তবে কী খুব শীঘ্রই যুদ্ধ হতে চলেছে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে?
পাকিস্তান আফগানিস্তানের তেহরিক-ই-তালিবান সহ বেশ কিছু সংগঠনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের হুমকী দিয়েছে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে যা অদূর ভবিষ্যতে একটি বড় যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। আফগানিস্তানের ক্ষমতায় থাকা তালিবান সংগঠনের দুটি ভাগ রয়েছে তেহরিক ই তালিবান বা টিটিপি এবং আফগান তালিবান। আফগানিস্তানের ক্ষমতায় রয়েছে আফগান তালিবান। তবে টিটিপি ও আফগান তালিবান একই মুদ্রার দুই পিঠ।
পাকিস্তানের খাইবার পাখতানখোয়া প্রদেশে টিটিপির প্রভাব বেশী রয়েছে। টিটিপি চায় খাইবার পাখতানখোয়াতে তাদের নিয়ন্ত্রন থাকুক। পাকিস্তানে টিটিপি একটি নিষিদ্ধ সংগঠন, আফগান তালিবানের সাথে সংযুক্ত নয় টিটিপি কিন্তু টিটিপিকে পূর্ন নিয়ন্ত্রন করে আফগান তালিবানই। মজার ব্যাপার হল আফগানিস্তানে প্রথমে ১৯৭০ এর দশকে আমেরিকার সাহায্য সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্বে তালিবানকে তৈরি করে পাকিস্তান। সেসময় অপারেশন সাইক্লোনের মাধ্যমে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ পাকিস্তানের আইএসআইয়ের মাধ্যমে আফগানিস্তানের লোকেদের অর্থ ও অস্ত্র দেয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য। সেসময় ওসামা বিন লাদেন, মোল্লা ওমরের মতোন সন্ত্রাসীদের পাকিস্তানই তৈরি করেছিল। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং সাতবছর পর ১৯৯৬ সালে তালিবান ক্ষমতায় আসে আফগানিস্তানে। কিন্ত ৯/১১ এর পর আমেরিকা আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী পাঠায় তখন আমেরিকাকে আফগানিস্তানে তালিবানের বিরুদ্ধে সহায়তা করতে থাকে পাকিস্তান। আবার ২০১৫ সালের পর থেকে পাকিস্তান পুনরায় তালিবানকে সহায়তা শুরু করে আফগানিস্তানে। ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনাবাহিনী ফিরে গেলে দেশটিতে তালিবান সরকার ক্ষমতায় আসে যাতে সবচেয়ে বেশী খুশি হয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তান ভেবেছিল আফগানিস্তানের পূর্ন নিয়ন্ত্রন তাদের হাতে থাকবে। কিন্তু তালিবান জানতো অতীতে পাকিস্তান তাদের বিরুদ্ধে ছিল সেজন্য ক্ষমতায় আসতেই পাকিস্তানকে দমানোর জন্য টিটিপিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ছেড়ে দেয় তালিবান। পাকিস্তানের অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও আফগান তালিবান টিটিপিকে নিয়ন্ত্রন করেনি।
বিগত তিন বছরে টিটিপির সামনে রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েছে পাকিস্তান। খাইবার পাখতানখোয়ার কোনও কোনও জায়গায় টিটিপির এতটাই নিয়ন্ত্রন রয়েছে যে সেখানে টিটিপি রীতিমতো কর আদায় করছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খোয়াজা আসিফ আফগান সরকারের সমালোচনা করে জানিয়েছে ইসলামাবাদের বারবার অনুরোধ সত্বেও আফগান সরকার পাকিস্তান আফগানিস্তান সীমান্তে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। খোয়াজা আসিফ আফগানিস্তান সরকারকে টিটিপিকে খাইবার পাখতানখোশা থেকে দূরে পশ্চিম সীমান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য দশ বিলিয়ন পাকিস্তানি রুপী দেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছিল কিন্তু আফগান সরকার পাকিস্তানের এই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। আফগানিস্তানে বর্তমানে ৯৫ শতাংশ লোকই অত্যন্ত গরীব কি তাও আফগান সরকার অর্থ নেয়নি পাকিস্তানের থেকে। পাকিস্তানকে নিয়ে আফগানিস্তানের একটি বড় পরিকল্পনা আছে, টিটিপির লক্ষ্য পুরো পাকিস্তান না হলেও অর্ধেক পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রন নেওয়া।
২০০৭ সালে তৈরি হওয়া এই তেহরিক ই তালিবান বা পাকিস্তান তালিবানকে প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকারই সমর্থন করতো কিন্তু এখন তারা একে অপরের চরম শত্রু। টিটিপি মূল আফগান তালিবানের থেকেও বিপদজনক। এজন্য খোয়াজা আসিফ হুমকী দিয়েছে আফগান সরকারের সাথে আর কোনওরকম আলোচনা করবেনা, এবার সরাসরি সামরিক অভিযান হবে। ২০১০ সাল থেকেই টিটিপি পাকিস্তানের উপর হামলা করে আসছে। এই কারনে পাকিস্তান ভেবেছিলো আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় এলে টিটিপি পাকিস্তানে হামলা বন্ধ করে দেবে কিন্তু এমন কিছুই হয়নি উপরন্তু আফগান তালিবানও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে গেছে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী খোয়াজা আসিফ ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছে পাকিস্তান অপারেশন আজম ই ইসতেখামের মাধ্যমে পাকিস্তান আফগানিস্তান সীমানায় সমস্ত টিটিপি সদস্যদের হত্যা করবে। পাকিস্তান আফগানিস্তানের মধ্যে সীমানা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে, এরককম পরিস্থিতিতি খোয়াজা আসিফ আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে গিয়ে অভিযানের হুমকী দিয়েছে। খোয়াজা আসিফের এই সাক্ষাৎকারের বিপরীতে আফগান সরকার জানিয়েছে যদি পাকিস্তান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরে সামরিক অভিযান করে তবে তারাও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
আফগানিস্তান এমন একটি দেশ যাকে সাম্রাজ্যবাদীদের কবরস্থান বলা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকার মতোন সুপার পাওয়ার পর্যন্ত আফগানিস্তান দখল করতে পারেনি। গত মার্চ মাসে পাকিস্তান বায়ুসেনা আফগানিস্তানের খোস্ট এবং পাকিটা নামক অঞ্চলে এয়ারস্ট্রাইক করেছিল। এই দুই অঞ্চলে টিটিপি পাকিস্তান আফগানিস্তান সীমান্তের কাঁটা তার উপড়ে ফেলছিলো। বালুচিস্তান ও খাইবার পাখতানখোয়া প্রদেশে টিটিপি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে রীতিমতো আত্মঘাতী হামলা শুরু করেছে।
২০২৩ সালে পাকিস্তানে টিটিপির হামলায় ১,৫৩৩ জন লোকের মৃত্যু হয়েছে যার মধ্যে ৯০ শতাংশ হামলাই বালুচিস্তান ও খাইবার পাখতানখোয়াতে। ২০২৪ সালে এখনও পর্যন্ত ৩৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে পাকিস্তানে টিটিপির হামালায়। টিটিপি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাশাপাশি চীনের নাগরিকদেরও নিশানা করছে। বালুচিস্তানের মধ্যে দিয়ে চীন পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর বা সিপেক তৈরি হচ্ছে যা চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রজেক্টের অংশ। চীন এই প্রজেক্টে এখনও পর্যন্ত ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেও এই প্রজেক্টের দশ শতাংশও এখনও সম্পূর্ন হয়নি। বালুচিস্তানে বালুচিস্তান লিবারেশন ফোর্স বা বিএলএ এবং টিটিপি নিয়মিত আক্রমন করে চীনের কর্মীদের উপর যার কারনে সিপেক প্রজেক্ট মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চীনের চাপে তাই গত ২২ জুন থেকে পাকিস্তান অপারেশন আজম ই ইসতেখাম শুরু করেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমানা নির্ধারন করেছে ডুরান্ড লাইন। কিন্তু ১৯৯০ সাল থেকেই তালিবান এই ডুরান্ড লাইন মানেনা, তালিবান যে ডুরান্ড লাইন দাবী করে তাতে পাকিস্তানের অনেক অংশ চলে আসে। শুধু টিটিপি নয় ২০১৯ সালে ইসলামিক স্টেট সংগঠনও দাবী করেছিল তারা পাকিস্তানে একটি প্রদেশ দখল করে নিয়েছে যার নাম দিয়েছিল হিন্দ প্রদেশ। পাকিস্তানের আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মাসুদ খান আমেরিকার কাছে অপারেশন আজম ই ইসতেখামের জন্য সাহায্য চেয়েছে তবে আমেরিকা এই অপারেশনে সহায়তা করবে না কারন এতে পাকিস্তানের পাশাপাশি চীনের বিআরআই প্রজেক্টের জন্য সুবিধা হবে এবং আমেরিকা চীনের বিআরআই প্রজেক্টের বিরোধী। তাছাড়া এই অপারেশনের মাধ্যমে পাকিস্তান তার দ্বিচারিতাও প্রকাশ করেছে। একদিকে পাকিস্তান দাবী করছে তারা সন্ত্রাসী বিরোধী অভিযান শুরু করেছে আবার অন্যদিকে পাকিস্তান কাশ্মীরে জঙ্গি হামলা করাচ্ছে। অপারেশন আজম ই ইসতেখামের কারনে হয়ত খুব শীঘ্রই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হতে পারে।