ফিচার আর্টিকেল

মানুষের মন নিয়ন্ত্রন করতে যে ড্রাগ আবিস্কার করেছিল আমেরিকার গোয়েন্দারা!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার সাথে সাথে বিশ্বে খুব দ্রুত বেশ কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটেছিল। জার্মানি ও জাপানের মতোন সুপার পাওয়ারের পতন হয়, সাথে সাথে ইউরোপের আরও দুই সুপার পাওয়ার ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের অর্থনৈতিক কাঠামো পুরো ভেঙে গিয়েছিল। আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পুরো ইউরোপকে আর্থিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছিল। তবে ধ্বংস থেকেই পুনরায় সৃষ্টি হয়, ঠিক তেমনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে আক্ষরিক অর্থে দুই সুপার পাওয়ার তৈরি হয়েছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। দুজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা প্রমানের জন্য শুরু হয়ে যায়  ঠান্ডা লড়াই যাকে স্নায়ু যুদ্ধও বলা হয়।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার সাথে সাথে ১৯৪৭ সাল থেকে চলা এই ঠান্ডা লড়াই বন্ধ হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে সরাসরি কোন যুদ্ধ হয়নি আসলে এই লড়াই ছিল মনস্তাত্ত্বিক। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ দেশ নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী যেকোন একটি পক্ষে যোগ দেয়, যার ফলে কার্যত বিশ্ব সেসময় দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। স্নায়ু যুদ্ধ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে হওয়া সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট। মনস্তাত্ত্বিক এই যুদ্ধে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছিল উভয় দেশের গুপ্তচর সংস্থা। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের গুপ্তচর সংস্থা কেজিবির মধ্যেই মূলত প্রতিযোগিতা শুরু হয়, কে কত বেশী তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে ও নজর রাখতে পারবে। ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একাধিক গোপন প্রজেক্টে কাজ করতো। অর্থাৎ সরাসরি যুদ্ধ না হলেও সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্ততি উভয়েই নিয়ে রাখছিল। এইসময় আমেরিকা এমন একটি প্রজেক্টে কাজ করছিল যার পরীক্ষা করা হচ্ছিল দেশের সাধারন মানুষের উপর, এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বে আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল। এই প্রজেক্টের নাম ছিল প্রজেক্ট এমকেআল্ট্রা যার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মনের উপর নিয়ন্ত্রন। আমেরিকার সিক্রেট সার্ভিস সিআইএ এই প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিল। এই প্রজেক্ট এতটাই গোপনীয় ছিল যে অন্তত দুই দশক এর সম্পর্কে কেউ জানতোই না। সিআইএর এই প্রজেক্ট এমকেআল্ট্রা সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৫ শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

এরপর আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ শুরু করে অপারেশন ওভারকাস্ট যাতে জার্মানির বিজ্ঞানীদের জোর করে আমেরিকাতে তুলে নিয়ে এসে তাদের আমেরিকার জন্য উন্নত প্রযুক্তি তৈরিতে কাজে লাগানো হয়। পরে এর নাম দেওয়া হয় অপারেশন পেপারক্লিপ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের জার্মানি অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে কাজ করছিল, আমেরিকার সেগুলোই দরকার ছিল। এমনই এক জার্মান প্রজেক্ট ছিল মানুষের মন নিয়ন্ত্রন করা। আমেরিকা এর পরে নাম দেয় প্রজেক্ট এমকেআল্ট্রা। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে সিআইএ ডিরেক্টর অ্যালেন ডিউলিস প্রজেক্ট এমকে আল্ট্রার স্বীকৃতি দেয়। এই প্রজেক্টের নেতৃত্বে ছিল আমেরিকার বিখ্যাত গুপ্তচর ও কেমিস্ট সিডনি গটলেভ। এই প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে মনকে নিয়ন্ত্রন করার ড্রাগস তৈরি করা। কোরিয়ান যুদ্ধে আমেরিকান বন্দিদের উপর এরকম ড্রাগস ব্যবহার করা হত, সেখান থেকেই এই ড্রাগস সম্পর্কে ধারনা পায় আমেরিকা। জাপানে পরমানু বোম্ব ফেলার পর আমেরিকা ভেবেছিল একমাত্র তাদের কাছেই এই প্রযুক্তি ছিল কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নও একের পর এক পরমানু পরীক্ষা করার ফলে আমেরিকা সোভিয়েত ইউনিয়নের থেকেও নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমান করার উদ্দেশ্য শুরু করেছিল এই প্রজেক্ট। আমেরিকান ঐতিহাসিকবিদ আলফ্রেড ডব্লুভিইউ ম্যাকয় বলেছিলেন প্রজেক্ট এমকেআল্ট্রা সম্পর্কে সিআইএ যা জানিয়েছে তা আসল ব্যাপার না প্রকৃত সত্য ভিন্ন ছিল। এই প্রজেক্টে এলএসডি নামে নিষিদ্ধ ড্রাগসের ব্যবহার শুরু করে সিআইএ। এই ড্রাগসের বিশেষত্ব ছিল যে এই ড্রাগস সেবনে মানুষের স্মৃতি শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বিশেষ ব্যাপার ছিল যে অন্যান্য ড্রাগসের মতোন এই ড্রাগস সেবনে নেশা হয় না। সিডনি গটলেভ বিভিন্ন গোপন মিশনে এই এই ড্রাগসের ব্যবহার শুরু করে। তবে যেকোন পরীক্ষাই পরীক্ষাগারে করার থেকে বাস্তবে করা সবচেয়ে বেশী চ্যালেঞ্জিং। সিডনি গটলেভ সিআইএর বেশ কিছু এজেন্টের উপর প্রথমে এই ড্রাগসের পরীক্ষা করে। এজেন্টরা তাদের অজান্তেই এই ড্রাগস গ্রহন করে এবং তাদের একটি ঘরে বন্দি করে রাখা হয় কিছুদিন। দেখা যায় ড্রাগসের প্রভাবে তাদের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে এবং অল্পতেই রেগে যাচ্ছে তারা।

প্রজেক্ট এমকেআল্ট্রাতে কাজ করা কেমিস্ট ফ্রাঙ্ক ওয়েলসনের উপরেও করা হয় এবং এর কিছুদিন পরেই নিউইয়র্কের এক হোটেলে রহস্যময় ভাবে তার মৃত্যু হয়। নিউইয়র্ক টাইমস দাবি ফ্রাঙ্ক ওয়েলসন এই প্রজেক্টের বিরোধিতা করে বেড়িয়ে যেতে চেয়েছিল প্রজেক্ট থেকে, যার জন্য সিআইএ তাকে হত্যা করে। তবে সিআইএ এসব খবর প্রকাশিত হতে দেয়নি। আমেরিকার পাশাপাশি কানাডাতেও গোপনভাবে সিআইএ এই প্রজেক্টে কাজ করছিল। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মোনোবিদ ডোনাল্ড ইভ্যান ক্যামেরন তখন মানুষের মস্তিষ্কের উপর একটি বিশেষ প্রজেক্টে কাজ করছিল। ক্যামেরন বিশেষ একটি রাসায়নিক সিজো ফার্নিয়া দ্বারা পুরোনো স্মৃতি লোপ করে নতুন স্মৃতি যুক্ত করার চেষ্টা করছিল যা সিআইএকে আকর্ষিত করে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৪ অবধি এই প্রজেক্টের জন্য আমেরিকা ৬৯,০০০ ডলার বা আজকের হিসাবে প্রায় পাঁচ লাখ ডলার খরচ করেছিল। সিআইএ সরাসরি ক্যামেরনকে কোনওদিন নিয়োগ করেনি। সিআইএ নকল সংস্থা তৈরি করে তার মাধ্যমে ক্যামেরনকে অর্থ সাহায্য করত যাতে ক্যামেরন প্রজেক্ট সম্পন্ন করে। ক্যামেরন এলসিডি ছাড়াও একাধিক ড্রাগস ও ইলেকট্রিক কনক্লুসিভ পদ্ধতির সাহায্যে তার হসপিটালে মানুষের উপর এই পরীক্ষা করতো। ক্যামেরন তার হসপিটালে মানসিক অবসাদে ভোগা রাগীদের উপর ড্রাগস দিয়ে ইলেকট্রিক কনক্লিসিভ পদ্ধতিতে জোর করে বৈদ্যুতিক শক দিত যাতে অনেক সময় রোগী মারাও যেত, এমনকি যদি বেঁচে থাকত কেউ, তাহলে সে নিজের নাম অবধি ভুলে যেত। প্রজেক্ট এমকেআল্ট্রাতে আরও একটি ড্রাগসের উপরেও পরীক্ষা করা হচ্ছিল তা হল মানুষকে দিয়ে সত্য বলানো। প্রধানত কয়েদিদের জন্য এই ড্রাগস তৈরি করা হচ্ছিল। কোন কয়েদিকে তিনমাস অন্ধকার জায়গায় রেখে তার উপর এই ড্রাগস প্রয়োগ করা হচ্ছিল। এই পরীক্ষায় এটাও দেখা হচ্ছিল যে কেউ তার অনিচ্ছা সত্বেও কাউকে হত্যা করতে পারে কিনা। পরে জানা যায় সিআইএ আমেরিকার ৮৬ টি বিশ্ববিদ্যালয়, হসপিটালে এই পরীক্ষা করেছিল মানুষের উপর, এমনকি বাচ্চাদের উপরেও এই পরীক্ষা করা হয়েছিল। অসুস্থ বাচ্চাদের উপর এই ড্রাগস প্রয়োগ করা হত যাতে অনেকের মৃত্যুও হত, এতটাই নৃশংস ছিল এই প্রজেক্ট।

প্রজেক্ট এমকেআল্ট্রাতে প্রায় ১৬০ টি ভিন্ন ভিন্ন প্রজেক্টে কাজ হত। এরই মধ্যে একটি ছিল অপারেশন মিডনাইট ক্লাইমেক্স। সিআইএ একটি গোপন ঘর তৈরি করত, ঘরের মাঝে একটি বিশেষ কাঁচ থাকত যার অপরপ্রান্তে একজন সিআইএ এজেন্ট থাকতো। বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত মেয়েদের দ্বারা মানুষকে এখানে এনে ড্রাগস প্রয়োগ করা হত যাতে সেসব সত্যি কথা বলে। একরকম বহু প্রজেক্ট ছিল, যাতে বলা হয় হাজারেরও বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। অবশেষে ১৯৭২ সালে সিডনি গটলেভ অবসরে যাবার সময় এই প্রজেক্ট বন্ধ করে দেয়। সিআইএর ইতিহাসে অন্যতম অসফল এই প্রজেক্টের খেসারত দিয়েছিল বহু সাধারন মানুষ তাদের প্রান দিয়ে। ১৯৭৪ সালে সিআইএর এই প্রজেক্ট প্রকাশ্যে আসে। তবে সিআইএ এই প্রজেক্টের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২০,০০০ নথি নষ্ট করে দিয়ে এই ব্যাপরে সব তথ্য মুছে ফেলতে চেয়েছিল কিন্তু কোনও ভাবে এই প্রজেক্টের সব তথ্য প্রকাশ হয়ে যায় এবং আমেরিকাতে রীতিমতো সাড়া পড়ে যায়। ১৯৭৪ সালে আমেরিকান কংগ্রেস তদন্তের নির্দেশ দেয় সিআইএ, এফবিআই এবং মিলিটারির বিরুদ্ধে। জানা যায় সিআইএ জোর করে অনৈতিক ভাবে এই নৃশংস প্রজেক্টকে চালিয়েছিল। যে ফ্রাঙ্ক ওয়েলসনকে সিআইএ গোপনে হত্যা করেছিল তার পরিবার সিআইএর বিরুদ্ধে মামলা করে। ১৯৭৫ সালে ওয়েলসন পরিবারকে ৭,৫০,০০০ ডলার ক্ষতিপূরন দেওয়া হয় এবং আমেরিকার রাষ্ট্রপতি জেরাল্ড ফোর্ড ও সিআইএর ডিরেক্টর জনসমক্ষে ওয়েলসন পরিবারের কাছে ক্ষমা চায়। কানাডাতে এই প্রজেক্টের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১২৭ টি পরিবারকে একলাখ ডলার করে দেয় কানাডা সরকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *