অফবিট

বাংলাদেশকে চাপে রাখতে অরুনাচল প্রদেশে ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি। আপত্তি চীনের

সম্প্রতি চীনের বিদেশমন্ত্রক জানিয়েছে ভারতের অরুনাচল প্রদেশে উন্নয়নের কোনও অধিকার নেই বিশেষ অরুনাচল প্রদেশে ভারত ও চীন সীমান্ত বা এলএসির কাছে ভারত কোনও উন্নয়ন করতে পারবেনা। চীন বহু বছর ধরেই অরুনাচল প্রদেশ নিয়ে ভারতের সাথে রাজনীতি করছে। প্রায় সময়ই অরুনাচল প্রদেশকে চীন তাদের বলে দাবী করে, অরুনাচল প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নাম চীন মাঝে মধ্যেই বদলে দেয়। তাছাড়া অরুনাচল প্রদেশে দলাই লামা গেলে কিংবা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী গেলে বা বিদেশী কোনও প্রতিনিধি গেলেই চীন আপত্তি জানায়। চীন সর্বদা এটা দেখাতে চায় অরুনাচল প্রদেশ তাদের অংশ। 

চীনের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মাও জেডং এর সময় থেকেই অরুনাচল প্রদেশের দিকে নজর রয়েছে চীনের কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর কারনে অরুনাচল প্রদেশে চীন কিছু করতে পারেনা। বিগত কিছু দিনে ভূরাজনীতিতে একাধিক ঘটনা ঘটেছে যেমন ন্যাটোর সামিট, চীন ও বেলারুশের পোল্যান্ড সীমান্তের কাছে সামরিক অনুশীলন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাশিয়া সফর। তাছাড়া জম্মু কাশ্মীরে পরপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর হওয়া একের পর এক সন্ত্রাসী হামলার কারনেও ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক গন এলএসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের দিকে ততটা নজর দেয়নি। কিন্তু এবার চীন এলএসিতে নতুন বিতর্ক শুরু করেছে। 

এলএসিতে অরুনাচল প্রদেশের সাথে চীনের সীমান্তে তিব্বত রয়েছে। তিব্বতকে দুইভাগে বিভক্ত করেছে ব্রহ্মপুত্র নদী যাকে চীনে ইয়ারলাং জাংবো বলা হয়। এই নদীই যখন অরুনাচল প্রদেশ হয়ে ভারতে প্রবেশ করে তখন তার নাম হয়ে যায় ব্রহ্মপুত্র নদী। ব্রহ্মপুত্র নদী ভারত ও চীন উভয়দেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। চীন একটি এমন দেশ যে তার সমস্ত নদীর জলকে অতিরিক্ত পরিমানে ব্যবহার করে। চীন বিশ্বের একমাত্র দেশ যে তার নদীর জলকে অত্যাধিক পরিমানে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিকাজ, শিল্পকাজে ব্যবহার করে। চীনের মাঝামাঝি বয়ে যাওয়া ইয়াংজা নদীতে চীন এতবেশী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করেছে যে নদীটি যখন তার নিম্ন অঞ্চলে আসে তখন তাতে জলের পরিমন এতটাই কম থাকে যে স্থানীয় মানুষজন পর্যাপ্ত জল পায়না। চীনের কাছে তিব্বতের রূপে প্রাকৃতিক জলের ভান্ডার রয়েছে, যেখান থেকে এশিয়ার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ন নদীগুলি উৎপন্ন হয়েছে। চীন এসব নদীতে অতিরিক্ত পরিমান জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে। একমাত্র ব্রহ্মপুত্র নদীতেই তেমন বেশী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই চীনের। তবে এবার এই নদীতেও একাধিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান শুরু করেছে চীন। অরুনাচল প্রদেশের কাছেও ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে চীন। এর কারনে ভবিষ্যতে অরুনাচল প্রদেশে হয় ব্রহ্মপুত্র নদীতে জলের পরিমান কমে যাবে নয়তো কোনও নির্দিষ্ট সময়ে অতিরিক্ত জলের কারনে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে বন্যা হবে। চীনকে প্রতিরোধ করবার জন্য ভারতও অরুনাচল প্রদেশে প্রচুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বিশ্বের সমস্ত উন্নত দেশই কার্বনের নির্গমন ২০৫০ সালের মধ্যে কমিয়ে শূন্যে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই ভারতও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে শক্তি উৎপাদন করে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে চাইছে। তাছাড়া এখানে একটি বড় ভূরাজনৈতিক চালও রয়েছে। চীন নিজের দেশে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করছে তাতে ভারত বাধা দিতে পারবেনা, এবার ভারতও যদি ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করে তাহলে ব্রহ্মপুত্র নদীর নিম্ন অববাহিকায় থাকা বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারন ব্রহ্মপুত্রের জল বাংলাদেশে খুবই কমে যাবে। তখন বাংলাদেশ বাধ্য হবে আন্তর্জাতিক স্তরে চীনকে চাপ দিতে। এর ফলে চীন ভারতকে স্ট্রিং অফ পার্লস নীতির মাধ্যমে ভারতকে ঘিরে ফেলার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে পারবেনা। এই জন্য অরুনাচল প্রদেশে ভারতের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে আপত্তি জানিয়েছে চীন। 

ভারত সরকার ইতিমধ্যেই অরুনাচল প্রদেশে ১২টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আগামী ২৩ জুলাই, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের বাজেটে ভারত সরকার জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের মাধ্যমে অরুনাচল প্রদেশের উন্নয়নে অন্তত ৯০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার কথা ঘোষনা করতে পারে। অন্যান্য অপ্রচলিত শক্তি উৎপাদনের তুলনায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ অনেক বেশী হয় কিন্তু এর একটি বিশেষ সুবিধাও আছে তাহল জলবিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার পর জলকে পুনরায় ব্যবহার করা যায় অন্যান্য কাজে, নষ্ট হয়না। 

২০১৪ সাল থেকেই ভারত সরকার অরুনাচল প্রদেশে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের চেষ্টা করছে কিন্তু পরিবেশ সংগঠন, স্থানীয়দের প্রতিবাদের কারনে দীর্ঘদিন এখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি সম্ভব হয়নি, তবে এবার সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে। গত আগস্টে ভারত সরকার সরকারি সংগঠনগুলিকে উত্তর পূর্ব ভারতে ১১.৫ গিগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির জন্য ১১ বিলিয়ন ডলারের ফান্ডিং দিয়েছে। ভারত ও চীনের মধ্যে ২,৫০০ কিলোমিটার সীমানা রয়েছে যাকে এলএসি বলা হয়। লাদাখ, হিমাচলপ্রদেশ, উত্তরাখন্ড, সিকিম ও অরুনাচল প্রদেশ এই পাঁচটি রাজ্যের সাথে চীনের সীমানা রয়েছে। এর মধ্যে লাদাখ ও অরুনাচল প্রদেশে ইন্দো-চীন সীমান্তে দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। গালওয়ান উপত্যকার মতোন ঘটনা লাদাখেই হয়েছিল। এজন্য ভারত সরকার এলএসি আশেপাশে পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক জোর দিয়েছে। আধুনিক সড়ক, টানেল, সেতু নির্মান জোরকদমে চলছে যাতে সারাবছরই ভারতীয় সেনাবাহিনীর রসদ সরবরাহে কোনও সমস্যা না হয়। এর পাশাপাশি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কাজও চলছে যাতে বিদ্যুৎ শক্তির চাহিদাও পূরন করা যায়। কোনওদেশ সাধারনত তার মোট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতার ৪০-৫০ শতাংশ ব্যবহার করে, তবেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় থাকে। কিন্তু চীন তার জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৬০-৭০ শতাংশ ব্যবহার করে যা বিশ্বে সর্বাধিক। ভারত এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। ভারত বর্তমানে তার মোট জলবিদ্যুৎ সক্ষমতার ২৬ শতাংশই ব্যবহার করে, এই জন্য ভারত সরকার জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে একাধিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প শুরু করেছে। আগামী পাঁচ বছরে আরও বেশী জলবিদ্যুৎ প্রকল্প শুরু হবে, ভারত অন্তত জলবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতাকে ৪০ শতাংশে নিয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *