অফবিট

ব্রাজিলে গিয়ে নিজেদের শত্রুকে হত্যা করে এসেছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দারা

সময়টা ১৯৬৪ সালের  ১২ সেপ্টেম্বর, এক ব্যক্তি প্যারিস থেকে ট্রেন ধরে নেদারল্যান্ডসের রটারডাম শহরে পৌঁছায়। রটারডাম শহরের রেইন হোটেলে এক অস্ট্রিয়ান ব্যবসায়ী অ্যান্টন কুনজ্যোল পরিচয়ে সে ঘর ভাড়া নেয়। কিছুক্ষন পর হোটেল থেকে বেরিয়ে ওই ব্যক্তিটি স্থানীয় একটি ব্যাঙ্কে একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করে তাতে তিন হাজার ডলার জমা রাখে। এরপর ব্যক্তিটি একটি দোকানে গিয়ে অ্যান্টন কুনজ্যোল নামে একটি ব্যাবসায়িক কার্ড ছাপায় এবং ব্রাজিল দূতাবাসে গিয়ে পর্যটক ভিসার জন্য আবেদন করে। পরেরদিন জুরিখ গিয়ে সুইস ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট তৈরি করে সেখানে ছয় হাজার ডলার জমা রাখে ওই ব্যক্তি। এরপর জুরিখ থেকে সে পুনরায় প্যারিস আসে, প্যারিসে আগে থেকেই একজন চিত্রগ্রাহক তার জন্য অপেক্ষা করছিলো। ওই চিত্রগ্রাহক ব্যক্তিটির চোখে চশমা ও নকল গোঁফ লাগিয়ে কয়েকটি পাসপোর্ট আকারের ছবি তুলে দেয়। ছবি নিয়ে ব্যক্তিটি রটারডামে ফিরে আসে। নকল অস্ট্রিয়ান পাসপোর্টে ওই ছবি আটকানোর পর ব্রাজিল দূতাবাসে গিয়ে পাসপোর্ট জমা দেয় ব্যক্তিটি, এবার সে ব্রাজিল যাওয়ার জন্য পূর্নরূপে প্রস্তত ছিল। অস্ট্রিয়ান নাগরিক অ্যান্টন কুনজ্যোল ছদ্মবেশে ওই ব্যক্তিটি ছিল আসলে মোসাদের একজন দক্ষ এজেন্ট যার নাম ইতজাক সারিদ। ১ সেপ্টেম্বর প্যারিসে হওয়া মোসাদের এক বৈঠকে ব্রাজিলে এক গুরুত্বপূর্ন মিশনে ইতজাক সারিদ নিযুক্ত করে মোসাদ। 

মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেখানে প্রথমবারের মতোন পরমানু বোম্বের প্রয়োগ করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জার্মান নাজি সেনা ইহুদিদের নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল যা ইতিহাসে হলোকাস্ট নামে কুখ্যাত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিকে দুইভাগে ভাগ করে দেওয়া হয় পূর্ব জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে এবং পশ্চিম জার্মানি আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্সের অধীনে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেক নাজি অফিসার বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে আত্মগোপন করে। 

১৯৬৪ সালে জার্মানির সংসদ আত্মগোপন করা নাজি অফিসারদের লুকিয়ে না থেকে জনসমক্ষে এসে শান্তিপূর্বক জীবনযাপনের পরামর্শ দেয়। কিন্তু ইসরায়েল জার্মানির এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে। ইসরায়েল ইহুদিদের উপর নারকীয় অত্যাচার করা নাজিদের খুঁজে বের করবার দায়িত্ব দেয় ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদকে। ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪ সালে প্যারিসে গোপন বৈঠকে ইতজাক সারিদকে একটি ফাইল দেওয়া হয় যাতে এক কুখ্যাত নাজি অফিসারের নাম ছিল যে ৩০,০০০ এর বেশী ইহুদিকে হত্যা করেছিল। এই নাজি অফিসারকে রিগার কসাই বলা হত যার নাম হারবার্টস কুকুরস। মোসাদ খবর পেয়েছিল হারবার্টস ব্রাজিলে লুকিয়ে আছে তাই তাকে গ্রেফতার করার দায়িত্ব দেওয়া হয় ইতজাক সারিদকে। এই অপারেশনের জন্য ইতজাক সারিদকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল কারন তার অতীতের জন্য। জার্মানির এক ইহুদি পরিবারে জন্ম হয়েছিল ইতজাক সারিদের। নাজি বাহিনী ক্যাম্পে অত্যাচার করে হত্যা করেছিল তার বাবা মাকে। তাই মোসাদ জানতো এই কাজের জন্য ইতজাক সারিদই উপযুক্ত। এর জন্য ইতজাক সারিদকে অস্ট্রিয়ান নাগরিক অ্যান্টন কুনজ্যোলের ছদ্মবেশ নিতে হয়। কুখ্যাত নাজি অপরাধী হারবার্টস কুকুরসের জন্ম হয়েছিল লাটাভিয়াতে। লাটাভিয়া প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল কিন্তু পরে জার্মানি লাটাভিয়া দখল করে নেয়। তখন থেকেই হারবার্টস কুকুরস নাজি সেনাবাহিনীর সদস্য হয়। 

হারবার্টস কুকুরস তার অপরাধের সূচনা করে রিগা থেকে, সেখানে একটি বাড়িতে বহু ইহুদিকে পুড়িয়ে মারে সে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একটি নদীতে ১,২০০ ইহুদিকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করে হারবার্টস। ইহুদি বাচ্চাদেরকেও ছাড়েনি হারবার্টস। 

১৯৪১ সালে সেপ্টেম্বরে ৩০,০০০ ইহুদিকে গুলি করে হত্যা করে হারবার্টস ও তার নাজি দল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হারবার্টস কুকুরস ব্রাজিল পালিয়ে যায়। ব্রাজিলের রিওতে ইহুদি সম্প্রদায়ের কাছে নিজেকে ইহুদি দাবী করে হারবার্টস এবং সেখানেই বসবাস শুরু করে সে। একদিন নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সবার সামনে নিজের অতীত সম্পর্কে জানিয়ে দেয় হারবার্টস। এরপরেই রিওতে পুরো ইহুদি সম্প্রদায় হারবার্টসের শত্রুতে পরিনত হয়, বাধ্য হয়ে রিও ছেড়ে সাও পাওলো চলে যায় হারবার্টস। সাও পাওলোর পুলিশ নিরাপত্তা দেওয়া শুরু করে তাকে। সাও পাওলোর বাড়িতে অত্যন্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে থাকতো হারবার্টস। ইতজাক সারিদ সাও পাওলোতে নিজেকে এক পর্যটক ব্যবসায়ীর পরিচয় দিয়ে হারবার্টসের সাথে সাক্ষাৎ করে। ইতজাক সারিদের কাজ ছিল হারবার্টস কুকুরসের বিশ্বাস অর্জন করা। তবে হারবার্টস কুকুরস সহজে কারও সাথে বন্ধুত্ব করতোনা। বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎকারের পর একদিন বৈঠকের সময় ইতজাক সারিদ হারবার্টস কুকুরসকে জানায় সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে লড়াই করেছিলো। ইতজাক বেশ কয়েকবার বৈঠকের পর বুঝতে পারে হারবার্টসের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। এটা শুনেই ইতজাক তার পরবর্তী পরিকল্পনা শুরু করে। ইতজাক হারবার্টসকে জানায় সে সাও পাওলো ও উরুগুয়ের মন্টেভিডিওতে তার ব্যবসা বৃদ্ধি করবে যার জন্য সে একজন সাথী খুঁজছে। ইতজাক সারিদের এই ফাঁদে পা দেয় হারবার্টস কুকুরস। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর ব্যবসার জন্যই একদিন ইতজাককে নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠায় হারবার্টস এবং তার সাথে সেইদিন ব্যবসা সংক্রান্ত আলোচনা করে। ইতজাক সারিদ সাও পাওলোতে হারবার্টস কুকুরসকে দামী হোটেল থাকা, দামী গাড়িতে ঘোরানো সহ দামী রেস্তোরাঁতে খাবার খাওয়া সহ আভিজাত্যপূর্ন জীবনযাপন করায়। দীর্ঘদিন অর্থনৈতিক সংকটে থাকা হারবার্টস কুকুরস বহুদিন বিলাসবহুল জীবন থেকে দূরে ছিল। যার কারনে হারবার্টস ইতজাক সারিদকে অনেকটাই বিশ্বাস করে ফেলেছিল। একদিন ইতজাক সারিদ হারবার্টস কুকুরসকে মন্টেভিডিওতে নিয়ে আসে এবং সেখানেও হারবার্টসকে বিলাসবহুল আতিথিয়েতা দেয়। ইতজাক সারিদ হারবার্টসকে জানায় তাদের ব্যাবসার মুখ্য কার্যালয় হবে এই মন্টেভিডিও, এই কথা বিশ্বাসও করে নেয় হারবার্টস। ইতজাক জানায় দুই মাস পর মন্টেভিডিওতে ব্যবসার জন্য আবার বৈঠক হবে। এরপর হারবার্টস সাও পাওলো ফিরে যায়। ইতজাক সারিদ প্যারিস ফিরে এসে পুনরায় মোসাদের একটি বৈঠকে যোগ দেয়। বৈঠকে ঠিক হয় দুই মাস পর মন্টেভিডিওতেই হারবার্টসকে হত্যা করার অপারেশন শুরু হবে। এই মিশনের জন্য মোসাদের পাঁচজন সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়। 

১৯৬৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মোসাদের এজেন্টরা মন্টেভিডিও এসে পৌঁছায় এবং একটি ঘর ভাড়া নেয়। মোসাদ মন্টেভিডিওতে অপারেশনের পূর্ন তোড়জোড় শুরু করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি ইতজাক সারিদ  হারবার্টস কুকুরসকে বার্তা পাঠায় মন্টেভিডিও আসার জন্য। হারবার্টস সাও পাওলো পুলিশকে তার মন্টেভিডিও যাওয়ার ব্যাপার জানায়। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান পুলিশ হারবার্টসকে স্পষ্ট ভাবে মন্টেভিডিও যেতে নিষেধ করে। সাও পাওলোর পুলিশ জানায় ব্রাজিলের বাইরে তাকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্ত অর্থনৈতিক লাভের কথা চিন্তা করে হারবার্টস শেষপর্যন্ত মন্টেভিডিও চলে যায়। বিমানবন্দরেই তাকে অভ্যর্থনা জানায় ইতজাক সারিদ। দুজনে একটি ভাড়া গাড়ি করে ব্যাবসার কাজে রওনা হয়। বেশ কয়েকটি জায়গায় ঘোরার পর অবশেষে ইতজাক সারিদ হারবার্টসকে নিয়ে একটি বাড়িতে উপস্থিত হয় যেখানে আগে থেকেই লুকিয়ে ছিল মোসাদ এজেন্টরা। বাড়ির ভিতর অন্ধকরা করে রাখা ছিল, হারবার্টস ঘরে পা দেওয়া মাত্রই তাকে চারজন মোসাদ এজেন্ট আক্রমন করে। হারবার্টস নিজেও আত্মরক্ষা জানতো যার কারনে বেশ কিছুক্ষন ধ্বস্তাধস্তি হয় তাদের মধ্যে। একজন মোসাদ এজেন্ট হাতুড়ি দিয়ে হঠাৎই হারবার্টসের মাথায় সজোরে আঘাত করে যার কারনে হারবার্টস মাটিতে পড়ে যায় এবং এই সুযোগে একজন মোসাদ এজেন্ট পিস্তল দিয়ে দুটি গুলি করে হারবার্টসকে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় হারবার্টস কুকুরসের। এরপর মোসাদ এজেন্টরা সমস্ত ঘর পরিষ্কার করে হারবার্টসের মৃতদেহ একটি বাক্সে ফেলে রেখে চলে যায়। প্যারিস থেকে মোসাদ জার্মানিকে জানায় ত্রিশ হাজার ইহুদি হত্যাকারী হারবার্টস কুকুরসের মৃতদেহ মন্টেভিডিওর একটি ঘরে বাক্সের মধ্যে পড়ে আছে। মন্টেভিডিওর ওই ঘর থেকে হারবার্টস কুকুরসের পচা মৃতদেহ খুঁজে পায় উরুগুয়ের পুলিশ। এই ঘটনার পর তদন্ত শুরু হয়, সবাই জানতো এই ঘটনার পেছনে ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স সংস্থা মোসাদ দায়ী কিন্তু মোসাদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমান পাওয়া যায়নি। হারবার্টস কুকুরসের ক্যামেরা থেকে অ্যান্টন কুনজ্যোলের বেশ কিছু ছবি পাওয়া যায় কিন্তু অনেক অনুসন্ধান করেও অ্যান্টন কুনজ্যোলকে কখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অ্যান্টন কুনজ্যোল নামে বাস্তবে কোনওদিন কেউ ছিলইনা যার জন্য কখনও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মোসাদ এত নিখুঁত ভাবে অপারেশন করেছিল যে কোনও প্রমানই পাওয়া যায়নি। মোসাদ এমন এক সংস্থা যারা তাদের শত্রুদের কখনও জীবিত রাখেনি। ইসরায়েলের শত্রুরা বিশ্বের যে প্রান্তেই লুকিয়ে থাকুকনা কেন মোসাদ তাদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করে। এই কারনে ইসরায়েলের শত্রুরা মোসাদকে যথেষ্ট ভয় খায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *