ফিচার আর্টিকেল

শক্তিশালী শাসক। অহংকারের কারনে পরাস্ত হয়েছে ইতিহাসের বহু রাজা

ইতিহাসে এমন কিছু শাসকের নাম পাওয়া যায় যারা প্রচুর ক্ষমতাশীল হবার পরও অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রতিপক্ষের কাছে পরাজিত হয়েছে। এসব শাসকরা শক্তিশালী হবার পরেও ভূলবশত কিংবা ক্ষমতার অহংকারে শত্রুকে দুর্বল ভেবে পরাস্ত হয়েছে। এমনই এক জেনারেল ছিল যার একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারনে পুরো ইতিহাস বদলে যায়। সময়টা তখন ৬০ বিসিই অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছরেরও আগে। সেসময় রোমকে নিয়ন্ত্রন করত তিনজন ব্যাক্তি ক্র্যাসাস, পম্পি এবং জুলিয়াস সিজার। এই তিনজনের মধ্যে একটা বিষয়ে মিল ছিল এরা প্রত্যেকেই দক্ষ সেনানায়ক ছিল। তবে তিনজনেই চাইত পুরো রোমে নিজেদের আধিপত্য স্থাপন করতে। এদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ছিল ক্র্যাসাস। শুধু রোমেই নয় মানব ইতিহাসে অন্যতম ধনী ব্যক্তি ছিল এই ক্র্যাসাস। ধনী হবার পাশাপাশি দক্ষ সামরিক কর্মকর্তাও ছিল ক্র্যাসাস। রোমে স্পার্টাকাসের নেতৃত্বে হওয়া বিদ্রোহ দমন করেছিল এই ক্র্যাসাস। পম্পি নিজেও ধনী ছিল কিন্তু ক্র্যাসাসের মতোন নয়। তবে পম্পিও অনেক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল রোমকে। এই তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে তরুন ছিল জুলিয়াস সিজার। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক ক্ষেত্রে বাকী দুজনের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম প্রতিষ্ঠিত ছিল সে। ক্রাস্যাস রোমের বাইরে এক যুদ্ধে নিহত হয় এবং তাঁর প্রচুর সেনা মারা যায়। ফলে জুলিয়াস সিজারের সামনে প্রধান প্রতিযোগী থাকে পম্পি। রোমের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ছিল পম্পির। যার কারনে জুলিয়াস সিজার ঠিক করে রোমের আশেপাশে বীরত্ব দেখিয়ে রোমান জনগনের সামনে নিজেকে বীর প্রমান করবে কারন পম্পি কোনওদিন রোমের বাইরে লড়াই করেনি।

জুলিয়াস সিজার ঠিক করে ইটালির একদম উত্তরে ফ্রান্সের দক্ষিন সীমানার কাছে গ্যালিক উপজাতিদের উপর আক্রমন করবে। এই অঞ্চলে ট্রান্সআলপাইন গল নামে একটি বড় প্রদেশ যেখানে গলরা বসবাস করতো, এখানে জুলিয়াস সিজার আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয়। পশ্চিম ইউরোপে আল্পস পর্বতমালা এবং রাইন নদীর পাশে অবস্থিত একটি বিশেষ অঞ্চলকে গল বলা হত। এই গলের অধিকাংশ ভূমি নিয়ে বর্তমানে ফ্রান্স গঠন হয়েছে। এই গলরা বারবার বিদ্রোহ করতো এবং রোমান সাম্রাজ্যে ঝামেলা করতো যার কারনে তাদের পরাজিত করে রোমের মানুষদের কাছে নায়ক হবার চেষ্টা শুরু করে জুলিয়াস সিজার। বিশাল রোমান সেনা নিয়ে একের পর এক গ্যালিক উপজাতিদের পরাজিত করতে থাকে জুলিয়াস সিজার, গলরা যোদ্ধা হলেও রোমান সেনা ছিল প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ। বেশ কিছুমাস পর জুলিয়াস সিজারকে রাজনৈতিক কারনে রোমে ফিরে যেতে হয়। তখন গ্যালিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে ভেরসিনজ্যেটোরিক্স নামে একজনকে তাদের সেনানায়ক হিসাবে নিযুক্ত করে। গলরা বিশ্বাস করতো ভেরসিনজ্যেটোরিক্স নেতিত্ব দিলে তাদের কেউ পরাজিত করতে পারবেনা। ভেরসিনজ্যেটোরিক্স প্রায় দশ হাজার গ্যালিক যোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ করে তাদের প্রশিক্ষন দেয় এবং পাশ্ববর্তী একটি রোমান দুর্গে আক্রমন করে রোমানদের পরাজিত করে। জুলিয়াস সিজার যখন প্রথমদিকে জিতছিলো তখন রোমে তাঁর সম্মান বাড়ছিলো কিন্তু যেই এই বিদ্রোহের খবর রোমে পৌঁছায় সাথে সাথে জুলিয়াস সিজার আবার গলে ফিরে আসে এবং গ্যালিকদের উপর আবার আক্রমন শুরু করে। জুলিয়াস সিজার একে একে সমস্ত জায়গা পুনরুদ্ধার করে যেগুলো ভেরসিনজ্যেটোরিক্স দখল করে নিয়েছিল। রোমান সেনা এত দ্রুত গলদের পরাজিত করছিলো তার প্রধান কারন ছিল তাদের সংঘবদ্ধতা। রোমান সাম্রাজ্যের শক্তির প্রধান কারনই ছিল বিশেষ প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি দেশই সেনাবাহিনী রাখে এবং রীতিমতো আবেদন করে, পরীক্ষায় পাশ করে সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে হয়। অতীতে এমন ব্যবস্থা ছিলনা, যুদ্ধ লাগলে সেই প্রদেশের যেকোনও পেশার পুরুষরা অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে যেত ফলে পুরো যুদ্ধ হতই সংখ্যার বিচারে, যার সেনা বেশী সে যুদ্ধে জিতবে। কিন্তু সেই অতীতেও রোমান সাম্রাজ্যে আধুনিক যুগের মতোন প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী ছিল। রোমানদের যুদ্ধ করবার পদ্ধতি ছিল সংঘবদ্ধ ভাবে যুদ্ধ। অর্থাৎ একদল সেনা তরোয়াল, বল্লম, ঢাল নিয়ে রীতিমতো বূহ্য রচনা করে যুদ্ধ করতো। রোমান সেনারা কঠিন অনুশাসন মেনে চলতো। 

অন্যদিকে গলরা ব্যক্তি বিশেষে ভালো যোদ্ধা হত কেউ কেউ কিন্তু তারা সংঘবদ্ধভাবে আক্রমন করা কিংবা অনুশাসন মেনে চলায় অভ্যস্ত ছিলনা ফলে তারা রোমানদের সামনে জিততে পারতনা। এছাড়া গলরা বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত ছিল ফলে তাদের মধ্যে ঐক্য ছিলনা রোমানদের মতোন। জুলিয়াস সিজার সমস্ত জায়গা পুনরুদ্ধারের পর গলের একটি বড় শহরে আক্রমনের পরিকল্পনা করে যেখান ভেরসিনজ্যেটোরিক্সের প্রধান ঘাঁটি। ভেরসিনজ্যেটোরিক্স জানতো যদি জুলিয়াস সিজার শহরে পৌছাঁতে পারে তাহলে তাকে পরাজিত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে সেজন্য জুলিয়াস সিজারকে মাঝরাস্তাতেই যুদ্ধ করবার জন্য বাধ্য করবার পরিকল্পনা করা হয়। অ্যালেসিয়া নামক জায়গাকে যুদ্ধের জন্য বেছে নেয় ভেরসিনজ্যেটোরিক্স। অ্যালেসিয়া জায়গাটা ছিল পাহাড়ের উপর এবং পাশে নদী ছিল। যার ফলে প্রাকৃতিক ভাবে এই শহরে আক্রমন করে জেতা প্রায় অসম্ভব। ভেরসিনজ্যেটোরিক্স ততদিনে প্রায় এক লাখ গল যোদ্ধাদের সংঘবদ্ধ করে অ্যালেসিয়াতে রীতিমতো ঘাঁটি তৈরি করে। 

জুলিয়াস সিজার তার সেনাসহ অ্যালেসিয়া শহরের কাছে এসে বুঝতে পারে এখানে বিশাল সংখ্যায় গলরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছে। গলদের এক লাখ সেনার বিপরীতে জুলিয়াস সিজারের সেনার ছিল পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার অর্থাৎ অর্ধেক। একে সংখ্যায় কম তার উপর গলেরা আগে থেকে পাহাড়ের উপর সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে গলেরা, সুতরাং এ অবস্থায় যুদ্ধের অর্থ আত্মহত্যার সমান। জুলিয়াস সিজার যুদ্ধ না করে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয় পুরো শহরকে ঘেরা বন্দি করতে। রোমানরা ঘেরা বন্দিতে পারদর্শী ছিল। রোমানরা কোন দুর্গে আক্রমন করতে গেলে সরাসরি আক্রমন না করে সেই দুর্গের চারদিক ঘিরে অবরোধ করত। কয়েক মাস অবরোধের পর দুর্গের ভিতরের শত্রু খিদে, তেষ্টায় অর্ধমৃত হয়ে যেত তখন রোমানরা আক্রমন করতো৷ 

অ্যালেসিয়া শহরের চারদিকে রোমানরা প্রায় দশ মাইল লম্বা দেওয়াল তৈরি করে। ভেরসিনজ্যেটোরিক্স এটা ভাবেনি যে রোমানরা তাদেরই ঘিরে ফেলবে। বাধ্য হয়ে ভেরসিনজ্যেটোরিক্স কয়েকজন গলকে কোনওভাবে শহরের বাইরে যেতে বলে যাতে বাইরে থেকে আরও গল সেনার সাহায্য পাওয়া যায়৷ এই খবর যখন জুলিয়াস সিজার জানতে পারে তখন সিজার দেওয়ালের বাইরে আরও একটি দেওয়াল তৈরির নির্দেশ দেয়। এবার চোদ্দ মাইল লম্বা আরও একটি দেওয়াল তৈরি করা হয়। এই দুই দেওয়ালের মধ্যে রোমান সেনা অপেক্ষা করতে থাকে। এদিকে কয়েক সপ্তাহ যেতেই খাদ্যের অভাব হতে শুরু করায় বাধ্য হয়ে ভেরসিনজ্যেটোরিক্স শহরের সমস্ত নারী, বাচ্চা, বৃদ্ধদের জোর করে শহরের বাইরে চলে যাবার নির্দেশ দেয়, এদের মধ্যে তাঁর যোদ্ধাদের পরিবারও ছিল। কিন্তু রোমানসেনারা তাদের দেওয়ালের বাইরে আসতে বাধা দেয়। ফলে ঘেরা বন্দি অবস্থাতেই খিদে তেষ্টায় ক্রমশ মারা যেতে শুরু করে গলরা। কিছুদিনের মধ্যেই বাইরে থেকে গনযোদ্ধাদের একটি দল দেওয়ালের বাইরে এসে উপস্থিত হয়। রোমান সেনা আগে থেকেই প্রস্তত ছিল। উভয়পক্ষের মধ্যে ভয়ানক যুদ্ধ হয় যাতে রোমানরা জয়লাভ করে। ভেরসিনজ্যেটোরিক্স বুঝতে পারে বাইরে থেকে আর সাহায্য পাওয়া যাবেনা বাধ্য হয়ে সে তাঁর কিছু সাথি গিয়ে জুলিয়াস সিজারের কাছে আত্মসমর্পন করে। বিশাল সেনা থাকা সত্বেও জুলিয়াস সিজারের বুদ্ধির সামনে পরাজিত হয় গলরা। এই যুদ্ধের পর নব্বই হাজার গল যোদ্ধাকে রোমান সাম্রাজ্যের দাস বানিয়েছিল জুলিয়াস সিজার। রোমান ও গলদের মধ্যে যত যুদ্ধ হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ ছিল এই অ্যালেসিয়ার যুদ্ধ। ভেরসিনজ্যেটোরিক্স যদি খোলা ময়দানে যুদ্ধ করতো তাহলে রোমানদের সহজে পরাজিত করতে পারতো কিন্তু তাঁর এই ভুল সিদ্ধান্তের জন্য শক্তিশালী সেনা থাকা সত্বেও পরাজিত হতে হয়। এই যুদ্ধের পর জুলিয়াস সিজারের সম্মান রোমে এতটাই বেড়ে যায়, মানুষ জুলিয়াস সিজারকে রোমের শ্রেষ্ঠ জেনারেল মানতে শুরু করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *