ভারতীয় টাকা লুঠ করে অস্ত্র সংগ্রহ। কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ, তখন নরমপন্থী চিন্তাধারার উপর আস্থা হারিয়ে চরমপন্থী চিন্তাধারার প্রতি পা বাড়িয়েছিলেন বহু তরুণ-যুব সম্প্রদায়। কারণ তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে পরাধীনতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটাই উপায় – সশস্ত্র আন্দোলন। সেই সময় থেকে শুরু করে বহু গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন একের পর এক অভিযান চালিয়েছে। তার মধ্যে কিছু সফল হয়েছে আবার কিছু অসফল হয়েছে। কিন্তু সফল বা অসফল যাই হোক না কেন বিপ্লবীরা সেই অভিযানের মাধ্যমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভীত নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু বাংলা নয়, বাংলার বাইরেও এই গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনগুলি ব্রিটিশ বিরোধী অভিযান চালানোর সেই জোয়ারে ভেসেছিল। প্রথম পর্যায়ে বোমা তৈরি এবং বোমা নিক্ষেপ করা ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি ইতিহাসের পাতায় যুক্ত হয়েছিল লুণ্ঠনের ষড়যন্ত্রও। এই লুণ্ঠনের ষড়যন্ত্রের মধ্যে সর্বাগ্রে স্মরণীয় হল কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা যা ঘটেছিল বাংলার বাইরে। ভারতীয় টাকা লুঠ করে অস্ত্র সংগ্রহের উদ্যোগে এই ট্রেন ডাকাতির পরিকল্পনা করেছিলেন বেশ কিছু বিপ্লবী মিলে। পরবর্তীকালে কাকোরি ট্রেন ডাকাতির সাথে যুক্ত থাকা বিপ্লবীরা ধরা পড়ে যান। এরপর তাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক মামলা যা কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা (Kakori Conspiracy Case) নামে খ্যাত হয়ে রয়েছে।
১ মে ১৯২৬ সালে কাকোরিতে সশস্ত্র ট্রেন ডাকাতির ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় মামলা। এই মামলাটি কাকোরি ষড়যন্ত্র নামে পরিচিত। এই মামলায় অভিযুক্তদের তালিকায় নাম যুক্ত হয়েছিল – চন্দ্রধর জোহরি, চন্দ্রভাল জোহোরি, শীতলা সাহাই, জ্যোতি শঙ্কর দীক্ষিত, ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল, মন্মথনাথ গুপ্ত, দামোদর স্বরূপ শেঠ, রামনাথ পাণ্ডে, দেবদত্ত ভট্টাচার্য, ইন্দ্র বিক্রম সিং, মুকুন্দি লাল, শচীন্দ্রনাথ সান্যাল, যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জি, রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ি, শরৎচন্দ্র গুহ, কালিদাস বসু, বাবু রাম ভার্মা, ভাইরোন সিং, প্রণবেশ চ্যাটার্জি, রাম দুলারি ত্রিবেদী, গোপী মোহন, রাজকুমার সিন্হা, সুরেশ চরণ ভট্টাচার্য্য, মোহন লাল গৌতম, হরনাম সুন্দরলাল, গোবিন্দ চরণ কর, শচীন্দ্রনাথ বিশ্বাস, বিষ্ণুচরণ দুব্লিশ, বীরভদ্র তেওয়ারি, রামকৃষ্ণ ক্ষত্রী, বনোয়ারিলাল, রামপ্রসাদ বিসমিল, বানারসিলাল, লালা হরগোবিন্দ, প্রেমকৃষ্ণ খান্না, ইন্দুভূষণ মিত্র, ঠাকুর রোশান সিং, রাম দত্ত শুক্লা, মদনলাল, রাম রতন শুক্লা, আসফাকউল্লা খান, শচীন্দ্রনাথ বক্সী প্রমুখ বিপ্লবীরা। এই মামলায় ৪০ জন বিপ্লবী অভিযুক্ত হলেও এই মামলাটি শুরু হয়েছিল ২১ জন বিপ্লবীদেরকে নিয়ে। বাকি বিপ্লবীদের মধ্যে ১৭ জন বিপ্লবীকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়েছিল আর দুইজন রাজসাক্ষী হয়ে গিয়েছিলেন। এই মামলাটি উঠেছিল স্পেশাল সেশন আদালতে, বিচারের দায়িত্বে ছিলেন কুখ্যাত ব্রিটিশ বিচারপতি অ্যাণ্ড্রুজ হ্যামিলটন। আদালতের পক্ষ থেকে সওয়াল-জবাব করেছিলেন জগৎ নারায়ণ মোল্লা। দীর্ঘ আঠারো মাস ধরে চলা এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয় ১৯২৭ সালের ৬ এপ্রিল।
সাল, ১৯২৫ । রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকউল্লা খান প্রমুখরা বিপ্লবীরা বেছে নিয়েছিল সশস্ত্র বিপ্লবের পথ। কারন তাঁরা বিশ্বাস করতেন দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দেওয়ার একমাত্র মাধ্যমই হচ্ছে সশস্ত্র আন্দোলন।
১৯১৮ সালে দায়ের হয় মৈনপুরী মামলা। কয়েক বছর পর এই মামলায় বাকি অভিযুক্তদের মতো ছাড়া পেয়ে যায় রামপ্রসাদ বিসমিলও। এরপর তিনি আসেন উত্তরপ্রদেশের শাহজাহানপুরে। সেই সময় তাঁর সাথে পরিচয় হয় আসফাকউল্লা খানের। ১৯২১ সালে তাঁরা যোগদান করেন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বাধীনে ব্রিটিশ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে। স্বরাজ দলের হয়ে প্রচারকার্যেও সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন আসফাকউল্লা এবং রামপ্রসাদ বিসমিল।
চৌরিচৌরার ঘটনাটির পর গান্ধীজি অহিংস অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গান্ধীজির এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি তাঁরা।
এরপরই ১৯২৪ সালে আসফাকউল্লা খান, রামপ্রসাদ বিসমিলসহ কয়েকজন সমমনস্ক বিপ্লবীদের নিয়ে ‘হিন্দুস্তান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশন’ (Hindustan Republican Association) নামক একটি বিপ্লবী দল গঠন করা হয়। এই গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনটির মূল উদ্দেশ্য ছিল বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটানো এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে ভারতকে একটি স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা করা।
১৯২৫ সালে এই সংগঠন কর্তৃক ‘দ্য রেভলিউশনারি’ নামক একটি ইস্তাহার প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয় যে, ব্রিটিশমুক্ত স্বাধীন দেশ তৈরি করার জন্য এই সংগঠনের কাজ হল বিভিন্ন জায়গায় সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা।
৮ আগস্ট ১৯২৫ সালে রামপ্রসাদ বিসমিলের নেতৃত্বে শাহজাহানপুরে একটি সভায় পরিকল্পনা করা হয় কাকোরির কাছে ট্রেনে ডাকাতির। এই ট্রেন ডাকাতি করার মূল উদ্দেশ্যে ছিল তাদের দলের কার্যক্রম চালানো এবং অস্ত্রশস্ত্র কেনা।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯২৫ সালের ৯ আগস্ট লক্ষ্ণৌয়ের কাছে একটি গ্রাম কাকোরিতে ব্রিটিশদের ট্রেন লুঠ করেন আসফাকউল্লা খান সহ রামপ্রসাদ বিসমিল, রাজেন্দ্র লাহিড়ী, ঠাকুর রোশান সিং, শচীন্দ্র বক্সী, চন্দ্রশেখর আজাদ, কেশব চক্রবর্তী, বনোয়ারী লাল, মুরারী লাল গুপ্তা, মুকুন্দি লাল এবং মন্মথনাথ গুপ্ত প্রমুখ বিপ্লবীরা মিলে। তারা আগে থেকেই জানতে পেরে গিয়েছিলেন সেই ট্রেনেই বস্তাবন্দি ভারতীয় টাকার সম্ভার থাকার কথা। এরপর আসফাকউল্লা পালিয়ে যান নেপালে। এই ঘটনায় অনিচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা হয়েছিল একজন নিরাপরাধ ট্রেনযাত্রীকে। অভিযুক্তদের বয়ান অনুসারে জানা যায় যে ৯ আগস্ট ১৯২৫ সালের ৮ নং ডাউন ট্রেন শাহজাহানপুর থেকে লক্ষ্ণৌ আসছিল। সেই ট্রেনে উপস্থিত ছিলেন বিপ্লবী রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। কাকোরির কাছে ট্রেন আসতেই তিনি ট্রেনটি থামানোর জন্য আপদকালীন চেন টানেন। তৎক্ষণাৎ অন্যান্য বিপ্লবীরা আটক করে প্রহরীদের এবং ওই ট্রেনে উপস্থিত অন্যান্য বিপ্লবীরা প্রহরীদের কেবিনে রাখা টাকা ভর্তি তিনটি ব্যাগ লুঠ করে। তাঁরা তৎকালীন সময়ে ভারতীয় মুদ্রায় মোট চার হাজার ছয়শো টাকা লুঠ করেছিলেন।
পরবর্তী অংশ খুব শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে।