অফবিট

ইহুদিরা হার মানতে শেখেনি

ইহুদিদের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিমান জাতি বলা হয়। নোবেল পুরস্কারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে ইহুদিদের জয়জয়কার। তবে ইহুদিদের ইতিহাস খুবই যন্ত্রনাদায়ক। একটা সময় তাদের নিজেদের ভূমি থেকেই তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা আশ্রয় নিয়েছিল। ইহুদিরা তাদের অসাধারন বুদ্ধি এবং কঠোর পরিশ্রমের দ্বারা সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠেছিল সেসব দেশে। যার ফলে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা প্রচুর অত্যাচারিত হয় তারা ইউরোপে। ইহুদিদের উপর সবচেয়ে অত্যাচার হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান নাজি সেনা দ্বারা। অ্যাডলফ হিটলারের নাজি সেনা লাখ লাখ ইহুদিদের গনহত্যা করে, ইতিহাসে এই ঘটনা হলোকাস্ট নামে কুখ্যাত। কিন্তু তাও ইহুদিরা হার মানেনি। 

নিজেদের জন্য স্বাধীন দেশ ইসরায়েল গঠন হবার পরও আশেপাশের আরব দেশগুলো জোটবদ্ধ ভাবে বারবার আক্রমন করেছে ইসরায়েলকে কিন্তু প্রতিবার লজ্জাজনক পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে আরব দেশগুলো। আজ ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের সুপার পাওয়ার। সামরিক দিক দিয়ে আরব দেশগুলোর থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে ইসরায়েল। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে বিশ্বের সবচেয়ে ঘাতক ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক বলা হয়। বর্তমানের আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করতে বাধ্য হছে। স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই প্রতিবেশীদের দ্বারা আক্রমনের শিকার দেশটি রাতারাতি সুপার পাওয়ার হয়ে যায়নি, এর পেছনে অনেক পরিশ্রম ও ত্যাগ রয়েছে। 

মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকট হচ্ছে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের বিবাদ। ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে যত যুদ্ধ হচ্ছে তার মধ্যে অপারেশন ইনফের্নো অন্যতম। 

১৯৬৮ সালের ২১ মার্চ ইসরায়েল অপারেশন ইনফের্নো শুরু করে প্যালেস্টাইন ও জর্ডানের সন্ত্রাসী সংগঠনের বিরুদ্ধে, একে কারামেয়ের যুদ্ধও বলা হয়।

১৯৪৮ এ প্রথম আরব ইসরায়েল যুদ্ধ হয় যাতে ইসরায়েল জিতে যায়। এরপর ইসরায়েল নিজেকে আরও শক্তিশালী করতে শুরু করে। ইসরায়েলের আশেপাশে যেসব দেশ আছে যেমন জর্ডান, লিবিয়া, ইরাক, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন এসব দেশের আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক কাঠামো অস্থিতিশীল। কিন্তু ইসরায়েল যেমন সামরিক শক্তিশালী তেমনই ইসরায়েলের প্রশাসনিক ব্যবস্থাও মজবুত। 

১৯৪৯ থেকে ১৯৬৭ এর মধ্যে ইসরায়েলের পাশে গোলান হাইটস ছিল সিরিয়ার অধীনে, এছাড়াও সিনাই পেনিনসুলা, গাজা উপত্যকা ছিল মিশরের অধীনে এবং ওয়েস্টব্যাঙ্ক ছিল জর্ডানের অধীনে। অর্থাৎ ইসরায়েলের চারদিকের স্ট্রাটেজিক ভাবে গুরুত্বপূর্ন এলাকাগুলো চারটি দেশের অধীনে ছিল। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন ইসরায়েল ও আরবদেশ গুলোর মধ্যে বিখ্যাত ছয়দিনের যুদ্ধ শুরু হয় যাতে ইসরায়েল এই সমস্ত জায়গা দখল করে নেয়। মাত্র ছয়দিনের যুদ্ধে আরব দেশগুলোর শোচনীয় পরাজয়ের পর মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সুপার পাওয়ার হয়ে ওঠা শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা ছিল। এইসময় প্যালেস্টাইনের রাজনীতিতে একজন সক্রিয় নেতা ছিল ইয়াসির আরাফত যে ১৯৫৯ সালে ফতেহ নামে একটি সংগঠন তৈরি করে যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কাজ করে। 

১৯৫৯ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ইয়াসির আরাফত তার মৃত্যু পর্যন্ত সে এই ফতেহ সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিল। ১৯৬৪ সালে আরব লীগ পিএলও বা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন তৈরি করে। ১৯৬৯ সালে এই পিএলও এর প্রধানের দায়িত্বও দেওয়া হয় ইয়াসির আরাফতকে। এই ফতেহ এবং পিএলও দুই সংগঠনই প্রথমে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে কাজ করা শুরু করে। পরে ফাতেহ প্যালেস্টাইনের একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে গড়ে ওঠে। 

১৯৬৭ সালে ছয়দিনের যুদ্ধে ইসরায়েলের কাছে সবচেয়ে শোচনীয় পরাজিত হয় জর্ডানের। আরব দেশগুলো বুঝে যায় তারা সরাসরি ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধে পারবেনা। তখন তারা ইয়াসির আরাফতকে বেছে নেয় ইসরায়েলের উপর লুকিয়ে আক্রমন করার জন্য। ইয়াসির আরাফত ও তার সাথীরা জর্ডান নদী পেড়িয়ে জর্ডানের কারামেয় শহরে এসে আশ্রয় নেয়। এখান থেকে তারা ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর ঘাঁটিতে লুকিয়ে আক্রমন করা শুরু করে। শুধু ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর উপরই নয় বরং সাধারন মানুষের উপরও আক্রমন হতে থাকে। বাস জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা হতে থাকে। ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ইয়াসির আরাফতের সংগঠন চল্লিশ এরও বেশী সন্ত্রাসবাদী হামলা করে ইসরায়েলের উপর। তারা গোরিলা আক্রমন করতো ফলে তাদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যেত। 

১৯৯৪ সাল পর্যন্ত পিএলও পুরোপুরি সন্ত্রাসী সংগঠন ছিল, বিমান হাইজ্যাক, আত্মঘাতী বিস্ফোরনের জন্য তারা কুখ্যাত ছিল। পিএলওকে মিশর, জর্ডান পূর্ন সমর্থন করতো সেসময়। মোসাদের মাধ্যমে ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ খবর পায় জর্ডানের কারামেয়তে রীতিমতো ঘাঁটি তৈরি করে সেখান থেকে তাদের উপর আক্রমন করা হচ্ছে। যার ফলে ১৯৬৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর আইডিএফ কারামেয়তে অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় যার নাম দেওয়া হয় অপারেশন ইনফার্নো। তবে আইডিএফ শেষপর্যন্ত এই অভিযান বাতিল করে দেয় কারন ছয়দিনের যুদ্ধ শেষ হবার পর জাতিসংঘের নির্দেশ অনুযায়ী ইসরায়েল ও জর্ডান উভয়দেশই নিজেদের সীমানা অতিক্রম করতে পারবেনা। কারামেয় জর্ডানে হওয়ায় ইসরায়েল বারবার অভিযানের পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়।

১৯৬৮ সালের ১২ মার্চ মোসাদ আইডিএফকে জানায় ফতেহ আরও একটি আক্রমনের পরিকল্পনা করছে। ১৮ মার্চ ইসরায়েলের একটি স্কুল বাসে বিস্ফোরন ঘটায় ফতেহ যাতে দুজনের মৃত্যু হয় এবং দশজন আহত হয়। এই ঘটনার তিনদিন পরই অপারেশন ইনফার্নো শুরু করে দেয় ইসরায়েল। জর্ডানকে বারবার ইসরায়েল জানায় ফতেহকে সমর্থন না করতে কিন্তু জর্ডান ফতেহকে পূর্ন সমর্থন দেয়। জর্ডান রীতিমতো সেনাবাহিনী পাঠিয়ে দেয় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। ২১ মার্চ ভোর বেলায় ইসরায়েল ও জর্ডানের মধ্যে কারামেয়ের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইসরায়েল প্রথমেই জর্ডান ও ইসরায়েলের মাঝে গুরুত্বপূর্ন সেতু গুলো দখল করে নেয়। তবে যুদ্ধের শুরুর দুই ঘন্টায় ইসরায়েল তেমন কোন সুবিধা করতে পারেনি। ইসরায়েলের সমস্ত আক্রমনই ব্যর্থ হয়ে যাছিল। ইসরায়েল বায়ুসেনার বোমারু বিমান গুলোর বোম্বিংএও তেমন কোন ক্ষতি হচ্ছিলনা জর্ডানের। তবে সকাল আটটার পর থেকে ইসরায়েল তাদের আক্রমন আরও জোরদার শুরু করে যার ফলে জর্ডান সহ ফতেহর ব্যাপক ক্ষতি হয়। কারামেয়তে ফতেহর সমস্ত আস্তানা ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল সেনাবাহিনী। তবে ইয়াসির আরাফত কোনওরকমে পালিয়ে যায়। এই কারামেয়র যুদ্ধ মাত্র পনেরো ঘন্টা চলেছিল কারন এরপর আন্তর্জাতিক চাপে বিশেষ করে জাতিসংঘে নির্দেশে ইসরায়েল সেনাবাহিনী ফিরে আসতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে দুপক্ষেরই ব্যাপক ক্ষতি হয়, জর্ডানের পক্ষে ক্ষতি বেশী হয়। কারামেয়র যুদ্ধে ইসরায়েলের ৩৩ জন সেনা মারা যায়, ১৬১ সেনা আহত হয়, ৩১ টি ট্যাঙ্ক, চারটি সামরিক গাড়ি, একটি বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে জর্ডানের ৮৪ জন সেনা মারা যায়, ২৫০ জন আহত হয়, চারজন সেনা গ্রেপ্তার হয়, ৩০ টি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়ে যায়। পিএলও এর ১৫৬ জনের মৃত্যু হয়, ১০০ এর বেশী আহত হয়, ১৪১ জনকে গ্রেফতার করে ইসরায়েল। কারামেয়তে এই যুদ্ধে ১৭৫ টি বাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। কারামেয়র যুদ্ধে কোমড় ভেঙে যায় ফতেহর। তবে এই যুদ্ধে কারোরই জিত হয়নি। জাতিসংঘ ও আমেরিকার চাপে ইসরায়েল সেনাবাহিনী ফিরে না গেলে হয়ত ফলাফল ইসরায়েলের পক্ষেই যেত। দু’পক্ষই এই যুদ্ধে নিজেদের জয়ী বলে দাবি করে। ইয়াসির আরাফত পালিয়ে যাওয়ায় পিএলও প্রোপাগান্ডা শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই আরও দশ থেকে পনেরো হাজার যুবক পিএলওতে যোগ দেয়। সিরিয়া ও ইরাক এদের প্রশিক্ষনের প্রস্তাব দেয়। এর পরবর্তী দশকে পিএলও আরও বেশী করে সন্ত্রাসী কাজকর্ম শুরু করে। জর্ডানকে রীতিমতো তাদের নিরাপদ আশ্রয় বানিয়ে নিয়েছিল পিএলও। জর্ডানে পিএলও এর প্রভাব এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে সেপ্টেম্বর, ১৯৭০ আসতে আসতে জর্ডানের রাজা হুসেন সিংহাসন ছেড়ে দেবার কথা পর্যন্ত ভেবেছিল। শেষপর্যন্ত মিশরের মধ্যস্থতায় ইয়াসির আরাফত জর্ডান ছাড়তে বাধ্য হয়।

১৯৮১ সালে ইসরায়েল ও মিশরের মধ্যে শান্তি চুক্তির পর পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়। এরপর ফতেহ এবং পিএলও ধীরে ধীরে প্যালেস্টাইনের রাজনৈতিক দলে পরিনত হয়। ১৯৮০ এর দশকে প্যালেস্টাইনে হামাস নামে একটি উগ্র সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি হয় যারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কাজকর্ম শুরু করে। তবে এর সাথে পাল্লা দিয়ে ইসরায়েলও নিজেকে শক্তিশালী করে চলছে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *