ভগত সিং, রাজগুরু এবং বিপ্লবী শুকদেবের ফাঁসির আদেশ। লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়েছিল কবে? কি কারন ছিল এর পেছনে?
ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে উঠে এসেছে বিপ্লবীদের চালানো একাধিক ব্রিটিশ বিরোধী অভিযান। এই সব অভিযানগুলির মধ্যে অন্যতম একটি অভিযান ছিল ডেপুটি কমিশনার জে. পি. স্যাণ্ডার্সকে হত্যা করা। এই হত্যাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল একটি মামলা যা ইতিহাসের পাতায় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা (Lahore Conspiracy Case) নামে খ্যাত হয়ে রয়েছে। এই মামলাতেই দেশকে হারিয়ে ফেলতে হয়েছিল তিন বীর বিপ্লবীকে।
১৯২১ সালে শুরু করা গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশে। তবে ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গান্ধীজী এই আন্দোলন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কারণ তাঁর এই আন্দোলন ছিল অহিংস আন্দোলন। কিন্তু চৌরিচৌরার ঘটনাটি ছিল তাঁর নীতির বিরোধী, কারন চৌরিচৌরা পুলিশ স্টেশন আক্রমণ করে আন্দোলনকারীরা ২২ জন পুলিশকে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়। গান্ধীজীর এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি সশস্ত্র আন্দোলনে বিশ্বাসী বিপ্লবীরা। সেই সময় থেকে বিপ্লবীরা তাদের কার্যকলাপকে বাড়িয়ে তোলার জন্য গড়ে তুলছিলেন গুপ্ত সমিতি। সেই উদ্দেশ্যে ১৯২৪ সালে রামপ্রসাদ বিসমিল, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল সহ বেশ কিছু বিপ্লবী মিলে ‘হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ (Hindustan Republican Association) নামক একটি বিপ্লবী দল গঠন করেন। পরবর্তীকালে এই সংগঠনে যোগ দেন ভগত সিং।
১৯২৮ সাল, সমগ্র দেশ জুড়ে দানা বাঁধতে শুরু করে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ। সেই সময় একটিই স্লোগান ভাসছে চারিদিকে ‘সাইমন গো ব্যাক’। কারণ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সাতজন সদস্যবৃন্দের দ্বারা গঠিত এই কমিশন দেশের নতুন আইন-বিধি প্রণয়ন এবং স্বরাজ ঘোষণার নাম করে অপমানজনক বিধি-নিয়ম আরোপের চেষ্টা করে।
এই সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর লাহোরে শুরু হয় অহিংস স্বদেশী আন্দোলন। সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী লালা লাজপত রাই। এই আন্দোলনে ক্ষুব্ধ হয়ে লাহোরের তৎকালীন পুলিশ সুপার জেমস এ স্কট এবং ডেপুটি কমিশনার জে. পি. স্যাণ্ডার্সের নির্দেশে বিক্ষোভকারীদের উপর লাঠি চার্জ করা হয়। স্কট নিজেই এই লাঠি চার্জ করতে গিয়ে ধরে ফেলেন লালা লাজপত রাইকে। রিপোর্টে দাবি অনুসারে, লালা লাজপত রাইকে ধরার পর লাঠি দিয়ে আঘাত করেন স্কট। যার ফলে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। চিকিৎসাধীন থাকলেও ১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর লালা লাজপত রাই মৃত্যুবরন করেন। তবে অবশ্য সেই দাবী অস্বীকার করেছিল ব্রিটিশ পুলিশ।
লালা লাজপত রাই এর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন বিপ্লবীরা। ওই বছরই ১৭ ডিসেম্বর ডেপুটি কমিশনার জে. পি. স্যাণ্ডার্সকে দয়ানন্দ বৈদিক মহাবিদ্যালয়ের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল লাহোরের তৎকালীন পুলিশ সুপার জেমস এ স্কটকে হত্যা করা। সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়ে যায় স্কট। স্যাণ্ডার্সকে রক্ষা করার জন্য স্যাণ্ডার্সের হেড কনস্টেবল চন্দন সিং এগিয়ে এলে তাঁকেও ভগত সিং গুলি করে হত্যা করে।
এরপর বিপ্লবীরা লাহোরের রাস্তায় রাস্তায় পোস্টারে লেখেন যে, স্যাণ্ডার্সের মৃত্যু আসলে লালা লাজপত রাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ মাত্র। এই লেখার মাধ্যমে বিপ্লবীরা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে এই হত্যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বৃহত্তর লক্ষ্যে সাধিত।
এরপর লাহোর থেকে সকল বিপ্লবীরা পালিয়ে যান। ইতিমধ্যে মুক্তি লাভ করেন বিপ্লবী যতীন দাস। ভগৎ সিং ও বিপ্লবী যতীন দাস দেখা করেন এবং ভগৎ সিং এর অনুরোধে যতীন দাস বোমা তৈরি ও নিক্ষেপ শেখাতে চলে আসেন আগ্রায়। একটি নির্জন জায়গায় বাড়ি ভাড়া করেছিলেন ভগত সিং, বটুকেশ্বর দত্ত ও বিজয় কুমার সিং এবং বোমা নিক্ষেপের পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল ঝাঁসির জঙ্গলে। প্রশিক্ষণ নিয়ে লাহোরে চলে যান শুকদেব এবং সাহারানপুরে চলে যান শীউ ভার্মা।
১৯২৯ সালে দিল্লির বিধানসভায় এই স্যাণ্ডার্স হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি অধিবেশন বসে। সেই অধিবেশনে আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে ছিল পাবলিক সেফটি বিল, ট্রেড ডিস্পুট বিল, সাইমন কমিশন এবং লালা লাজপত রাইের মৃত্যু। অ্যাসেম্বলির ভেতর অধিবেশন চলাকালীন সময়ে ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগী বটুকেশ্বর দত্ত দুটি বোমা নিক্ষেপ করেন। তবে কাউকে হত্যা করা ছিল না এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাবলিক সেফটি বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। যথারীতি এই বোমা নিক্ষেপ করায় বেশ কিছু কাউন্সিলের সদস্য আহত হয়েছিল। এই বোমা দুটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে নিক্ষেপ করার পরে অ্যাসেম্বলির চারদিক ধোয়ায় ভরে যায় এবং সেই ফাঁকে তারা দুজনে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে পারেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সবকিছু হলেও সেখান থেকে পালিয়ে যান না ভগৎ সিং। উল্টে “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” বলে স্লোগান দিতে শুরু করলেন সেখানেই। এরপর ব্রিটিশ পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করে।
বোমা নিক্ষেপের ঘটনা এবং বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের তদন্ত করতে শুরু হয় ‘ লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা’।
১৯২৯ সালের ১৪ জুন সকালে বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ দাসকে কলকাতায় টাউনসেণ্ড রোড ও হাজরা রোডের মোড়ে দোতলার একটি ঘর থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ এবং লাহোরের জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে।
এরপর ব্রিটিশ পুলিশ স্যাণ্ডার্স হত্যা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত থাকা শুকদেব, যতীন্দ্রনাথ দাস সহ মোট পঁচিশ জনকে বিপ্লবীকে গ্রেপ্তার করে।
জেলে থাকাকালীন সময়ে ভগৎ সিং দেখেন যে জেলের মধ্যে ইউরোপীয় কারাবন্দী এবং ভারতীয় বন্দীদের অসম আচরন। যেখানে ইউরোপীয় কারাবন্দীদের সাথে ভালো ব্যবহার করা, নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছিল সেখানে ভারতীয় কারাবন্দীদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা তো দেওয়া দূরের কথা ভালো ব্যবহার পর্যন্ত করা হত না। এই অসম আচরণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন ভগৎ সিং। ১৫ জুন থেকে জেলের মধ্যেই শুরু করেন আমরণ অনশন।
এই অনশনে যোগদান করেছিল বটুকেশ্বর দত্ত এবং শুকদেব সহ বহু বন্দী বিপ্লবীরা। এরপর এই মামলা শুরু হয় ১০ জুলাই ১৯২৯ সালে। সেই সময় ভগত সিং অসুস্থ থাকার কারণে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হয়েছিল আদালতে। অবশেষে ১১২ দিন পর অর্থাৎ ৪ অক্টোবর তিনি অনশন ভঙ্গ করেন।
এই মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় উঠে আসে শুকদেব, কিশোরী লাল রত্তন, প্রেম দত্ত, দেশ রাজ, জয়দেব, শীউ ভার্মা, জ্ঞান প্রসাদ, মহাবীর সিং, ভগত সিং, অজয় কুমার ঘোষ, যতীন সান্যাল, বিজয় কুমার সিনহা, শিবরাম রাজগুরু, কুন্দনলাল, কনওয়াল নাথ ত্রিবেদী, ভগবান দাস, চন্দ্রশেখর আজাদ, কৈলাশ পাত্তি, ভগবতী চরণ, যশপাল এবং সদগুরদয়াল, আজ্ঞা রাম, সুরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে, বটুকেশ্বর দত্ত প্রমুখ বিপ্লবীদের নাম। তবে এই বিপ্লবীদের মধ্যে ভগবান দাসকে বিচারের জন্য আদালতে পাঠানো হয়নি। কিছু বিপ্লবীর পালিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁদের বিচার হয়নি তাদের মধ্যে উল্লখযোগ্য ছিল চন্দ্রশেখর আজাদ, কৈলাশ পাত্তি, ভগবতী চরণ, যশপাল এবং সদগুরদয়াল। এছাড়াও ভারতীয় ক্রিমিনাল কোডের ২৫৩ ধারা অনুযায়ী, আজ্ঞা রাম ও সুরেন্দ্রনাথ পাণ্ডেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী, বটুকেশ্বর দত্তকেও মুক্তি দেওয়া হয়। অবশেষে পনেরো জন বিপ্লবীকে নিয়েই লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করেছিল ব্রিটিশ সরকার।
ভারতের ইতিহাসে স্মরণীয় এই লাহোর ষড়যন্ত্র মামলাটি ১৯২৯ সালের ১১ জুলাই থেকে ১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত চলেছিল। অবশেষে ৭ অক্টোবর তারিখে এই মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। এই রায়ে ভগত সিং, রাজগুরু এবং বিপ্লবী শুকদেবের ফাঁসির আদেশ ঘোষিত হয়।
এই মামলার বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট রায়সাহেব পণ্ডিত কিষাণচন্দের উপর। অবশেষে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৮১ ধারা অনুযায়ী, ২৩ মার্চ ১৯৩১ সালের ফাঁসি দেওয়া হয় এই তিন বিপ্লবীকে।
কিছু ঐতিহাসিকের মতে, ১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গান্ধীজি ভগত সিংয়ের ফাঁসির আদেশ মুকুবের আবেদন করেছিলেন তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড আরউইনের কাছে। কিন্তু আরউইন এই আবেদনে কর্ণপাত করেননি। বহু প্রচেষ্টার পরও গান্ধীজি ভগত সিংয়ের ফাঁসি রদ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। আবার কিছু ঐতিহাসিকের মতে, গান্ধীজি করাচিতে জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনকে অক্ষুণ্ন রাখতে কোনো মন্তব্য করেননি তিন বিপ্লবীর ফাঁসির বিষয়ে। এই বিতর্কের কোনো শেষ নেই। জানা যায় যে, গান্ধীজি ইয়ং ইণ্ডিয়া পত্রিকায় ফাঁসির দিন ‘জাতীয় বীর’ আখ্যা দেন ভগৎ সিংকে।