অফবিট

ইসরায়েল দেখিয়ে দিয়েছিল তারা শত্রুর ঘরে ঢুকেও খতম করে আসতে পারে

লোহিত সাগরে সুয়েজ খালের চার কিলোমিটার দক্ষিনে ১৪৫ মিটার লম্বা, ৫০ মিটার চওড়া এবং আট ফুট উচ্চ দেওয়াল বিশিষ্ট একটি দ্বীপ রয়েছে যার নাম গ্রীন দ্বীপ বা আল জাজিরা আল খাদরা। এটি একটি কৃত্রিম দ্বীপ, ব্রিটিশ সেনাবাহিনী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সুয়েজ খালকে রক্ষা করার জন্য এই দ্বীপ তৈরি করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা এই দ্বীপ মিশরকে দিয়ে দেয়। 

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, ইতিহাসে এই যুদ্ধ অ্যাট্রিশনের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৬৭ সালে ৫ থেকে ১০ জুন পর্যন্ত ইসরায়েল ও আরব দেশগুলোর মধ্যে হওয়া বিখ্যাত ছয়দিনের যুদ্ধে আরব দেশগুলো ইসরায়েলের কাছে রীতিমতো পরাজয়ের পর পুনরায় ১ জুলাই কিছু আরব দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। অ্যাট্রিশনের যুদ্ধে ইসরায়েলের বিপক্ষে ছিল মিশর, কুয়েত, জর্ডান, প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন বা পিএলও, সিরিয়া। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কিউবা এই আরব দেশগুলোকে সহায়তা করছিলো। এই যুদ্ধের সময় গ্রীন দ্বীপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছিল মিশর। গ্রীন দ্বীপে ৭০ মিশরীয় সৈনিক, ১২ জন মিশরের বিশেষ সেনাবাহিনী আস-সাইকার সদস্যকে মোতায়েন করেছিল মিশর সাথে ১৪.৫ থেকে ২৫ মিলিমিটার ১৪টি মেশিনগান, দুটি ৩৭ মিলিমিটার অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান, চারটি ৮৫ মিলিমিটার অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানও ছিল দ্বীপটির নিরাপত্তায়। তবে এত নিরাপত্তা সত্বেও ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই রাতে ইসরায়েলের বিশেষ কম্যান্ডো বাহিনী সায়েরেত মাতকাল ও শায়েতেত ১৩ এই দ্বীপে অভিযান করে যাতে এই দ্বীপে মিশরের সমস্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। গ্রীন দ্বীপে ইসরায়েলের এই অভিযানের নাম ছিল অপারেশন বুলমাস ৬।

লোহিত সাগরে অবস্থিত গ্রীন দ্বীপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছিল মিশর কারন গুরুত্বপূর্ন আন্তর্জাতিক বানিজ্যপথ সুয়েজ খালের খুব কাছেই এই দ্বীপ। গ্রীন দ্বীপ কোনও দেশ দখল করতে পারলে সুয়েজ খালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হত। মিশরের কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা সত্ত্বেও গ্রীন দ্বীপে অভিযানের অর্থ আত্মহত্যার সমান। কিন্তু বিপক্ষ দেশটির নাম যদি ইসরায়েল হয় তাহলে কোনওকীছুই অসাধ্য নয়। 

১৯৬৭ সালে শুরু হওয়া অ্যাট্রিশনের যুদ্ধ চলাকালীন ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর নজর পড়ে গ্রীন দ্বীপের উপর। এই গ্রীন দ্বীপে সেসময় মিশর যুদ্ধের অনেক পরিকল্পনা করতো। ইসরায়েল সেনাবাহিনীর প্রধান হেম বার লিভ এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোসে ডাইন গ্রীন দ্বীপে সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করে। বহুদিন ধরেই ইসরায়েল মিশরকে বার্তা দিতে চাইছিলো মিশরের কোনও জায়গাই সুরক্ষিত নয়, তা যতই দুর্ভেদ্য হোক না কেন। এই জন্য গ্রীন দ্বীপ ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের জন্য একদম উপযুক্ত ছিল। গ্রীন দ্বীপে ইসরায়েল সহজেই বিমান হামলা বা আর্টিলারি হামলা করতে পারতো কিন্তু ইসরায়েল এখানে ঝুঁকি নিয়ে কম্যান্ডো অভিযানের সিদ্ধান্ত নেয় কারন মিলিটারি অভিযানের মাধ্যমে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মোনোবলে আঘাত লাগতো। ইসরায়েল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে যখন মোসে ডাইন তার পরিকল্পনার কথা জানান তখন সেনাবাহিনীর অনেক অফিসারই এই পরিকল্পনার বিরোধীতা করে বিমান হামলার প্রস্তাব দেন কারন কড়া নিরাপত্তায় থাকা গ্রীন দ্বীপে ক্যামান্ডো আক্রমণ অনেকটা আত্মহত্যারই সমান। কিন্ত মোসে ডাইন ও হেম বার লিভের অনড় মনোভাবের কারনে শেষ পর্যন্ত কম্যান্ডো মিশনের সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়। ইসরায়েল সেনাবাহিনীর বিশেষ কম্যান্ডো বিভাগ সায়েরেত মাতকাল ও নৌবাহিনীর বিশেষ বাহিনী শায়েতেত ১৩ কে এই অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিভ আলমগকে এই অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল গ্রীন দ্বীপে মিশরীয় সেনাবাহিনীর ৮৫ মিলিমিটার অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান সহ সমস্ত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া এবং তারপর দ্বীপের উত্তরে মিশরীয় সেনাবাহিনীর প্রধান দপ্তর সহ রেডার, ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দেওয়া। অপারেশনকে দুটি দলে ভাগ করা হয় প্রথমে দুটি জোডিয়াক বোটে করে দ্বীপে যাবে শায়েতত ১৩ এর সদস্যরা, এরপর দ্বিতীয় দলে সায়েরেত সায়েরেত মাতকালের সদস্যরা অভিযান শুরু করবে। দ্বিতীয় দলের সদস্যরা প্রথম দলকে প্রয়োজনে গুলি সরবরাহ সহ চিকিৎসা ব্যবস্থার দায়িত্বে ছিল। এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন বুলমাস ৬।

১৯ জুলাই রাত ৮:৩০ নাগাদ সুয়েজ খালের পূর্ব তীরের শহর রাস সুদার থেকে প্রথম দল রওনা হয় গ্রীন দ্বীপের উদ্দেশ্যে। প্রথম দলের মধ্যে আবার চারটি বিভাগ ছিল, প্রতিটি বিভাগে দুজন করে অফিসার ও তিনজন করে কম্যান্ডো ছিল। গ্রীন দ্বীপের ৯০০ মিটার আগে সাঁতার কেটে দ্বীপে পৌঁছায়। প্রত্যেক সেনা ৪০ কিলোগ্রাম করে সরঞ্জাম বহন করছিলো। প্রথম বিভাগ গ্রীন দ্বীপের নিরাপত্তা তার কেটে দেয় এবং দ্বিতীয় বিভাগ ভিতরে ঢুকে মিশরীয় সেনাবাহিনীর আক্রমন প্রতিহত করে। তৃতীয় বিভাগ একটি ছোট সেতু অতিক্রম করে নজরদারি টাওয়ার ও রেডার ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। চতুর্থ দল দ্বীপের উত্তরের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়। প্রথম  কম্যান্ডো দলের আরেকটি ভাগ গ্রীন দ্বীপের দক্ষিনাংশের নিয়ন্ত্রন নিজের হাতে নেয়। এই অপারেশনে ইসরায়েলি কম্যান্ডোরা খানিকটা সমস্যায় পড়ে যায় কারন কম্যান্ডোরা অতিরিক্ত গভীরতায় সাঁতার কাটার কারনে তাদের পিঠে থাকা অধিকাংশ হ্যান্ড গ্রেনেড নষ্ট হয়ে যায়। শায়েতত ১৩ এর কিছু সদস্য গ্রীন দ্বীপের দক্ষিনাঞ্চল থেকে রকেট লঞ্চার ও লাইট মেশিনগান নিয়ে মিশরীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমন শুরু করে। হঠাৎই মিশরের এক সেনা সদস্যের হ্যান্ড গ্রেনেডের আঘাতে দুজন ইসরায়েলি কম্যান্ডোর মৃত্যু হয়। মিশরীয় সেনাবাহিনী শত্রুকে বোকা বানাতে এই দ্বীপে একটি নকল রেডারও মোতায়েন রেখেছিল তবে ইসরায়েল সেনাবাহিনী আসল রেডার খুঁজে বের করে সেটাকেও ধ্বংস করে। এরপর লেফটেন্যান্ট ডভ বার দ্বিতীয় দলকে সংকেত দেয় আক্রমনের জন্য। ইসরায়েলি কম্যান্ডোদের প্রথম দলের অতর্কিত  আক্রমনে মিশরীয় সেনারা প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি কিছু, পরে তারা সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতি আক্রমন শুরু করে কিন্তু ইসরায়েলের দ্বিতীয় দল দ্বীপে আসার পর তারা আবারও ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। 

ইসরায়েলের কম্যান্ডোর বাহিনীর অভিযানে গ্রীন দ্বীপে সমস্ত মিশরীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। গ্রীন দ্বীপে অভিযান সফল হওয়ার পর রাত ২:১৫ নাগাদ ইসরায়েলি কম্যান্ডোদের ফিরে আসার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্ত এসময়ে আবারও এক মিশরীয় সেনার গ্রেনেডের আঘাতে পাঁচজন ইসরায়েলি কম্যান্ডো আহত হয় এবং একজন ইসরায়েলি কম্যান্ডো মিশরীয় স্নাইপারের গুলিতে মারা যায়। ততক্ষনে গ্রীন দ্বীপ থেকে দূরে আর্টিলারি ঘাঁটিতে থাকা মিশরীয় সেনাবাহিনী গ্রীন দ্বীপে ইসরায়েলি সেনা অভিযানের সংকেত পেয়ে ইসরায়েলি কম্যান্ডোদের বোট আর্টিলারি হামলায় ধ্বংস করে দেয়। কম্যান্ডোরা ৮০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক মিশরীয় সেনা ঘাঁটিতে ইনস্টল করে বাধ্য হয়ে লোহিত সাগরে সাঁতার কাটতে শুরু করে। সমুদ্রে চারশো মিটার সাঁতার কাটার পর ইসরায়েলি বায়ুসেনার হেলিকপ্টার ভোর পাঁচটা নাগাদ সমুদ্র থেকে সমস্ত কম্যান্ডোদের উদ্ধার করে। অপারেশন বুলমাস ৬ পূর্ন সফল হয় যাতে গ্রীন দ্বীপে মিশরের সমস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। সায়েরেত মাতকাল ও শায়েতেত ১৩ এর তিনজন করে কম্যান্ডো অর্থাৎ মোট ছয়জন কম্যান্ডো এই অপারেশনে মারা যায়। 

এগারোজন ইসরায়েলি কম্যান্ডো এই অপারেশনে আহত হয়। তবে এই অপারেশনে মিশরের আশি জন সেনা মারা যায় অর্থাৎ গ্রীন দ্বীপে থাকা প্রায় সমস্ত মিশরীয় সেনাই মারা যায়। এই অপারেশনে মিশরের সেনাবাহিনীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয় তাদের নিজেদেরই আর্টিলারির আঘাতে। ইসরায়েলের এই অভিযানে ক্ষুব্ধ হয়ে মিশরের রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দেল নাসের ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বড় সেনা অভিযানের নির্দেশ দেয়। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বদলা নিতে মিশরের বায়ুসেনা অপারেশন বক্সার শুরু করে যাতে ইসরায়েল বায়ুসেনা অন্তত ৩০০ ডগফাইট, আক্রমন করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। এছাড়া সুয়েজ খাল বরাবর ইসরায়েলের উপর আরও আশিটি অভিযান করে মিশরের বায়ুসেনা। তবে ইসরায়েলের বায়ুসেনার সামনে মিশরের বায়ুসেনার প্রায় সমস্ত আক্রমনই ব্যর্থ হয়ে যায়। অপারেশন বুলমাস ৬ এ অসাধারন বীরত্বের জন্য কম্যান্ডো আমি আয়লোনকে ইসরায়েলের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান ভ্যালোর মেডেল দেওয়া হয়। অপারেশন বুলমাস ৬ বিশ্বের সামনে ইসরায়েল সেনাবাহিনীর দক্ষতা প্রমান করেছিল, এই অপারেশনের মাধ্যমে ইসরায়েল দেখিয়ে দিয়েছিল তারা শত্রুর ঘরে ঢুকেও আক্রমনে করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *