যখন বন্ধুত্ব করে কোনও কাজ করা সম্ভব তখন শত্রুতার প্রয়োজন নেই। আলেকজান্ডারের বাবা নিজের বীরত্বে সমগ্র গ্রীসকে যেভাবে একজোট করেছিল
কূটনীতিতে একটি কথা প্রচলিত আছে যে যখন বন্ধুত্ব করে কোনও কাজ করা সম্ভব তখন শত্রুতার প্রয়োজন নেই। কথাটা শুনে হাস্যকর মনে হবে কারন শত্রুর সাথে কখনও বন্ধুত্ব সম্ভব নয়। কিন্তু ইতিহাসে এমনই একটি বিরল ঘটনা ঘটেছিল যেখানে একজন ফিলিপ দ্বিতীয় নামক এক গ্রীক রাজা তার সমস্ত শত্রুদের বন্ধু করে নিয়েছিল এবং পরবর্তীকালে তাদের উপর পূর্ন নিয়ন্ত্রন নিয়ে নিয়েছিল। প্রায় ১৭ বছর ধরে চলা পেলোপোনেসিয়ান যুদ্ধ শেষ হয় ৪০৪ বিসিতে। এই যুদ্ধ হয়েছিল গ্রীসের বিভিন্ন রাজ্যগুলোর মধ্যে। প্রাচীন গ্রীসে দুটি সবচেয়ে শক্তিশালী রাজ্য ছিল এথেন্স ও স্পার্টা, মূলত তাদের মধ্যেই এই যুদ্ধ হয়েছিল। ৪০৪ বিসিতে এথেন্স পরাজিত হয় এবং স্পার্টা জয়ী হয়। যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর এথেন্সের লোকজন তাদের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য চেষ্টা শুরু করে যার নেতৃত্বে ছিল ডেমোসথেনেস নামে এক ব্যক্তি। ডেমোসথেনেস এথেন্সের লোকদের তাদের গৌরবশালী অতীত সম্পর্কে উজ্জীবিত করার কাজ শুরু করে।
৩৫৯ বিসিতে গ্রীসের আরও একটি প্রদেশ ম্যাসিডোনিয়ার রাজার মৃত্যু হয়। ম্যাসিডোনিয়াতে পরবর্তী রাজা কে হবে তা নিয়ে রীতিমতো রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়ে যায়। এথেন্সের রাজনীতিবিদরা এই সুযোগটাকে কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনা করে। যদিও এথেন্সের লোকেরা ম্যাসিডোনিয়ানদের বর্বর ও নিজদের শ্রেষ্ঠ মনে করতো কিন্তু এথেন্সের বেশীরভাগ বানিজ্য ম্যাসিডোনিয়ার পাশ দিয়ে হত বলেই এথেন্স চাইছিলো এমন একজন রাজা ম্যাসিডোনিয়ার ক্ষমতায় আসুক যার সাথে এথেন্সের সুস্পর্ক থাকবে। ম্যাসিডোনিয়ার অধীনে অ্যানথ্রোপোলিস নামে একটি গুরুত্বপূর্ন এলাকা ছিল যা একটা সময় এথেন্সের অংশ ছিল। অ্যানথ্রোপোলিস সোনার বানিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। এজন্য এথেন্সবাসী ঠিক করে এমন একজন রাজাকে সমর্থন করবে ম্যাসিডোনিয়ার সিংহাসনে বসতে যে তাদের পুনরায় অ্যানথ্রোপোলিস ফিরিয়ে দেবে। এথেন্সের নেতৃত্ব কিছু জাহাজ ও সেনা পাঠায় ম্যাসিডোনিয়ার রাজপদ প্রার্থী আর্গাসকে সমর্থনের জন্য। কিন্তু আর্গাস রাজা হতে পারেনি, যে রাজা মারা গিয়েছিল তার ২৪ বছর বয়সী ছোট ভাই দ্বিতীয় ফিলিপ রাজা হয়। এই ঘটনায় এথেন্স ব্যাপক ভয় পেয়ে যায় কারন এথেন্স আর্গাসকে সমর্থন করেছিল। এথেন্স ভাবে দ্বিতীয় ফিলিপ তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে। কিন্তু হয় পুরো বিপরীত, দ্বিতীয় ফিলিপ এথেন্সের সাথে বন্ধুত্ব করে এবং এথেন্সের জাহাজ ও সেনা কোনওরকম মুক্তিপন ছাড়াই ফিরিয়ে দেয়। দ্বিতীয় ফিলিপ অ্যানথ্রোপোলিসও সাময়িক ভাবে এথেন্সকে দিয়ে জানায় কিছুবছর পর পুনরায় অ্যানথ্রোপোলিস সে দখল করে নেবে তখন এথেন্সকে তার একটি শহরের বিনিময়ে ম্যাসিডোনিয়া থেকে অ্যানথ্রোপোলিস নিতে হবে। এই ঘটনার কয়েক বছর পর এথেন্সের রাজনৈতিক অস্থিরতায় হঠাৎই দ্বিতীয় ফিলিপ অ্যানথ্রোপোলিস দখল করে নেয়, তখন এথেন্স দ্বিতীয় ফিলিপের কাছে কিছু প্রতিনিধি পাঠায় পুরোনো কথা অনুযায়ী। কিন্তু রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ জানিয়ে দেয় এই মূহুর্তে অ্যানথ্রোপোলিস দিতে পারবেনা। এভাবে এথেন্সের সাথে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করে দ্বিতীয় ফিলিপ কিন্তু এথেন্সের কিছু করার ছিলনা কারন ম্যাসিডোনিয়া এথেন্সের থেকে অনেকবেশী শক্তিশালী ছিল এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারনে এথেন্স যু্দ্ধ করার পরিস্থিতিতে ছিলনা। কিন্তু ডেমোসথেনেস এথেন্স বাসীকে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে বলা শুরু করে এবং ম্যাসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে সেনা অভিযানের কথাও বলতে শুরু করে। এই ঘটনার কিছু বছর পর থার্মোপলি নামক একটি শহর দখল করতে এসে রাজা দ্বিতীয় ফিলিপ ও এথেন্সের সেনাবাহিনী সামনাসামনি আসে, সেসময় দ্বিতীয় ফিলিপের সেনাবাহিনী পীছু হটে যায় যার জন্য এথেন্সের মোনোবল বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ম্যাসিডোনিয়ার ক্ষমতা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ৩৪৬ বিসিতে দ্বিতীয় ফিলিপ এথেন্সকে একটি চুক্তির প্রস্তাব দেয় যাতে বলা হয় অ্যানথ্রোপোলিস দ্বিতীয় ফিলিপের অধীনেই থাকবে, এর বদলে ম্যাসিডোনিয়া এথেন্সের কোনও শহরে আক্রমন করবেনা। এথেন্স না চাইলেও বাধ্য হয়ে চুক্তি করে কারন ম্যাসিডোনিয়া অনেক বেশী শক্তিশালী ছিল এথেন্সের তুলনায়। এই চুক্তিকে দি পিস অফ পিলোক্রেটস বলা হয়। এই চুক্তিকে প্রথমদিকে ডেমোসথেনেস পর্যন্ত সমর্থন করেছিল। কিন্তু এই চুক্তির কীছু সময়ের মধ্যেই দ্বিতীয় ফিলিপ থার্মোপলি দখল করে নেয়। এথেন্সের প্রতিনিধিরা যখন দ্বিতীয় ফিলিপের কাছে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানায় তখন দ্বিতীয় ফিলিপ থার্মোপলি ছেড়ে চলে যায়। এথেন্সবাসী লক্ষ্য করে দ্বিতীয় ফিলিপ কোনও জায়গা প্রথমে দখল করে, তারপর চুক্তি করে এবং সাময়িক ভাবে সেই জায়গা ছেড়ে চলে যায়। এইজন্য এথেন্স ঠিক করে এবার সরাসরি দ্বিতীয় ফিলিপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। ৩৩৮ বিসিতে এথেন্স থিবস নামক আরও একটি গ্রীক প্রদেশের সাথে যৌথভাবে ম্যাসিডোনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার প্রস্তুতি নেয়। দ্বিতীয় ফিলিপও এথেন্স ও থিবসের সন্ধির কথা শুনে যুদ্ধের জন্য প্রস্ততি নেয়। ম্যাসিডোনিয়ার কাছে ২৫০০০ সেনা ও ২০০০ অশ্বারোহী সেনা ছিল। এথেন্স ও থিবসের কাছে ৩৫০০০ সেনা ছিল অর্থাৎ সংখ্যায় তারা এগিয়ে ছিল। আগস্ট, ৩৩৮ বিসিতে উভয়পক্ষের মধ্যে ক্যারোনিয়ার যুদ্ধ হয় যাতে বেশী সেনা থাকা সত্বেও এথেন্স ও থিবস হেরে যায়। এথেন্স ও থিবসের এই লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার প্রধান কারন ছিল দ্বিতীয় ফিলিপের শক্তিশালী অশ্বারোহী সেনা। এথেন্স ও থিবসের কাছে অশ্বারোহী সেনা ছিলনা। এই লড়াইয়ে এথেন্স ও থিবসের ২০০০ সেনা মারা যায় ও ৪০০০ সেনা বন্দী হয়। এই যুদ্ধের পর সমগ্র গ্রীসে দ্বিতীয় ফিলিপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার মতোন সাহস করও ছিলনা। ক্যারোনিয়ার যুদ্ধের পর দ্বিতীয় ফিলিপ থিবসে গিয়ে মোটা অর্থ ক্ষতিপূরন আদায় করে এবং তার বিনিময়ে যুদ্ধ বন্দীদের মুক্তি দেয়। এই ঘটনায় সবচেয়ে বেশী ভীত হয়ে পড়ে এথেন্স। কিন্তু দ্বিতীয় ফিলিপ এথেন্সে গিয়ে কোনও ক্ষতিপূরনই নেয়নি, এমনকী ডেমোসথেনেসকেও কোনও শাস্তি দেয়নি। উপরন্তু ফিলিপ এথেন্সের সাথে পুনরায় বন্ধুত্বের প্রস্তাব দেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এথেন্সের লোকজন এতটাই খুশি হয়েছিল যে এথেন্সে ফিলিপের একটি বিশাল মূর্তি তৈরি করা হয় এবং ফিলিপ ও তার ছেলেকে এথেন্সের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। আসলে দ্বিতীয় ফিলিপ জানতো ম্যাসিডোনিয়া যতই শক্তিশালী হোকনা কেন এথেন্সের নৌবাহিনী তাদের থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী সেজন্য ভবিষ্যতের বড় কোনও যুদ্ধে এথেন্সের নৌবাহিনী ব্যবহারের জন্য এথেন্সকে কোনওরূপ শাস্তি দেয়নি ফিলিপ। এই যুদ্ধের পর দ্বিতীয় ফিলিপ গ্রীসের সমস্ত রাজাদের নিয়ে একটি সভা ডাকে যেখানে স্পার্টা ছাড়া সমস্ত গ্রীক প্রদেশের রাজারা এসে উপস্থিত হয়। এই সভায় সমস্ত গ্রীক রাজাদের নিয়ে হেলেনিক কনফেডারেশন গঠন করা হয় যার প্রধান জেনারেল হয় দ্বিতীয় ফিলিপ স্বয়ং। এই জোট গঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গ্রীসের সমস্ত রাজ্যগুলোকে এক জোট করা। দ্বিতীয় ফিলিপ জানতো গ্রীসের সবচেয়ে বড় শত্রু পার্সিয়ান সাম্রাজ্য, তারা নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধে ব্যস্ত থাকে সেই সুযোগে পার্সিয়া তাদের উপর আক্রমন করে। সেজন্য পার্সিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য জোট গঠন করে দ্বিতীয় ফিলিপ। এই জন্যই এথেন্সকে সেসময় ক্ষমা করে দিয়েছিল ফিলিপ যাতে ভবিষ্যতে এথেন্সের শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করে পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে অভিযান করা যায়। কিন্তু হেলেনিক কনফেডারেশন গঠনের দুই বছরের মধ্যে মেয়ের বিয়েতে ফিলিপকে এক অজানা ব্যক্তি হত্যা করে। দ্বিতীয় ফিলিপের মৃত্যুর পর গ্রীসে পুনরায় রাজনৈতিক সংকট তৈরি হয়, ম্যাসিডোনিয়ার নতুন রাজা হয় ফিলিপের ছেলে। সিংহাসনে বসেই ফিলিপের ছেলে হেলেনিক কনফেডারেশনকে তার নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসে পার্সিয়া আক্রমন করে পার্সিয়া জিতে নেয়। পার্সিয়া জিতেই থেমে যায়নি ফিলিপের ছেলে সে আরও পূর্বে এগিয়ে ভারতবর্ষ পর্যন্ত চলে আসে। ফিলিপের এই ছেলে আর কেউ নয় মহান গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার দি গ্রেট, যাকে সিকন্দরও বলা হয়। আলেকজান্ডারের সময়কালকে গ্রীসের ইতিহাসে স্বর্নযুগও বলা হয়।