“২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে মা হওয়া সবথেকে ভাল”- স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ স্বাতী মিশ্র
আমাদের সমাজে মেয়েদের ক্ষেত্রে একটি কথা প্রচলিত আছে তা হল কুড়িতেই বুড়ি। বহুকাল ধরেই ভারতীয় সমাজে মেয়েদের অনেক কম বয়সে বিবাহ দেওয়া হচ্ছে। মেয়েদের বাল্যবিবাহ একটা সময় সামাজিক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদিও বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে মানুষের মধ্যে শিক্ষার বিকাশ হওয়ায় আধুনিক যুগে মেয়েরা অন্তত ত্রিশ বছরের নীচে বিবাহ করছেনা। উচ্চশিক্ষা অর্জন করে, মজবুত ক্যারিয়ার তৈরি করার পর বিবাহের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বর্তমান যুগে মেয়েরা। কিন্তু বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বাচ্চা নেওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েদের শারীরিক নানারকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রকৃতি পুরুষ ও নারী শরীরের বিশেষ কিছু সীমাবদ্ধতা রেখেছে। একজন পুরুষের শরীরে বহুবছর স্বাভাবিক স্পার্ম থাকে।
ডাঃ স্বাতী মিশ্র ( Centre Head and Senior Consultant, Birla Fertility & IVF Kolkata)
প্রায় তিন মাস অন্তর পুরুষের শরীরে নতুন শুক্রানু গঠন হয়। অর্থাৎ একটি পুরুষের বয়স ৪০ বছর হলে তার শুক্রানুর বয়স তিনমাস বা আরও কম হয়। কিন্তু মহিলাদের ক্ষেত্রে এই ঘটনা সম্পূর্ন বিপরীত। একজন মহিলার শরীরে নির্দিষ্ট পরিমান ডিম্বানু থাকে। প্রকৃতি প্রদত্ত নির্দিষ্ট পরিমান ডিম্বানু বা এগ নিয়েই জন্মায় মেয়েরা। গর্ভে থাকা অবস্থায় একটি নারী ভ্রূনে প্রায় ৬০ লাখের মতোন ডিম থাকে। কিন্তু জন্মের সময়েই একটি স্ত্রী শিশুর অর্ধেক ডিম নষ্ট হয়ে যায়। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মেয়েরা তাদের ডিমের সংখ্যা ক্রমশ হারাতে থাকে। যৌবনে পা দেওয়ার সাথে সাথে প্রথম মাসিক শুরু হওয়ার সময়েই একটি নারী শরীরে ডিমের সংখ্যা কমতে শুরু করে। এই জন্য একটা সময় মেয়েদের কম বয়সে বিবাহ দেওয়া হত যাতে ডিমের গুনমান ভালো থাকে এবং সন্তান ধারনে কোনও সমস্যা না হয়। কিন্তু বিজ্ঞানের কল্যানে যুগযুগ ধরে চলে আসা মহিলাদের এই সমস্যার সমাধান করা বর্তমানে সম্ভব হয়েছে। এগ ফ্রিজিং বা ডিম্বানু সংরক্ষন পদ্ধতিতে বর্তমানে মহিলারা তাদের ডিম্বানু সংরক্ষন করে রাখছে যাতে বেশী বয়সেও সন্তান পেতে কোনও সমস্যা না হয়। এই পদ্ধতিতে প্রিয়াঙ্কা চোপড়া সহ অনেক বিখ্যাত মহিলারাই এখন কম বয়সে ডিম্বানু সংরক্ষন করে রাখছেন যাতে ভবিষ্যতে মা হতে কোনও সমস্যা না হয়। ভিট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে শরীর থেকে একটি নারী শরীর থেকে ডিম্বানু বের করে সংরক্ষন করে রাখা হয়। -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তরল নাইট্রোজেনের মধ্যে ডিম্বানুকে সংরক্ষন করে রাখা হয়। তবে ডিম্বানুকে সংরক্ষন করার পূর্বে ডিম্বানুতে থাকা জল বের করে দিতে হয়। কারন সংরক্ষনের সময় জলের কারনে তাপমাত্রা যত কমে ডিম্বানু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। ডিম্বানুকে সংরক্ষিত করতে ডিএমএসও নামে এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়।
কলকাতার স্বনামধন্য স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ স্বাতী মিশ্র ( Centre Head and Senior Consultant, Birla Fertility & IVF Kolkata) এগ ফ্রিজিং পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন। ডাঃ মিশ্র জানান “মেয়েদের শরীরে চল্লিশ বছর কিংবা পঞ্চাশ বছরে মেনোপজ চলে আসে তখন আর শরীরে কোনও ডিম অবশিষ্ট থাকেনা। একজন নারীর মাসিক চক্র শেষ হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে মেনোপজ বলে। সাধারনত চল্লিশ বছর বয়সের বয়সের পর থেকেই নারীর সন্তান ধারন ক্ষমতা কমতে শুরু করে এবং শরীরে মেনোপজ এসে গেলে আর মা হওয়ার সম্ভবনা থাকেনা। এই সময়ে নারী শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমন উৎপাদনও কমে যায়”। ডাঃ মিশ্র জানিয়েছেন একজন নারীর যতবার মাসিক হয় তত তার শরীর থেকে ডিম নষ্ট হয়ে যায় এবং ৩২ বছর বয়সের পর থেকে এই প্রক্রিয়া ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ৩৮-৪০ বছর বয়স আসতে আসতে একজন নারীর ৯৮ শতাংশ ডিমই নষ্ট হয়ে যায়। বিশেষ করে ৩৫ বছরের পর থেকে একজন নারীর ডিমে ক্রোমোজমীয় অস্বাভাবিকতা বেশী লক্ষ্য করা যায় যার কারনে ৩৫ বছর বয়সের পর বাচ্চা হলে সেই বাচ্চাতে জিনগত ত্রুটি থাকার সম্ভবনা বেশী রয়েছে। এই জন্য ডাঃ মিশ্র বলেছেন ৩২ বছর বয়সের আগে পর্যন্ত ডিম ভালো থাকে একজন মেয়ের। তিনি আরও বলেছেন মেয়েদের শরীরে ডিমের সংখ্যা নির্দিষ্ট। ভগবান প্রথমেই নারী শরীরে একটি নির্দিষ্ট পরিমান ডিম দিয়ে দিয়েছে, এটার পরিমান বাড়ানো কখনওই সম্ভব নয়।
ডঃ মিশ্র বলেছেন মেয়েদের মতো ছেলেদের স্পার্ম নির্দিষ্ট থাকেনা কিন্তু ৪০ বছর বয়সের পর থেকে শুক্রানুর গুনগত মান কমে যায় বিভিন্ন কারনে যেমন বয়সগত কারনে, অতিরিক্ত চিন্তার কারনে, খাদ্যাভ্যাস ও হরমোনের কারনে। এই একই কারন নরীদের ক্ষেত্রেও তদের ডিমের গুনগত মান কমিয়ে দেওয়ার কারন বলে জানিয়েছেন ডঃ মিশ্র। ডঃ স্বাতী মিশ্র এও বলেছেন একজন নারী ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত এবং একজন পুরুষ ৫৫ বছর বয়স বয়স পর্যন্ত টেস্টটিউব বেবি নিতে পারে কিন্তু ৪৫ বছর বয়সে এসে গেলে কোনও নারী নিজে টেস্টটিউব বেবির মাধ্যমে মা হতে পারবে কীনা! তাতে যথেষ্ট প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে, এই সময়ে বাধ্য হয়ে সন্তানের জন্য সারোগেট মায়ের প্রয়োজন হয়। ৩৭ বছর বয়সের পর কোনও মহিলা মা হতে গেলে আগে দেখা হয় তার ডিম্বানুতে ক্রোমোজমের কোনওরকম অস্বাভাবিকতা আছে কীনা কারন এমন হলে মিসক্যারেজের সম্ভবনা থাকে বলে জানিয়েছেন ডাঃ মিশ্র। সর্বশেষে ডঃ স্বাতী মিশ্র বলেছেন ২০ থেকে ৩০ বছর কিংবা সর্বোচ্চ ৩২ বছর বয়স পর্যন্ত মহিলাদের ডিম্বানু সবচেয়ে ভালো থাকে তারপর থেকেই ডিম্বানুর গুনগত মান কমতে শুরু করে।