স্বাধীনতার জন্য নিজের সব সোনার গয়না দিয়েছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামী মনোরমা বসু
সাল ১৯০৫, তখন মনোরমার বয়স মাত্র আট বছর। ওই বয়সেই আনুষ্ঠানিকভাবে হাতেখড়ি হয় স্বদেশী আন্দোলনের। তখন স্বদেশীরা রাস্তায় বঙ্গভঙ্গরদের উদ্দেশ্যে গান গেয়ে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল তখন তা দেখে মনোরমা খুবই আপ্লুত হন। তিনি সেই মিছিলেই হাতে হলুদ রাখি বেঁধে দীক্ষা নেন স্বদেশী আন্দোলনের। এরপর যখন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুকে ১৯০৮ সালে ফাঁসি দেওয়া হয় তখন তাঁর মনে সৃষ্টি হয় প্রবল আলোড়ন। তিনি নিজেকে আরো সক্রিয় করে তোলেন বিপ্লবী আন্দোলনে। ওই বছরই মৃত্যু হয় তাঁর বাবার। সংসারে সৃষ্টি হয় নানা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির। ওই অবস্থাতেই মাত্র তের বছর বয়সে তাঁর সাথে বরিশালের বাঁকাই গ্রামের বিপত্নীক জমিদার চিন্তাহরণ বসুর বিয়ে হয়।
১৯২৫ সালে বরিশালে রাজনৈতিক প্রচার করতে আসেন মাহাত্মা গান্ধী। তাঁকে দেখার জন্য বরিশাল শহরে আসেন গ্রামের মেয়েদের দলবলসহ মনোরমা বসু। সকলকে আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহের জন্য আহ্বান জানান গান্ধী। গান্ধীর সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে ওইদিন বাড়ি থেকে পরে আসা সোনার গহনা সেই তহবিলে দান করে দেন মনোরমা বসু।
বরিশালে গান্ধীর সাথে তাঁর এই সাক্ষাৎ তাঁকে আরো উজ্জীবিত করে তোলে। ব্রিটিশদের শাসন থেকে ভারতবর্ষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে এবং বিপ্লবী মাসিমা নামে পরিচিতি লাভ করেন মনোরমা বসু। তিনি সারাজীবন ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য আন্দোলনের পাশাপাশি আন্দোলন করে গেছেন মানুষের মুক্তির জন্যও। বরিশাল শহরে নিজ বাড়িতেই ‘মাতৃমন্দির’ গড়ে তোলেন। কুমারী মা, স্বামী পরিত্যক্তা, বিপথগামী ও আশ্রয়হীনা মেয়েদের আশ্রয়স্থল ছিল এই ‘মাতৃমন্দির’ এবং অসহায় মেয়েদের স্বাবলম্বী করার জন্য গড়ে তোলেন ‘নারী কল্যাণ ভবন’, ‘মুকুল-মিলন খেলাঘর আসর’ শিশু- কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য, ‘পল্লীকল্যাণ অমৃত পাঠাগার’ সাধারণ মানুষের জ্ঞানের জন্য এবং নারী জাগরণ ও নারী অধিকার রক্ষার জন্য গড়ে তোলেন ‘নারী আত্মরক্ষা সমিতি’, ‘মহিলা সমিতি’ ও ‘মহিলা পরিষদ’সহ নানা সংগঠন।
১৮৯৭ সালের ১৮ নভেম্বর, বরিশাল জেলার বানাড়ীপাড়া থানার নরোত্তমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মনোরমা রায়। তাঁর বাবা ছিলেন নীলকন্ঠ রায় এবং মা ছিলেন প্রমদাসুন্দরী রায়। তিনি ছিলেন তাঁর বাবা-মা’র পঞ্চম সন্তান। মাত্র তেরো বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর।
মনোরমা বসু ছিলেন জমিদার বাড়ির বউ। কিন্তু তাঁর জন্য তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনরকম বাধা পড়তে দেননি। বরং তিনি গ্রামে থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক খবরা-খবর রাখতেন এবং তাতে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯২৫ সালে বরিশালে রাজনৈতিক প্রচার করতে আসা মাহাত্মা গান্ধী সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর তিনি মনে করেন যে, রাজনৈতিক আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে হলে গ্রামে বসে খুব বেশি কাজ করা সম্ভব হবে না। তাই তিনি ওই বছরই বরিশাল শহরের কাউনিয়া শাখা সড়কে জমি কিনে একটি বাড়ি তৈরি করেন এবং সেখানে চলে আসেন সপরিবারে। ওই বছরই কংগ্রেসে যোগ দেন। কাজ শুরু করেন মহিলা সমিতি গড়ে তোলার জন্য।
ভারতে কংগ্রেসের ডাকে ১৯৩০ সাল থেকে শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন। তখন আইন অমান্য আন্দোলনে বরিশালের প্রায় সকল নেতাই গ্রেফতার হন। ওই অবস্থায় তিনি ২৬ জানুয়ারি পার্টি অফিসের ছাদে তুলে দেন পতাকা। অন্য দিকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে চলতে থাকে আন্দোলন। ২ ফেব্রুয়ারি মিছিল বের করলে পুলিশ তাতে আক্রমণ চালায়। এর প্রতিবাদে বরিশালে ৩ ফেব্রুয়ারি হরতাল আহ্বান করা হয়। হরতালে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তাঁর জীবনে এটাই ছিল প্রথম কারাবরণ।
১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন মনোরমা। ১৯৪৩ সালে কলকাতা শহরের মতো বরিশালেও মনোরমা বসু গড়ে তোলেন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। এর প্রথম সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি। ওই সময় বাংলায় দেখা দেয় ব্যাপক দুর্ভিক্ষ। ওই দুর্ভিক্ষের সময় নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য তিনি কয়েকটি স্থানে চালু করেন লঙ্গরখানা। ওই বছরের ৮ মে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় কলকাতায়। সেই সম্মেলনে তিনি বরিশাল জেলার প্রতিনিধিত্ব করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মনোরমা বসুর নেতৃত্বে ও আগ্রহে পরবর্তী বছর দ্বিতীয় সম্মেলন মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির অনুষ্ঠিত হয় বরিশালেই।
১৯৪৫ সালে সংগঠনটির তৃতীয় সম্মেলন কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় এবং এর কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন তিনি। ওইসময় তিনি নোয়াখালীতে যে দাঙ্গা হয়েছিল সেখানে প্রায় নয় মাস একনাগাড়ে কাজ করেন। তাঁর সাথে ছিলেন ইলা মিত্র, আবদুল্লাহ রসুল, ডা. রমেশ ব্যানার্জী, বিভা দাসগুপ্ত ও নৃপেন সেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নতুন শাসকদের শাসন ও শোষণ বিপর্যস্ত করে তোলে জনজীবনকে। এই জন্য তিনি ১৯৪৮ সালে বরিশালের খাদ্য-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। যার ফলে তাঁকে এক বছর সশ্রম কারাদন্ড ভোগ করতে হয়েছিল এবং সে সাথে জননিরাপত্তা আইনে আরও তিন বছর কারাদন্ড ভোগ করতে হয়েছিল। ২৫ এপ্রিল ১৯৫২ সালে মুক্তি পান তিনি। ১০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালের মৃত্যু হয় তাঁর স্বামীর। এরপর তিনি কিছুটা সময়ের জন্য বিচলিত হয়ে পড়েন, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই কাটিয়ে ওঠেন সে আঘাত। পুনরায় ফিরে আসেন তাঁর কর্মকান্ডে।
১৯৫৪ সালে তৎকালীন সময়ে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে আত্মগোপন করেন মনোরমা বসু এবং সেই অবস্থা থেকে তাঁর আত্মপ্রকাশের পর তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন ‘মাতৃমন্দির আশ্রম’-এর কাজে। সেই সাথে আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়, পল্লিকল্যাণ অমৃত পাঠাগার (শহীদ অমৃতলালের নামে), এবং শিশুদের জন্য মুকুল মিলন খেলাঘর গড়ে তোলেন। তাঁর অবর্তমানে মাতৃমন্দিরের কার্যনির্বাহ করার জন্য তিনি তাঁর নিজের সমস্ত সম্পত্তি দান করে গিয়েছিলেন মন্দিরের নামে।
১৯৬২ ও ৬৪’ সালের গণ আন্দোলন এবং ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি মহিলাদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামেও। দেশপ্রেম, সমাজসেবা ও মানুষের প্রতি ভালবাসার কারণে তাঁকে দলমত-নির্বিশেষে সকলে ‘মাসীমা’ বলে ডাকত। দেশ স্বাধীন হওয়ায় বেশ স্বস্তি পান তিনি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশে। পুনরায় যোগ দেন সংগঠনের কাজে । এরই মধ্যে পার্টির কমিউন হিসেবে মাতৃমন্দিরে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তিনি নলিনী দাস, মুকুল সেনসহ বেশি কিছু পার্টি-নেতার দেখাশোনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি পাশে দাঁড়ান দুর্ভিক্ষপীড়িতদের। এরই মধ্যে তিনি আন্দামান যান স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে যান সোভিয়েত নারী কমিটির আহ্বানে। ১৯৮০ সালের পর থেকে তাঁর দিনগুলো কেটেছে কখনো মেয়ের বাড়ি, কখনো নিজের বাড়িতেই। সত্যেন সেন প্রকাশিত করেন তাঁর জীবদ্দশাতেই মনোরমা মাসীমা গ্রন্থটি। ১৬ অক্টোবর ১৯৮৬ সালে বরিশালের মাতৃমন্দিরে মৃত্যুবরন করেন তিনি।