জম্মু কাশ্মীরে অপারেশন সর্প বিনাশের মতো অপারেশন আবারও করা হতে পারে?
গত সোমবার জম্মু কাশ্মীরের ডোডাতে সন্ত্রাসী দমন অভিযানে চারজন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন। এই নিয়ে গত ৩২ মাসে অন্তত ৪৮ জন সেনা হারালো ভারতীয় সেনাবাহিনী। বর্তমানে জম্মু কাশ্মীরে জঙ্গীরা তাদের নীতি পরিবর্তন করেছে, জঙ্গীরা কাশ্মীরের বদলে শান্ত জম্মু অঞ্চলে নাশকতা শুরু করেছে।
** ১৪ ডিসেম্বর, ২০২১, চারজন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন।
** ১৩ মে, ২০২২, কাটরাতে তীর্থযাত্রীদের বাসে আক্রমন করে জঙ্গীরা যাতে চারজনের মৃত্যু হয়।
** এপ্রিল-মে, ২০২৩, দশজন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন দুটি সন্ত্রাসী আক্রমনে।
** ২২ নভেম্বর, ২০২৩, পাঁচজন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন।
** ২১ ডিসেম্বর, ২০২৩, চারজন ভারতীয় সেনাবাহিনী জঙ্গি হামলায় বীরগতি প্রাপ্ত হন।
** ৪ মে, ২০২৪, ভারতীয় বায়ুসেনার একজন সদস্য বীরগতি প্রাপ্ত হন এবং পাঁচজন আহত হন পুঞ্চে জঙ্গি হামলায়।
** ৯ জুন, ২০২৪, রিয়াসিতে তীর্থযাত্রীদের একটি বাসে জঙ্গিদের হামলায় ৯ জনের মৃত্যু হয় এবং ৩৩ জন আহত হয়।
** ১১-১২ জুন, ২০২৪, দুটি সন্ত্রাসী হামলায় পাঁচজন ভারতীয় সেনা আহত হন।
** ৮ জুলাই, ২০২৪, কাঠুয়াতে সেনাবাহিনীর গাড়িতে সন্ত্রাসী হামলায় পাঁচজন সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন এবং পাঁচজন আহত হন।
** ১৬ জুলাই, ২০২৪, ডোডাতে চারজন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন।
জম্মু কাশ্মীরে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কার্যকলাপ প্রতিরোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইতিমধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সাথে বৈঠক করেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। পাকিস্তান ও চীনের মদতে নতুন করে জম্মু কাশ্মীরে শুরু হওয়া এই সন্ত্রাসবাদের জন্য দুই দশক আগে চলা অপারেশন সর্প বিনাশের মতো বড় অপারেশনেরও পরিকল্পনা চলছে।
জম্মু কাশ্মীরের ইতিহাসে ১৯৮৭-১৯৯০ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাসী গতিবিধি চরমে ছিল। বিশেষ করে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাসে কাশ্মীরে হিন্দু পন্ডিতদের উপর নিপীড়ন, অত্যাচার চালায় পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা যাতে হিন্দু পন্ডিতরা কাশ্মীর ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়। পাকিস্তান এর উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরকে যেভাবেই হোক ভারত থেকে সম্পূর্নরূপে বিচ্ছিন্ন করা। এই কারনে ১৯৯০-১৯৯৬ সাল পর্যন্ত অপারেশন রক্ষক চালায় ভারতীয় সেনাবাহিনী যাতে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে সন্ত্রাসবাদীদের নির্মুল করা হয়। ১৯৯৬ সালের মধ্যে কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসী গতিবিধি মোটামুটি বন্ধ হয়ে যায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর কারনে। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় আসে। লস্কর ই তৈবা, জইশ ই মহম্মদ, আল কায়েদার মতোন সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি হয় এইসময়। পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্স সংস্থা আইএসআই এসব সন্ত্রাসী সংগঠনকে পূর্ন সহয়তা করতে থাকে। জইশ ই মহম্মদ কাশ্মীরে অনেকবার সন্ত্রাসী হামলা করেছে। ভারতীয় বিমান হাইজ্যাক করেছিল সন্ত্রাসীরা।
১৯৯৯ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কার্গিলের যুদ্ধ হয়েছিল। ২০০১ সালে জম্মু কাশ্মীরের বিধানসভায় আক্রমন হয়, ভারতের সংসদ ভবনে আক্রমন হয়। এরপরেই অপারেশন পরাক্রম শুরু করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। প্রায় আরেকটি ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ভারত পাকিস্তান সীমান্তে অন্তত আট লাখ ভারতীয় সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল। পাকিস্তান ভারতকে পরমানু যুদ্ধের হুমকী দিয়েছিল এইসময়। কিন্তু উভয়দেশের মধ্যে কুটনৈতিক স্তরে আলোচনার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়। ২০০৩ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী অপারেশন সর্প বিনাশ শুরু করে যাতে কাশ্মীর উপত্যকা থেকে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে উপড়ে ফেলে দেয়। এই অপারেশন ৬৫ জন সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়েছিল অপারেশন সর্প বিনাশের কারনে লস্কর ই তৈবা, হিজবুল মুজাহিদীন, জইশ ই মহম্মদের মতোন সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর কোমড় ভেঙে পরবর্তী দশ বছর তারা কাশ্মীর উপত্যকাতে বড় ধরনের কোনও হামলা করতে পারেনি। ২০১৭ সালে অপারেশন অলআউট করে ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে সন্ত্রাসী দমনে। কাশ্মীরে পাকিস্তানি সন্ত্রাসীদের দমনে ভারতীয় সেনাবাহিনী নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অপারেশন করতেই থাকে। কাশ্মীরের উন্নয়নেও ব্যাপক কাজ করেছে ভারত সরকার বিগত কয়েক বছরে।
নারীদের শিক্ষা, আইআইটির মতোন কেন্দ্রে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয় কাশ্মীরিদের। জম্মু কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমস্ত অভিযানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ছিল অপারেশন সর্প বিনাশ। পুঞ্চ বিভাগের সুরানকোটে অঞ্চলে ও জম্মুর পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষ করে হিলকাকা অঞ্চলে এই অপারেশনে সন্ত্রাসীদের কঠোরভাবে দমন করা হয়েছিল। কিন্ত ওই অপারেশন মোটেও সহজ ছিলনা কারন পীরপঞ্জাল পর্বতমালার দক্ষিন ও দক্ষিন পূর্বে কাশ্মীর উপত্যকাতে ঘন জঙ্গল রয়েছে, সেখানে লুকিয়ে পড়তো সন্ত্রাসীরা, জঙ্গলের মধ্যে অসংখ্য গুহা ছিল যাতে তারা আশ্রয় নিত। এরপর নদী পেরিয়ে কাশ্মীরে নাশকতার জন্য আসত তারা, এছাড়া স্থানীয় কিছু মানুষজনও তাদের সহায়তা করতো। তাছাড়া কাশ্মীরের তীব্র বরফপাতেও অপারেশন যথেষ্ট সমস্যার ছিল। কাশ্মীরের স্থানীয় যাযাবর উপজাতি বাকেরওয়ালদের ব্যবহার করতো সন্ত্রাসীরা। কাশ্মীরের পুলওয়ামা, অনন্তনাগ, ডোডা, কিসতওয়ার অঞ্চল সন্ত্রাসীদের জন্য পুরো স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠেছিল কারন তীব্র বরফপাতের কারনে কোমর পর্যন্ত অঞ্চল বরফে ঢাকা থাকতো। এরকম পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসীরাও জানতো ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষে অপারেশন করা অসম্ভব এক প্রকার। বাকেরওয়ালদের ঘরে সন্ত্রাসীরা জোর করে আশ্রয় নিত, তাদের দিয়ে জোর করে রান্না করাতো।
২০০৩ সালে রাষ্ট্রীয় রাইফেলসের রোমিও ফোর্সকে অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তবে সুরানকোটের হিলকাকা অঞ্চলে অপারেশন মোটেও সহজ ছিলনা। অক্টোবর, ২০০২ সালে অপারেশন পরাক্রম শেষ হয়। ২০০৩ সালে অপারেশন সর্প বিনাশের পরিকল্পনা করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী জানতো সন্ত্রাসীদের দমন করতে হলে শীতকালেই অভিযান করতে হবে কারন সেসময় জঙ্গীরা নিশ্চিন্তে থাকে। ভারতীয় সেনাবাহিনী একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। স্থানীয় বাকেরওয়ালরা শীতকালে উচ্চ পার্বত্যভূমিতে তাদের ঘর থেকে নীচে নেমে আসে এবং গ্রীষ্মকালে আবার উপরে চলে যায়। সেনাবাহিনী ঠিক করে বাকেরওয়ালদের ছদ্মবেশে এবার তারা উপরে যাবে, এর জন্য বাকেরওয়ালদেরও রাজি করানো হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৬ ক্রপসকেও এই অপারেশনে যুক্ত করা হয়। মেজর জেনারেল এইচএস লিড্ডারকে অপারেশন দায়িত্ব দেওয়া হয়, তিনি এর আগে শ্রীলঙ্কাতে অপারেশন পবনের দায়িত্বে ছিলেন। ১ মে, ২০০৩ প্রস্তাবিত সময়ের এক সপ্তাহ আগেই অপারেশন সর্প বিনাশ সম্পূর্ন হয়ে যায়, এতটাই ভালো প্রস্ততি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীর। এই অপারেশনে ৬৫ জন সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়, ১১৯টি জায়গা যেখানে সন্ত্রাসীরা লুকিয়ে থাকতো সেসব জায়গা ধ্বংস করে দেওয়া হয়, পাকিস্তান ও চীনের দেওয়া প্রচুর অস্ত্র উদ্ধার করা হয় যা জঙ্গীরা ব্যবহার করতো। এই অপারেশনে পাঁচজন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিল এবং পাঁচজন আহত হয়েছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভয় এতটা ছড়িয়ে পড়েছিল জঙ্গীদের মধ্যে যে তারা দ্বিতীয়বার এই অঞ্চলে আসেনি কখনও অপারেশন সর্প বিনাশের কুড়ি বছর পর আবারও সন্ত্রাসী কাজকর্ম শুরু হয়েছে যার জন্য বর্তমান পরিস্থিতিতেও এই ধরনের অপারেশনের প্রয়োজন রয়েছে। জম্মু শান্ত এলাকা বলে সেখান থেকে কিছু সেনা সরিয়ে লাদখে মোতায়েন করে সেনাবাহিনী, এই পরিস্থিতিরই সুযোগ নিয়েছে সন্ত্রাসীরা।