। এর পরবর্তী কয়েক সপ্তাহ ধরে অনেক অনুসন্ধানের পর খার্তুমের এক হসপিটালের বাইরে তারেকের সেই সাদা টয়োটা গাড়িকে খুঁজে পায় সিআইএ। সেই হসপিটালে কার্লোস দ্য জ্যাকেলই এবং তার স্ত্রী লানাকে খুঁজে বের করে সিআইএ এজেন্ট, বিলি ওয়াহ তাদের ছবি সিআইএ অফিসে পাঠায় এবং সিআইএ এরপর একটি প্যারা মিলিটারি অপারেশনের নির্দেশ দেয়। তবে এর আগে খার্তুমে কার্লোসের বাড়ির পাশেই একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে কার্লোসের উপর সর্বক্ষন নজরদারি করছিল বিলি ওয়াহ। এরই মধ্যে আমেরিকা ও ফ্রান্স সুদান সরকারকে চাপ দেয় কার্লোসের ব্যাপারে, বাধ্য হয়ে সুদান সরকার ঠিক করে কার্লোসকে আমেরিকা ও ফ্রান্সের হাতে তুলে দেওয়া হবে। এরইমধ্যে কার্লোস দ্য জ্যাকেলই সুদান থেকে কায়রো হয়ে আলজেরিয়া পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু শেষপর্যন্ত ১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট সুদান সরকারের কিছু এজেন্ট কার্লোসকে তার বাড়ি থেকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে বিমানবন্দরে নিয়ে গিয়ে ফ্রান্সের হাতে তুলে দেয়। সেখান থেকে তাকে প্যারিস নিয়ে আসা হয় এবং বিভিন্ন মামলায় তার তিনবার যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। বলা হয় কার্লোস দ্য জ্যাকেলই ওসামা বিন লাদেনের থেকেও বিপজ্জনক ছিল।