অফবিট

গদ্দাফিকে গদি চ্যুত করতে আমেরিকার এল ডোরাডো ক্যানিয়ন

আফ্রিকা মহাদেশের উত্তর ভাগে একটি দেশ রয়েছে যার নাম লিবিয়া। এই লিবিয়া দেশটির উত্তরে রয়েছে ভূমধ্যসাগর ও তিউনিসিয়া, পূর্বে মিশর, পশ্চিমে আলজেরিয়া ও দক্ষিনে সুদান রয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৫১ সালে লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীন লিবিয়ার প্রথম শাসক হয় ইদ্রিস প্রথম। লিবিয়ার রাজা ছিল এই ইদ্রিশ প্রথম। ১৯৬৯ সাল আসতে আসতে লিবিয়ার রাজনীতিতে ইদ্রিস প্রথমের প্রভাব কমতে শুরু করে। তেল বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ রাজপরিবার নিজের ভোগবিলাসেই খরচ করতো বেশী, তাছাড়া দূর্নীতিও ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল দেশে। যার কারনে দেশের সাধারন মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। 

১ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯ সালে চিকিৎসার জন্য তুরস্ক যায় ইদ্রিস প্রথম। এই সুযোগে লিবিয়াতে রাজার বিরুদ্ধে সেনা বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। ২৭ বছর বয়সী জেনারেল গদ্দাফি লিবিয়ার মানুষকে বোঝায় রাজা প্রথম ইদ্রিসের কবল থেকে তাদের মুক্ত করে একটি উন্নত দেশ গঠন করা হবে। সেসময় সৌদিআরব, ইরান, ইরাক, জর্ডান, মিশর, সিরিয়া সহ সমস্ত আরব দেশগুলোতে শাসকরা নিজেদের সর্বোচ্চ নেতা মনে করতো। এদের সাথে পাল্লা দিয়েই লিবিয়ার নতুন শাসক নিযুক্ত হয় কর্নেল মহম্মদ গদ্দাফি। লিবিয়ার শাসন ক্ষমতায় গদ্দাফি আসার সাথে সাথে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।

প্রথমদিকে লিবিয়ার জনগন গদ্দাফিকে পূর্ন সমর্থন করেছিল কিন্তু সময়ের সাথে সাথে লিবিয়ার স্বৈরাচারী শাসক হয়ে উঠতে শুরু করে গদ্দাফি। লিবিয়াতে তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস ছিলনা কারও। গদ্দাফি ধীরে ধীরে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে চাইছিলো কিন্তু সেসময় মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে নিয়ম ছিল যে ইসরায়েলকে পরাজিত করতে পারবে তারই মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব থাকবে। 

১৯৬৯ সালে মিশর ইসরায়েল আক্রমন করে কিন্তু পরাজিত হয় মিশর। ১৯৭৩ সালে অনেক আরবদেশ যৌথভাবে ইসরায়েল আক্রমন করে কিন্তু এবারও আরবদেশ গুলো পরাজিত হয়। ততদিনে গদ্দাফি বুঝে যায় সরাসরি যুদ্ধে ইসরায়েলকে পরাজিত করা সম্ভব নয় সেকারনে গদ্দাফি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সহায়তা করা শুরু করে। বিশেষ করে রেড আর্মি ফ্রাকশন ও ফিলিস্তিন লিবারেশন সংগঠনের মতোন সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোকে সহায়তা শুরু করে লিবিয়া ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। ইসরায়েলকে প্রথম থেকেই সহয়তা করতো আমেরিকা ও ব্রিটেন। গদ্দাফির এসব সন্ত্রাসী সংগঠনকে সহায়তার কারনে ইউরোপ ও আমেরিকাও লিবিয়ার শত্রতে পরিনত হয়। গদ্দাফির কারনে আরবদেশ গুলোর সাথে বানিজ্যে সমস্যা দেখা দেয় আমেরিকা ও ইউরোপের। 

গদ্দাফি শুধু এখানেই থেমে থাকেনি, গদ্দাফি চাদ নামক একটি দেশও দখল করে নেয়। এরপর থেকেই আমেরিকা লিবিয়ার ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে পড়ে কারন চাদ এমন একটি দেশ যেখানে প্রচুর ইউরেনিয়াম ছিল। এরকম সময়ে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ খবর পায় লিবিয়া গোপনে পরমানু অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করছে। এরপরেই আমেরিকা সিদ্ধান্ত নেয় লিবিয়ার পরমানু সক্ষমতা ধ্বংস করতে হবে যাতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বজায় থাকে। অক্টোবর, ১৯৮৫ সালে আমেরিকা লিবিয়া আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৮ অক্টোবর থেকে লিবিয়াতে আক্রমনের জন্য অপারেশন ঘোস্ট রাইডার নামে একটি ডামি অপারেশন অনুশীলন শুরু করে আমেরিকা। ইংল্যান্ডের হেফোর্ড বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে দশটি এফ ১১১ বিমান কানাডার ল্যাব্রাডর ঘাঁটিতে পাঁচশো পাউন্ড বোম্ব আক্রমনের অনুশীলন শুরু করে আমেরিকান বায়ুসেনা। তবে এরই মধ্যে আরও দুটো আক্রমন করায় গদ্দাফি। ১৯৮৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর গদ্দাফির সহায়তায় রেড আর্মির সাতজন সন্ত্রাসী রোম ও ভিয়েনার বিমানবন্দরে আক্রমন করে যাতে ১৯ জন মানুষের মৃত্যু হয় ও ১৪০ জন আহত হয়। ১৯৮৬ সালের ৫ এপ্রিল পশ্চিম বার্লিনে লা বেলে নাইট ক্লাবে লিবিয়ান এজেন্টরা আক্রমন করে, এই ঘটনায় তিনজন মানুষের মৃত্যু হয় যার মধ্যে দুজন ছিল আমেরিকান এবং ২২৯ জন আহত হয় যার মধ্যে ৭৯ জনই আমেরিকান ছিল। পূর্ব জার্মানির লিবিয়ান দূতাবাস থেকে এই আক্রমন করা হয়েছিল। লিবিয়াতে এয়ারস্ট্রাইকের জন্য আমেরিকা এফ ১১১ বিমানকে বেছে নেয়, তবে এফ ১১৭ নাইটহকেও আমেরিকা বিকল্প হিসাবে প্রস্তত রেখেছিল। 

বিশ্বের প্রথম স্টেলথ বিমান বলা হয় এই এফ ১১৭ নাইটহককে। আমেরিকার গোপন ৪৪৫০ তম গোপন ট্যাকটিক্যাল গ্রুপকে এই অপারেশনের জন্য বিকল্প হিসাবে প্রস্তত রাখা হয়েছিল। নেভেদার টোনোপা টেস্ট রেঞ্জ এয়ারপোর্টে ৪৪৫০ তম বিভাগের কাছে সেসময় ৩০টি এফ ১১৭ নাইটহক বিমান ছিল। আমেরিকার অত্যন্ত গোপন প্রজেক্ট ছিল এই এফ ১১৭ নাইটহক। 

১৯৮৮ সালে অপারেশন ডেসার্ট স্ট্রোমের আগে বিশ্ব জানতোইনা এধরনের বিমানও আছে। আমেরিকার বায়ুসেনা, নৌসেনা একযোগে লিবিয়া আক্রমনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু আমেরিকার লিবিয়া আক্রমনের বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায় দূরত্ব। প্রথমে ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি ও ইউরোপীয়ান দেশগুলো তাদের বেস ও আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি আমেরিকাকে। যার কারনে আমেরিকাকে পর্তুগাল হয়ে ঘুরে গিয়ে জিব্রাল্টার প্রানালী অতিক্রম করে লিবিয়া পৌঁছাতে ২,৮০০ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করতে হত, এই পুরো যাত্রায় আমেরিকার যুদ্ধবিমানকে বেশ কয়েকবার জ্বালানি ভরতে হত কিন্তু অধিকাংশ দেশ আমেরিকাকে আকাশসীমা ব্যবহারে বারন করে দেওয়ায় সমস্যায় পড়ে আমেরিকা। আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগ্যান তখন ইউরোপীয় দেশগুলো ও আরব দেশগুলোর সাথে বেশ কয়েকবার বৈঠকে বসে, এরপর অবশেষে আমেরিকা আকাশসীমা ব্যবহারের অনুমতি পায়। 

১৯৮৬ সালের ১৪ এপ্রিল রোনাল্ড রিগ্যান লিবিয়া আক্রমনের নির্দেশ দেয়। লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলিতে গদ্দাফির গুরুত্বপূর্ন সেনা ঘাঁটি, কম্যান্ড সেন্টার, মিটিগা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, বেনগাজিতে বেনিনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সহ বেশ কীছু গুরুত্বপূর্ন সেনা ঘাঁটিতে এয়ারস্ট্রাইকের পরিকল্পনা করে আমেরিকা। এই এয়ারস্ট্রাইকেট নাম দেওয়া হয় অপারেশন এল ডোরাডো ক্যানিয়ন। ১৪ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটার সময় ইংল্যান্ডের মিলডেনহল এবং ফেয়ারফোর্ড বেস থেকে ২৮টি ম্যাকডোনেল ডগলাস কেসি ১০ ও বোয়িং কেসি ১৩০ ট্যাঙ্কার বিমান উড়ান শুরু করে। এফ ১১১ যুদ্ধবিমান গুলো মিশন শেষ করে বেসে ফিরে আসা পর্যন্ত এই ট্যাঙ্কার বিমানগুলো ৯,৭০০ কিলোমিটার জুড়ে চারটি এয়ার রিফুয়েলিং অপারেশনের দায়িত্বে ছিল। ট্যাঙ্কার ওড়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ইংল্যান্ডের লাকেনহিথ বেস থেকে ২৪টি এফ ১১১এফ যুদ্ধবিমান এবং হেয়ফোর্ড বেস থেকে পাঁচটি ইএফ ১১১এ রাভেনস বিমান উড়ান শুরু করে। ইএফ ১১১এ রাভেনস আমেরিকান বায়ুসেনার ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার যুদ্ধবিমান যা শত্রুর রেডার জ্যাম করার জন্য ব্যবহৃত হয়। রাত একটার সময় সিডরা উপসাগরে অবস্থিত আমেরিকার কোরাল সী এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে মার্ক ৮২ বোম্ব সহ ছয়টি এ সিক্সই ট্রাম যুদ্ধবিমান, ছয়টি এ ৭ করসেয়ার বিমান ও কিছু এফ ১৮ যুদ্ধবিমান লিবিয়ার উদ্দেশ্যে উড়ান শুরু করে। ১৫ এপ্রিল রাত ১:৫৪ নাগাদ লিবিয়ায় আক্রমন শুরু হয়। প্রথমেই লিবিয়ার রেডার জ্যাম করে দেয় ইএফ ১১১এ বিমান, এরপর এফ ১৮ এজিএম ৮৮ ও এজিএম ৪৫ মিসাইল লঞ্চ করে যা লিবিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়। বারো মিনিটের এই অভিযানে লিবিয়ায় বিভিন্ন লক্ষ্যবস্ততে ৬০ টন বোম্বিং করা হয়। জিবিউ ১০ প্যাভওয়ে ২ লেজার গাইডেড বোম্ব, বিএসইউ ৪৯ বোম্ব, এমকে ৮২ বোম্ব, সিবিইউ ৫৯ ক্লাস্টার বোম্ব ব্যবহার করে আমেরিকা এই অভিযানে। লিবিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আঘাতে একটি এফ ১১১ ধ্বংস হয়ে যায়। বাকী সমস্ত অপারেশন আমেরিকার পরিকল্পনা অনুযায়ী হয়। লিবিয়ার তিন থেকে পাঁচটি আইএল ৭৬ পরিবহন বিমান, দুটি মিলমি ৮ হেলিকপ্টার, একটি এফ ২৭ বিমান, চোদ্দটি মিগ ২৩ যুদ্ধবিমান, একটি বোয়িং ৭২৭ বিমান ও পাঁচটি রেডার স্টেশন ধ্বংস হয়ে যায় এই এয়ারস্ট্রাইকে। আমেরিকার একটি এফ ১১১ বিমান ধ্বংস হয় ও তার দুজন পাইলট নিহত হয়, এছাড়া আমেরিকার কোনও ক্ষতি হয়নি। লিবিয়ার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল তাও সমস্ত এয়ারডিফেন্স সিস্টেমই জ্যাম করে দিয়েছিল আমেরিকান বায়ুসেনা। মাল্টার প্রধামন্ত্রীর কাছ থেকে আগেই এই অভিযানের খবর পেয়ে গদ্দাফি তার পরিবার সমেত তার প্রাসাদ থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিল নাহলে এই এয়ারস্ট্রাইকে পুরো পরিবার সমেত গদ্দাফিও মারা যেত। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে গদ্দাফি ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপে অবস্থিত আমেরিকার উপকূল রক্ষা বাহিনীর কেন্দ্র লক্ষ্য করে দুটি স্কাড মিসাইল ফায়ার করে, যদিও মিসাইল দুটি লক্ষ্যে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয় ও সমুদ্রে গিয়ে ধ্বংস হয়। গদ্দাফি তার সন্ত্রাসী কাজকর্ম আরও বাড়িয়ে দেয় এই ঘটনার পর থেকেই। গদ্দাফি লিবিয়ার নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখে গ্রেট সোশ্যালিস্ট পিপলস লিবিয়ান আরব জামাহিরিয়াহ। অপারেশন এল ডোরাডোর কারনেই লিবিয়া পরমানু অস্ত্র তৈরি করতে পারেনি কোনওদিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *