অফবিট

ইইউ ও ন্যাটোর জন্য সরাসরি হুমকী! ন্যাটোর সীমান্তে সামরিক অনুশীলন শুরু করলো চীন ও বেলারুশ

ভূরাজনীতিতে প্রতিদিনই কোনওনা কোনও চমক লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিগত এক সপ্তাহে বিশ্ব রাজনীতিতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটনে ন্যাটোর সামিট শুরু হয়। এই ঘটনার জবাবে চীন সাংহাই কর্পোরেশনের বৈঠক শুরু করে কাজাখিস্তানে যেখানে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন স্বয়ং উপস্থিত হন। এবার ন্যাটোর সীমানায় চীন ও বেলারুশ সামরিক অনুশীলন শুরু করেছে যা ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইউ এর জন্য সরাসরি হুমকী বলা হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই শুরু হয়েছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আমেরিকা একক সুপার পাওয়ার দেশ ছিল। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে পুনরায় রাশিয়া শক্তিশালী হওয়া শুরু করে এবং ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পরেই আমেরিকা ও রাশিয়াকে কেন্দ্র করে বিশ্বে পুনরায় দুটি মেরু গঠন শুরু হয় ধীরে ধীরে। তবে চীন বিগত কয়েক বছর ধরে রাশিয়াকে সরিয়ে নিজে রাশিয়ার জায়গাটা নিতে চাইছে। যেহেতু অর্থনৈতিক সক্ষমতায় চীন রাশিয়ার থেকে বহুগুন এগিয়ে তাই রাশিয়া চাইলেও চীনের জায়গা নিতে পারবেনা। 

ওয়াশিংটনে ন্যাটোর সামিটে পশ্চিমা দেশগুলো একত্রিত হয়ে ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও সহায়তার জন্য অঙ্গীকার করেছে, এর পাশাপাশি চীনের রাশিয়াকে সমর্থনের ব্যাপারেও সমালোচনা করা হয়েছে। এর জবাবেই চীনের ও বেলারুশের সেনাবাহিনী এগারো দিনের একটি দীর্ঘ সামরিক অনুশীলন শুরু করেছে ন্যাটোর সীমান্তের কাছে। ইগল অ্যাসল্ট নামক এই সামরিক অনুশীলন বেলারুশের ব্রেস্ট শহরে গত ৮ জুলাই থেকে শুরু হয়েছে। এই ব্রেস্ট শহর থেকে পোল্যান্ডের সীমানা মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে, পোল্যান্ড একটি ন্যাটো সদস্য দেশ। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই এই সামরিক অনুশীলন ন্যাটোর অস্বস্তির কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রথম বেলারুশ ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে এই ধরনের সামরিক অনুশীলন শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে চীন ন্যাটো এবং ইউকে একটি কড়া বার্তা দিয়েছে। এই অনুশীলনের নাম ইগল অ্যাসল্ট রাখা হয়েছে কারন ইগল শক্তি ও ক্ষিপ্রতার প্রতীক। বেলারুশ ও পোল্যান্ডের সীমানা নির্ধারন করেছে একটি নদী যার নাম বাগ। ব্রেস্ট শহর এই বাগ নদীর তীরেই অবস্থিত। স্বাভাবিক ভাবেই এই সামরিক অনুশীলন পোল্যান্ডের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকী। 

বিশ্বে নতুন করে যেদুটি অক্ষ তৈরি হচ্ছে তাতে একদিকে রয়েছে আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলো এবং বিপরীতে রয়েছে রাশিয়া, চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়ার মতোন দেশ গুলো। বেলারুশ রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে একটি৷ বলতে গেলে বেলারুশ অঘোষিত ভাবে রাশিয়ান প্রদেশই। এতদিন ধরে চলা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে প্রথম থেকেই বেলারুশ রাশিয়াকে সহয়তা করছে। এমনকী বেলারুশে রাশিয়ান সেনাবাহিনী, যুদ্ধবিমানও থাকে। সেই বেলারুশের সাথে চীনের সামরিক অনুশীলনের অর্থ এতে রাশিয়ার পূর্ন সম্মতি রয়েছে। তবে এই অনুশীলন পোল্যান্ড সীমান্তর কাছেই হওয়ার সবচেয়ে বড় কারন হচ্ছে পোল্যান্ডকে চাপে রাখা। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়া থেকে পোল্যান্ডই ইউক্রেনকে সবচেয়ে বেশী সহায়তা করছে। পশ্চিম ইউক্রেনের সাথে পোল্যান্ডের সীমানা রয়েছে। দুইবছর আগে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরেই ইউক্রেনের প্রধানমন্ত্রী ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি পোল্যান্ডে গিয়েই আশ্রয় নিয়েছে। আমেরিকা সহ ন্যাটো দেশগুলো পোল্যান্ডের মাধ্যমেই যাবতীয় অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা করছে ইউক্রেনকে। পোল্যান্ডই প্রথম থেকে ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করেছে। পোল্যান্ডের লক্ষ্য ছিল ইউক্রেন ন্যাটোর অংশ হলে পোল্যান্ড ও ইউক্রেনকে নিয়ে ন্যাটো বেলারুশ ও রাশিয়াকে ঘিরে ফেলবে। তাছাড়া সম্প্রতি ভ্লাদিমির জেলেনেস্কি পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্কের সাথেও সাক্ষাৎ করে যার বিরোধীতা করে রাশিয়া ও চীন। সেজন্য পোল্যান্ডে সীমানার কাছেই চীন ও বেলারুশের সেনাবাহিনী সামরিক অনুশীলন শুরু করেছে। তবে রাশিয়া ও চীনকে নিয়ে ন্যাটোও অস্বস্তিতে আছে যার কারন হচ্ছে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ন্যাটোর প্রধান হচ্ছে আমেরিকা। কিন্তু আগামী নভেম্বরে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, এবারের নির্বাচনে আমেরিকার বর্তমান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের হেরে যাওয়ার সবচেয়ে বেশী সম্ভবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় রাষ্ট্রপতি হতে পারে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এমন একজন রাষ্ট্রনেতা যে যুদ্ধের বদলে ব্যবসা বেশী পচ্ছন্দ করে। এজন্য ২০১৬-২০২০ সাল পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন আমেরিকা কোনও যুদ্ধে জড়ায়নি, উপরন্তু আফগানিস্তান থেকে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেয় ডোনাল্ড ট্রাম্প। সুতরাং ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি হলে ন্যাটোর ক্ষমতা কমিয়ে দেবে এবং রাশিয়ার সাথে সরাসরি কোনও যুদ্ধে জড়াবেনা। 

পোল্যান্ড সীমান্তে সামরিক অনুশীলনের মাধ্যমে চীন বিশ্বকে নিজের গুরুত্ব বোঝাচ্ছে। চীন এমন একটি দেশে যে অর্থনৈতিক কারন ছাড়া কোনও দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনা। কিন্তু বেলারুশ এমন একটি দেশ যেখান থেকে চীনের কোনও অর্থনৈতিক লাভ হবেনা তাও চীন সেখানে গেছে। কীছু দিন আগে বেলারুশের ৮০ তম স্বাধীনতা দিবসেও চীনের সেনাবাহিনী একটি সামরিক প্যারেড করে সেখানে। চীনের বেলারুশের প্রতি এত আগ্রহের প্রধান কারন হচ্ছে তার এসসিও বা সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন নামক সংগঠনের কারনে। ন্যাটো একটি সামরিক জোট, কোনও একা দেশের পক্ষে ন্যাটোকে পরাজিত করা সম্ভব নয়। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে ভারত ও চীনের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক না থাকলে রাশিয়া এই যুদ্ধ দীর্ঘ দুই বছর ধরে চালিয়ে যেতে পারতোনা। সুতরাং ন্যাটোর বিরুদ্ধে দরকার ন্যাটোর মতোই জোট। কিছু সময় আগেও সিএসটিও নামে রাশিয়ার একটি জোট ছিল মধ্য এশিয়ায়। দি কালেক্টিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সিএসটিওতে রাশিয়া ছাড়াও আর্মেনিয়া, কাজাখিস্তান, কিরঘিজস্থান, তাজাখিস্তান, বেলারুশ সদস্য ছিল। কিন্তু রাশিয়ার প্রায়ই বিভিন্ন দেশের সাথে ঝামেলা রয়েছে, আবার আর্মেনিয়াও নার্গোনা কারবাখ নামক জায়গাকে কেন্দ্র করে আজারবাইজানের সাথে যুদ্ধে হেরে যায়। সুতরাং এই জোটকে শক্তিশালী করবার জন্য এমন একটি দেশের প্রয়োজন ছিল যে সামরিক ভাবে শক্তিশালী হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ভাবেও শক্তিশালী। এখানেই এগিয়ে আসে চীন, সিটলএসটিও এর বদলে চীন নিজের এসসিও সংগঠনকে শক্তিশালী করা শুরু করে। 

২০২৩ সালে ইরানকে এসসিওতে যুক্ত করা হয়। বেলারুশকেও এসসিওতে যুক্ত করবার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে চীন। এই জন্য বেলারুশের সাথে সামরিক অনুশীলন করছে চীন। এভাবে একদিকে যেমন ন্যাটোর বিরুদ্ধে জোট গঠন করছে চীন, অন্যদিকে রাশিয়াকে সরিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ হিসাবেও উঠে আসার চেষ্টা করছে চীন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *