ফিচার আর্টিকেল

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের শহীদদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান গ্রহণ করেছিলেন। বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত

“আমিই নরেন গোঁসাইকে দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য হত্যা করেছি” নির্ভয় মনে ২০ বছরের এই যুবকটি স্বীকার করে নেয় নিজের দোষ। অগ্নিযুগের এই অকুতোভয় বিপ্লবী হলেন কানাইলাল দত্ত। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের শহীদদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর অবদান একটি মাইলফলক হয়ে রয়েছে গেছে ইতিহাসের পাতায়।

কানাইলাল দত্ত নামে সমাধিক পরিচিত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম ছিল সর্ব্বোতোষ দত্ত। তাঁকে আদর করে ডাকা হত কানাইলাল বলে, কারন তিনি জন্মাষ্টমীর রাতে অর্থাৎ ১৮৮৮ সালের ৩১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি অবিভক্ত পশ্চিমবঙ্গের হুগলীর চন্দননগরে জন্মগ্রহণ করলেও, তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতে খড়ি হয়েছিল মুম্বাইয়ের গিরগাঁও আর্য এডুকেশন সোসাইটি বিদ্যালয়ে। কারন তাঁর বাবা চুনীলাল দত্ত পেশায় নৌ দপ্তরের হিসাবরক্ষক ছিলেন এবং তার কাজের জন্য তাকে বোম্বেতে (অধুনা মুম্বাই) থাকতে হত। তাঁর মা ছিলেন ব্রজেশ্বরী দেবী। পরবর্তীকালে তিনি পুনরায় ফিরে আসেন তাঁর জন্মভুমিতে। এরপর তিনি চন্দননগর ডুপ্লেক্স বিদ্যামন্দির থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে ভর্তি হয়েছিলেন হুগলীর মহসিন কলেজে। ১৯০৮ সালে তিনি বি.এ. পরীক্ষায় পাশ করলেও সেই সময় তাঁকে ডিগ্রি প্রদান করতে বাধা দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার, কারন সেই সময় তাঁর বিরুদ্ধে উঠে ছিল বিপ্লব ও রাজদ্রোহিতার অভিযোগ। অবশেষে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই ডিগ্রি  অর্জন করেছিলেন। 

কলেজে পড়াকালীন সময়ে তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছিল চারুচন্দ্র রায়ের। চারুচন্দ্র রায় ছিলেন তৎকালীন সময়ে চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজের অধ্যক্ষ তথা চন্দননগরে বিপ্লবচিন্তার অধিনায়ক। তিনিই কানাইলালকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদানের জন্য উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন। এরপর থেকেই কানাইলালের জীবনে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন চলাকালীন কানাইলাল দত্ত চন্দননগর শাখায় যোগ দান করেন, এবং ১৯০৫ সালে তিনি ওই শাখার একজন প্রধান সদস্য হয়ে ওঠেন। ওই সময় শ্রীশচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে পরিচালিত গোন্দলপাড়া বিপ্লবী দলের সঙ্গেও পরিচিত হন তিনি। এরপর  ১৯০৮ সালে কলকাতায় পা রাখেন কানাইলাল এবং যোগ দেন তৎকালীন কলকাতার অন্যতম সশস্ত্র বিপ্লবী দল যুগান্তরে। 

১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল মুজফফরপুর বোমা মামলায় কিংসফোর্ডকে হত্যা করার ঘটনায় প্রধান দুই অভিযুক্ত ধরা পড়ে যায়। এরপর সারা বাংলা জুড়ে শুরু হয় তল্লাশি। তল্লাশিতে ২ মে পুলিশ আবিষ্কার করে কলকাতার ৩২ মুরারি পুকুর রোডে একটি বোমা  কারখানা। সেখানে অস্ত্রশস্ত্র, বোমা, বোমা বানানোর বিভিন্ন জিনিসপত্র সহ বিপ্লবী কার্যকলাপের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু নথিও উদ্ধার করে ব্রিটিশ পুলিশ। সেই সূত্র ধরেই পুলিশের হাতে চলে আসে বহু বিপ্লবীদের নাম। ওই সময় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, ইন্দুভূষণ রায়, নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ওরফে নরেন গোসাঁই  এবং অন্যান্য প্রচুর বিপ্লবীদের। এই নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী ওরফে নরেন গোসাঁই পরবর্তীকালে পুলিশের রাজসাক্ষী হয়ে যান এবং ফাঁস করে দেন আরো অনেক বিপ্লবীদের নাম যার ফলে অন্য অনেক বিপ্লবীদের কারাবরণ করতে হয়েছিল। এই ২ মে তারিখেই সরকারের বিরুদ্ধাচরনের তালিকায় অন্যান্য সশস্ত্র বিপ্লবীদের মতো কানাইলাল দত্তেরও নাম যুক্ত হয়। তাঁকে গ্রেফতার করার পর নিয়ে আসা হয় আলিপুর জেলে।

নরেন গোঁসাই নিজেই ছিলেন সশস্ত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত। তাই তাঁর কাছে বিপ্লবীদের পরিকল্পনা ও কার্যকলাপ সম্পর্কে জ্ঞান থাকাটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। তিনি থাকতেন চন্দননগরের কাছেই শ্রীরামপুরে। পরবর্তীকালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বিপ্লবীদের কাছে বিশ্বাসঘাতক। কারণ তিনি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সাক্ষী হিসেবে ফাঁস করে দেয় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে একাধিক সশস্ত্র বিপ্লবী পরিকল্পনা তথা সেই পরিকল্পনার সাথে জড়িত বিপ্লবীদের নামও। এই বিপ্লবীরা এক সময় ছিল তাঁরই সহকর্মী। তাদের নামই একে একে ফাঁস করে দেন নরেন গোঁসাই। অভিযুক্তদের তালিকায় যোগ হয় বারীন ঘোষ, শান্তি ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, চারুচন্দ্র রায়, অরবিন্দ ঘোষ, সুবোধ মল্লিকের নাম। এরপর বারীন ঘোষের নেতৃত্বে কিছু বন্দী বিপ্লবীরা আলিপুর জেল থেকে পালাবার পরিকল্পনা করতে থাকেন এবং নরেন্দ্রনাথ গোঁসাইয়ের থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

এরপর জেলের মধ্যেই শুরু হয় একটি নতুন পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনাটি পরিচালনা করছিলেন বারীন ঘোষ। তিনি বি.সি.রায়ের সঙ্গে দেখা করে অস্ত্রের ব্যবস্থা করে রাখার জন্য জেল থেকে চিঠি লেখেন চন্দননগরের সুধাংশু জীবন রায়, প্রিয় শঙ্কর রায় এবং বসন্ত ব্যানার্জীকে।  এরপর তিনি  শ্রীশচন্দ্র ঘোষকে আনতে বলেন জেলের ওয়ার্ডেনের গায়ে ছোঁড়ার জন্য ছোটো কাঁচের বোতল, অ্যাসিড, চাবি নকল করার জন্য মোম ইত্যাদি জিনিসপত্র। ২৩ আগস্ট জেলে একটি বন্দুক পাঠানো হয় সুধাংশু জীবন রায়ের মাধ্যমে। বারীন ঘোষ সেই বন্দুকটি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর হাতে তুলে দেওয়ার দায়িত্ব দেন হেম দাসকে। সেই সময় সত্যেন্দ্রনাথ বসু জেলের হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এই বন্দুকটি বড় হওয়ায় তিনি না সামলাতে পারার কারণে ফিরিয়ে দেন। এরপর ৩১ আগস্ট বারীন ঘোষের কাছে আগের তুলনায় ছোটো আরেকটি বন্দুক পৌঁছে দেয় শ্রীশচন্দ্র ঘোষ। আর এই বন্দুকটি কানাইলাল নিজের কাছে রেখে দেন। এরপর তিনিও ভর্তি হন জেলের হাসপাতালে।

অন্যদিকে নরেন্দ্রনাথকে রাখা হয়েছিল আলিপুর জেলের ইউরোপিয়ান ওয়ার্ডে, অন্যান্য অভিযুক্তদের থেকে আলাদা করে। ইউরোপীয় বন্দী উপদর্শক হিগিন্সের তত্ত্বাবধানে নরেন্দ্রনাথকে ১৯০৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর নিয়ে আসা হয় জেলের হাসপাতালে। ইতিমধ্যে সেখানে উপস্থিত ছিল কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাদের দুজনের কাছেই ছিল দুটি বন্দুক। এই দুটি বন্দুক জোগাড় করা হয়েছিল শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, মোতিলাল রায়ের মাধ্যমে।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ব্রিটিশ সরকারকে কোন বিশেষ কথা জানাতে চান এই তথ্যটি নরেনের কাছে পৌঁছে দেয় জেলকর্মী অনুরূপ দাস। এরপরে নরেনকে আনা হয় সত্যেন্দ্রনাথের মুখোমুখি। এই তথ্যটি ছিল আসলে একটি পাতা ফাঁদ। তাঁরা আসলে নরেনকে হত্যা করার জন্য নিজেদের হাতের মুঠোর মধ্যে আনতে চেয়েছিলেন। এরপরই হাসপাতালের দোতলার সিঁড়িতে নরেন পা দেওয়া মাত্রই কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর উপর চালায় গুলি। তাঁদেরকে গ্রেপ্তার করতে এলে তাদের গুলিতে আহত হন হিগিন্স। এরপর গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে পালাতে থাকেন নরেন। তাঁকে ধাওয়া করে কানাইলাল এবং পিছন দিক থেকে তাঁর উপর গুলি চালায়।

