জাপানের রননীতি বদল। লাভ হতে পারে ভারতবর্ষের
আমেরিকার বিখ্যাত মিটিওরলজিস্ট এডওয়ার্ড নর্টন লরেন্জ বলেছেন এই মহাবিশ্বের সবকিছু একে অপরের সাথে যুক্ত। আরও ভালভাবে বললে বলা যায় এই বিশ্বে ছোট,বড় যাই ঘটনা ঘটুক না কেন সেগুলো পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক যুক্ত। বর্তমানে ঘটা কোন ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যতে কোন বড় ঘটনা ঘটতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে প্রথমে ঘটনাগুলির মধ্যে কোন মিল খুঁজে না পাওয়া গেলেও সেগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত, একে বাটারফ্লাই এফেক্ট বলা হয়। যেমন ১৯১৪ সালের ২৮ জুন ইউরোপের সারাভেজোতে অস্ট্রিয়ার ডিউক ফ্রান্জ ফার্ডিনান্ডকে হত্যা করা হয় যার ফলস্বরূপ গোট ইউরোপ এক প্রানঘাতী যুদ্ধের সম্মুখীন হয়, এরই নাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। বিখ্যাত স্কটিশ চিকিৎসক আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর পেনিসিলিন আবিষ্কারের ঘটনাও ঠিক এমনই। আলেকজান্ডার ফ্লেমিং বারবার ব্যর্থ হয়ে তাঁর পরীক্ষাগার তালা দিয়ে বেড়াতে চলে যান, ফিরে এসে তার ল্যাবের পেট্রি ডিশে পেনিসিলিনের খোঁজ পান যা চিকিৎসা বিজ্ঞানকে পুরো বদলে দেয়। ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও বাটারফ্লাই এফেক্টের প্রভাব রয়েছে।
২০২২ এ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয় এবং রাশিয়া পরমানু যুদ্ধের হুমকী দিতে থাকে। এই ঘটনা লক্ষ্য করে চীন ও উত্তর কোরিয়াও পরস্পর সামরিক অনুশীলন শুরু করে এবং দক্ষিন চীন সাগর থেকে শুরু করে প্রশান্ত মহাসাগরেও পরমানু হামলার সংকট তৈরি হতে থাকে। এর ফলে এশিয়ার একটি ঘুমন্ত দেশ তার রননীতি বদলে ফেলেছে। সেই দেশটি ২০১১ সাল থেকে চলা তাদের পরমানু শক্তি নীতির আমুল পরিবর্তন এনেছে। দেশটি হচ্ছে জাপান। এসব ঘটনা বা বাটারফ্লাই এফেক্ট জাপানের ক্ষেত্রে কিভাবে প্রযোজ্য সেই ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান দুটি সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ নিয়েছিল। প্রথমত সামরিক নীতি। জাপানের সামরিক নীতি সম্পর্কে জানতে গেলে প্রথমে জাপানের ইতিহাস সম্পর্কে একটু জানা দরকার। সময়টা ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের। জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের উপর আমেরিকা লিটল বয় ও ফ্যাট ম্যান নামে দুটি পরমানু বোম্ব ফেলে যার ধ্বংসলীলার সাক্ষী থাকে গোটা বিশ্ব। এরপরই জাপান আত্মসমর্পন করে এবং জাপানের উপর আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্রশক্তি বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে।
১৯৪৭ সালে আমেরিকা জাপানের জন্য একটি লিখিত সংবিধান তৈরি করে যার আর্টিকেল ৯ এ বলা হয় জাপন কোন সেনাবাহিনী রাখতে পারবেনা এবং আন্তর্জাতিক কোন সমস্যাতোও জাপান কোনদিন যুদ্ধ করতে পারবে না। ১৯৫১ সালে জাপান ও মিত্রশক্তির মধ্যে সানফ্রান্সিসকো চুক্তি বা শান্তি চুক্তি হয় এবং জাপানের উপর নতুন কিছু শর্ত আরোপ করা হয়। ১৯৬০ সালে জাপান ও আমেরিকার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও সামরিক চুক্তি হয়। ঠিক হয় জাপান তার অর্থনৈতিক উন্নতি করবে এবং আমেরিকা জাপানকে নিরাপত্তা দেবে। ফলে সামরিক শক্তিশালী হওয়ার বদলে জাপান অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জাপানকে নিরাপত্তা দেওয়ার পেছনে আমেরিকারও স্বার্থ ছিল, সেসময় বিশ্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমানার কাছাকাছি একটি বন্ধুদেশ আমেরিকার দরকার ছিল যার জন্য জাপান সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
দ্বিতীয়ত ২০১১ সালে তীব্র ভূমিকম্প ও তার ফলে হওয়া সুনামির প্রভাবে জাপানের ফুকোশিমা দাইচি পরমানু কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঘটে যাকে ১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল পরমানু দুর্ঘটনার সাথে তুলনা করা হয়। আন্তর্জাতিক স্তরে এই দুর্ঘটনাকে লেভেল ৭ স্তরের বিপর্যয় বলা হয়। এর ফলে গোটা জাপান জুড়ে পরমানু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়। এরপর জাপান সিদ্ধান্ত নেয় দেশে ২০৩০ এর মধ্যে সমস্ত পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার। এর আগে জাপানে ৫৪ টি পরমানু রিয়্যাক্টার ছিল যা দেশটির ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করত। এই ঘটনার পরবর্তী ১৪ মাসের মধ্যে অনেক রিয়্যাক্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়।
২০২১ সালে জাপানের মোট উৎপাদিত বিদ্যুৎ এর ৩.৯ শতাংশ আসে পরমানু বিদ্যুৎ থেকে যা খুবই কম। কিন্তু বর্তমানে জাপান তার নীতি পরিবর্তন করেছে। গতবছর শুরু হয় রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধ যারপর গোটা বিশ্ব আবারও দুভাগে ভাগ হতে শুরু করে। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন জোট রাশিয়ার উপর প্রচুর আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু এটা আমেরিকার ভুল সিদ্ধান্ত ছিল বলে মত সামরিক বিশেষজ্ঞদের। কারন রাশিয়া গোটা বিশ্বে এনার্জির অন্যতম বড় সরবরাহকারী। এই ঘটনার পর রাশিয়া তেল ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয় যার প্রভাব গোটা ইউরোপে পড়ে এবং রাশিয়ার অর্থনীতিও টিকে থাকে। জাপান তার ৯০ শতাংশ ফসিল ফুয়েল আমদানি করে যার মধ্যে রাশিয়া থেকে দশ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে। কিন্তু রাশিয়ার এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে জাপানে শক্তির ঘাটতি তৈরি হয় এবং জাপানের রাজধানী টোকিও সহ বড় বড় শহরে বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দেয় এবং জাপান বাধ্য হয় বিদ্যুৎ এর দাম বাড়াতে। তখনই জাপান সিদ্ধান্ত নেয় পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গুলি পুনরায় চালু করার।
২০২২ সালের আগস্টে জাপানের প্রধানমন্ত্রী জানায় তারা নতুন প্রজন্মের আধুনিক পারমানবিক চুল্লী তৈরি করবে, এব্যাপারে জানুয়ারীতে জাপান ও আমেরিকার মধ্যে চুক্তিও হয়। শুধু তাই নয় জাপান তার পুরোনো পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র গুলো পুনরায় খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে জাপান আগের থেকে আরও বেশী নিরাপত্তা ব্যাবস্থা নিয়েছে কেন্দ্র গুলিতে। আগে জাপানের একটি পরমানু চুল্লীর গড় জীবনকাল ছিল ৬০ বছর, এবার থেকে জাপান তা কমিয়ে করেছে ৩০ বছর এবং তারপর পরীক্ষা করে দেখা হবে, যদি ঠিক থাকে সবকিছু তাহলে আরও দশ বছর করে বাড়ানো হবে। যে জাপান একসময় ২০৩০ এর মধ্যে সব পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সেই জাপান এখন জানিয়েছে ২০৩০ এর মধ্যে ২২ শতাংশ বিদ্যুৎ তারা পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে তৈরি করবে।
২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাপান তাদের নতুন সামরিক নীতি প্রকাশ করেছে যাতে বলা হয়েছে জাপান ২০২৭ এর মধ্যে তার প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়িয়ে জিডিপির ২ শতাংশ করবে এবং ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। এসব ঘটনা বাটারফ্লাই এফেক্টের কথাই মনে করায় রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমন, বিশ্বে শক্তির সংকট ও জাপানের পরমানু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির ঘটনাকে ও নতুন সামরিক নীতি যদি ভালভাবে বিশ্লেষন করা যায় তাহলে বোঝা যাবে শুধু বিদ্যুৎই জাপানের লক্ষ্য নয়, জাপান চাইছে পারমানবিক শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠতে এবং জাপানকে এই কাজে সাহায্য করছে আমেরিকা। আসলে চীন ও উত্তর কোরিয়া বারবার জাপানের সীমানায় পরমানু মিসাইল পরীক্ষা করছে বিগত পাঁচ বছর ধরে যার কারনে জাপান চাইছে পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে। যদিও জাপান জানিয়েছে ২০৫০ এর মধ্যে কার্বন নির্গমন শূন্য করবার জন্য তারা এই পদক্ষেপ নিচ্ছে তবুও বিশ্ব বুঝে গেছে জাপানের উদ্দেশ্য কী।
আমেরিকা জাপান ছাড়াও অস্ট্রেলিয়াকেও পারমানবিক শক্তি অর্জনে সহায়তা করছে। ইতিমধ্যেই অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে পরমানু সাবমেরিন প্রযুক্তি নিয়ে চুক্তি হয়েছে। জাপানের অবস্থা অনেকটা ১৯৮০ এর দশকের ভারতের মতোন। সেসময় ভারত চীন ও পাকিস্তানের কারনে বাধ্য হয়ে পরমানু বোম্ব তৈরি করেছিল কিন্তু সেসময় আমেরিকা সহ পশ্চিমা বিশ্ব ভারতের বিরোধীতা করেছিল। জাপান ঠিক তেমনি চীন ও উত্তর কোরিয়ার কারনে পরমানু শক্তি অর্জন করতে চাইছে, সেসময় ভারতকে যেমন সোভিয়েত ইউনিয়ন সাহায্য করেছিল, এখন আমেরিকা জাপানকে সাহায্য করছে। জাপান পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে পারলে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতেরও একটি শক্তিশালী বন্ধু হবে।