পাকিস্তানের পরমানু প্রোজেক্ট ধ্বংস করতে ভারতবর্ষের জেমস বণ্ড অজিত দোভালের ভূমিকা
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মিঃ অজিত দোভাল। একটা মানুষের যোগ্যতা কতটা থাকলে ৭৯ বছর বয়সেও দেশের এমন গুরুত্বপূর্ন পদের দায়িত্ব দেওয়া যায় তা সহজেই অনুমেয়। অজিত দোভাল তাঁর সারা জীবনে ভারতের জন্য এমন এমন কাজ করেছেন যার কারনে তাঁকে সুপার স্পাই বলা হয়। অজিত দোভাল পাকিস্তানে গিয়ে পাকিস্তানের পরমানু প্রজেক্টকে নষ্ট করতে র কে সাহায্য করেছিলেন। সাত বছর ধরে পাকিস্তানে ছদ্মবেশে থেকে অজিত দোভাল বহু গুরুত্বপূর্ন তথ্য ভারতকে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতেরই একজন প্রধানমন্ত্রীর একটু ভুলের কারনে শেষ পর্যন্ত অজিত দোভাল ও র এর এত পরিশ্রম বেকার হয়ে যায়।
সময়টা ১৯৭৪ সালের, সেসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সেই বছরই ১৮ মে ভারত রাজস্থানের পোখরানে প্রথম পরমানু পরীক্ষা করে। ইতিহাসে এই ঘটনা অপারেশন স্মাইলিং বুদ্ধা নামে বিখ্যাত। ভারতের এই পরমানু পরীক্ষার এক বছর পর ১৯৭৫ সাল থেকে পাকিস্তান ও পরমানু বোম্ব তৈরির চিন্তাভাবনা শুরু করে৷ সেসময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিল জুলফিকর আলি ভুট্টো। পাকিস্তান পরমানু বোম্ব তৈরির জনক ডঃ আব্দুল কাদের খান সেসময় নেদারল্যান্ডসে একটি ইউরেনিয়াম সংস্থা ইউরেনকোতে কাজ করছিল। আব্দুল কাদের খান জুলফিকর আলি ভুট্টোকে প্রস্তাব দেয় পাকিস্তানে গিয়ে পরমানু প্রজেক্টে কাজ করার, এই প্রস্তাবে সম্মত হয় জুলফিকর আলি ভুট্টো। আব্দুল কাদের খান ইউরেনকো থেকে পরমানু বোম্ব তৈরির সমস্ত গোপন তথ্য চুরি করে পাকিস্তানে পালিয়ে আসে, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে সেসময় রীতিমতো আলোচনা হয়।
১৯৭৬ সালের জুন মাসে কাহোটা পরমানু কার্যকালাপ শুরু করে আব্দুল কাদের খান, কারন পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে কাহুটাতেই পরমানু প্রজেক্টের সমস্ত ব্যবস্থা তৈরি করা হয়। এইসময় আব্দুল কাদের খান উত্তর কোরিয়াও যায়, উদ্দেশ্য পরমানু বোম্ব তৈরির পদ্ধতি বিক্রি করা৷ এই খবরও আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে প্রকাশ হয়ে যায়। পাকিস্তানকে এসময় সহায়তা করে চীন। ১৯৭৬ সাল আসতে আসতে অজিত দোভালও ভারত সরকারের সুনজরে পড়ে যায়, কারন তিনি সিকিম ও মিজোরামের সমস্যা সমাধান করেন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সামনে সেসময় সবচেয়ে বড় সমস্যা যেটা দেখা দেয় তা হচ্ছে পাকিস্তান সত্যিই পরমানু অস্ত্র তৈরি করছে কীনা এবং কাশ্মীরে পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্স সংস্থা আইএসআই এর প্রভাব কমানো। যার কারনে ইন্দিরা গান্ধী র এবং ইনটেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবির বৈঠক ডাকেন। সেখানে ঠিক হয় পাকিস্তানের পরমানু কার্যকালাপ সম্পর্কে জানবার জন্য ভারতের বেশ কিছু এজেন্টকে পাকিস্তানে দীর্ঘ সময়ের জন্য পাঠানো হবে যারা পাকিস্তান থেকে তথ্য ভারতকে পাঠাবে। এই অপারেশনে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদও ভারতকে সহায়তা করবার কথা ঘোষনা করে কারন মোসাদও চাইছিলনা পাকিস্তান পরমানু সক্ষমতা অর্জন করুক। বেশ কিছু এজেন্টের সাথে অজিত দোভালকেও নির্বাচন করা হয় পাকিস্তানে গিয়ে কাজ করবার ব্যাপারে। অজিত দোভালকে রীতিমতো প্রশিক্ষন দেওয়া হয় এক পাকিস্তানি যুবকের মতোন ব্যবহারের। উর্দু শেখানো হয়, পাকিস্তানি সংস্কৃতি শেখানো হয়। প্রশিক্ষন শেষে ১৯৭৬ সালেই অজিত দোভালকে পাকিস্তান পাঠানো হয়। পাকিস্তানের ইসলামাবাদ, পেশোয়ার সহ বেশ কয়েক শহরে অজিত দোভাল অনুসন্ধান করেন, ততদিনে র এর আর কয়েকজন এজেন্ট পাকিস্তানে চলে আসে। তবে প্রথমদিকে পাকিস্তান কোথায় পরমানু গবেষনা করছিলো তা খুঁজেই পাচ্ছিলোনা র, শেষ পর্যন্ত র খুঁজে পায় রাওয়ালপিন্ডির কাহোটা শহরে পাকিস্তান একটি গোপন গবেষনাগার তৈরি করেছে।
কাহুটা পাহাড় দিয়ে ঘেরা একটি ছোট শহর, সেসময় কাহুটা প্রায় জনবিরল শহর ছিল৷ এরকম জায়গায় পরমানু কার্যক্রম আদবেও চলছিল কিনা তা প্রথমে র নিশ্চয়ই ছিলনা৷ যার কারনে বেশ কয়েক মাস ধরে এই গবেষনাগারে আসা গবেষকদের উপর নজর রাখতে শুরু করে র। এদিকে ১৯৭৭ সালে ভারতের রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে।
১৯৭৭ সালে সাধারন নির্বাচনে হেরে যায় ইন্দিরা গান্ধী। সেই প্রথম দেশে বিপক্ষ রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয় মোরারজী দেশাই। তিনি মনে করতেন ইন্দিরা গান্ধী র কে ব্যবহার করেছিলেন বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে যার করনে তিনি ক্ষমতায় এসেই র এর বাজেট ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেন। এদিকে পাকিস্তানে বেশ কয়েকমাস ধরে গবেষকদের উপর নজর রেখেও কাহুটার পরীক্ষাগারে আদতে পরমানু কার্যক্রম চলছে কিনা তা বুঝতে পারছিলনা র। তখন র ঠিক করে যে গবেষকদের উপর নজর রাখা হচ্ছে তাদের চুলের টুকরো যদি সংগ্রহ করা যায়, তাহলে তা ভারতে পাঠানো হবে। তখন পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে তাতে তেজস্ক্রিয়তা আছে কিনা। কারন পরমানু প্রজেক্টে কাজ করা ব্যাক্তিদের চুলে তেজস্ক্রিয়তা পাওয়া যায়। অজিত দোভাল ও র এজেন্টরা নজর রাখতে শুরু করে সেই গবেষকরা কোন সেলুনে চুল কাটতে যায়। এইভাবে রাওয়ালপিন্ডির এক সেলুন থেকে সেই গবেষকদের চুলের নমুনা সংগ্রহ করে বিশেষ ব্যাগে তা ভারতে পাঠায় র এজেন্টরা। ভারতে সেই চুলের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায় তাতে ভারী তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে। এরপরই র নিশ্চিত হয়ে যায় কাহুটাতোই পরমানু কার্যক্রম চালাচ্ছে পাকিস্তান। এদিকে অজিত দোভাল পাকিস্তানের কাহোটা পরীক্ষাগারে কাজ করা এক গবেষককে রাজি করিয়ে ফেলে তথ্যের জন্য। সেই ব্যাক্তিটি দশ হাজার ডলারের বিনিময়ে কাহোটা পরীক্ষাগারের এবং পাকিস্তানের পরমানু প্রজেক্টের তথ্য ভারতকে দিতে রাজি হয়ে যায়। এই ঘটনা ভারতে র এর প্রধানকে জানানো হয়৷ তিনি যখন এই তথ্য প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাইকে জানান, তিনি স্পষ্ট বারন করে দেন এব্যাপারে কিছু না করতে কারন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপার। এর সাথেই অজিত দোভাল সহ র এর এজেন্টদের পাকিস্তানে এতদিনের পরিশ্রম ব্যার্থ হয়ে যায়। এরপর মোসাদ র কে জানায় তারা পাকিস্তানের কাহোটা গবেষনাগারে এয়ারস্ট্রাইক করতে চায় তবে তার জন্য ভারতের সহায়তা লাগবে। ইসরায়েল থেকে আসা যুদ্ধবিমান গুলোকে গুজরাটে রিফিউলিং করতে হবে। এর জন্য র এর প্রধান আবারও মোরারজী দেশাই এর কাছে যান। মুম্বাইয়ে ইসরায়েলের বিদেশমন্ত্রী মোসেদ ইয়েনের সাথে মোরারজী দেশাই এর বৈঠক হয় যেখানে মোসাদে ইয়েন পুরো পরিকল্পনা জানান মোরারজী দেশাইকে। কিন্তু মোরারজী দেশাই এবারও রাজি হননি, তিনি আবারও বলেন এটা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপার। একদিকে অজিত দোভাল সহ র এর এজেন্টরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানে গুরুত্বপূর্ন তথ্য সংগ্রহ করেছিল অন্যদিকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই এর কারনে তাদের এত পরিশ্রম ব্যার্থ হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে, পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি হয় জেনারেল জিয়াউল হক। বলা হয় কুটনৈতিক স্তরে মোরারজী দেশাই এর সাথে জিয়াউল হকের ভালো সম্পর্ক ছিল। মোরারজী দেশাই একদিন জিয়াউল হকের সাথে ফোনে কথা চলাকালীন বলেন তিনি পাকিস্তানের গোপন মিশন সম্পর্কে জানেন। সাথে সাথে জিয়াউল হক বুঝতে পারেন মোরারজী দেশাই কোন ব্যাপারে কথা বলছেন। জিয়াউল হক আইএসআইকে সক্রিয় করে দেন। যার ফলে র এর বেশ কিছু এজেন্ট ধরা পড়ে যায় এবং তাদের হত্যা করে আইএসআই। অজিত দোভাল তখনও পাকিস্তানে ছিল। অজিত দোভাল লাহোর চলে যান, সেখান থেকে ভারতকে প্রয়োজনীয় তথ্য পাঠাতে থাকে পাকিস্তানের ব্যাপারে। সাত বছর পাকিস্তানে থেকে বহু গোপন তথ্য পাঠিয়েছিলেন অজিত দোভাল।