নরেন গোঁসাইয়ের হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ছিল ভারতের সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে অদ্বিতীয়। এরপর ১৯০৮ সালের ২১ অক্টোবর নরেন গোঁসাইয়ের হত্যাকান্ডের রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট। এই রায়ে দুজন বিপ্লবীকেই ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

কানাইলাল দত্ত তাঁর মৃত্যুর আদেশে ক্ষণিকের জন্যও ভেঙে পড়েননি। উল্টে গর্বের সাথে নিজের দোষ স্বীকার করে বলেছিলেন যে তিনি নরেন গোঁসাইকে দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য হত্যা করেছেন।

তিনি কোনও আইনি সাহায্য নিতে রাজি ছিলেন না, পাশাপাশি তিনি উচ্চতর আবেদন করার ক্ষেত্রেও স্পষ্ট নিষেধ করেছিলেন। কানাইলাল আবেদনে লিখেছিলেন যে “There shall be no appeal”। এটি শুনে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন, কানাই আমাদের  “Shall আর will এর ব্যাবহার টা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে গেল হে !”

বিচারক তাঁকে প্রশ্নের করে যে কে নরেনকে খুন করেছে?  তখন তিনি বিচারক জানান যে – “সে এবং সত্যেন গোঁসাইয়ের জীবননাশের জন্য দায়ী।”

পুনরায় তাঁকে বিচারক প্রশ্ন করে যে তিনি তাঁর বক্তব্যে স্থির থাকতে চান কিনা? সেই সময় তাঁর উত্তর একই কথা ছিলেন, তবে সেই সময় তিনি তাঁর বক্তব্য থেকে বাদ দিয়ে দেন সত্যেনের নাম এবং তিনি বলেছিলেন যে – “I wish to state that I did kill him. I do not wish to give any statement why I killed him. Wait, I do wish to give a reason. It was because he was a traitor to his country.”

মৃত্যুদণ্ডের আদেশ তিনি গর্বের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় তাঁর মধ্যে কোনরকম চিন্তা বা  বিষাদের লেশমাত্র দেখা যায় নি। শেষ কয়েকদিন তিনি কারও সাথে দেখা করেননি শুধুমাত্র তাঁর ভাই ছাড়া এবং তিনি তাঁর ভাইকে বলে গিয়েছিলেন যে, যেন কোনও পুরোহিত তাঁর শেষকৃত্যের আচার অনুষ্ঠান না করেন।

অবশেষে ১০ নভেম্বর ১৯০৮ সালে সকালবেলায় ফাঁসির মঞ্চে ওঠানো হয় কানাইলাল দত্তকে। ঠিক সাতটা বাজতে ফাঁসির হাতলে টান পড়ে। সেই সময়ই দেশ হারিয়ে ফেলে আরেক বীরযোদ্ধা  কানাইলাল দত্ত ওরফে সর্ব্বোতোষ দত্তকে। 

“এমন আরও কতজন আছে কানাইয়ের মত?” শোনা যায় এই কথাটি পরে বারীন ঘোষকে বলেছিলেন কানাইয়ের  ফাঁসির সময় উপস্থিত থাকা এক ব্রিটিশ পুলিশ অফিসার। 

কানাইলাল দত্তের  মৃত্যুর প্রায় পনেরো বছর পর মতিলাল রায় তাঁর শেষযাত্রা নিয়ে একটি স্মৃতি পুস্তিকা লিখেছিলেন। যা ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই পুস্তকে কানাইলালের সম্পর্কে তিনি  লিখেছেন‚ “কম্বল সরাতেই দেখা গেল কানাইলাল শুয়ে আছেন। তাঁর  কপালে লম্বা চুল এসে পড়েছে। দুটি অর্ধনিমীলিত চোখ দেখে মনে হছে তিনি অমৃতসুধা পানের স্বাদ লাভ করেছেন। দৃঢ় বদ্ধ ওষ্ঠ এবং দুই হাত মনে করিয়ে দিচ্ছে জীবনপণ। নিথর দেহে কোথাও একটুও মৃত্যুকষ্ট নেই।” তবে এই পুস্তিকাটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল মতিলালের সেই পুস্তিকাটি।

দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিতে নিজের জীবনকে সংগ্রামে পরিনত করেছিলেন। দেশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের জীবনকে। কানাইলাল দত্ত এই নামটি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো। কিন্তু তাঁর নাম এবং তাঁর অবদান  ইতিহাসের পাতায় লাইন হয়ে রয়েছে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *