অফবিট

দি ফাইভস কোর্ট গনহত্যা। ব্রিটিশরা যেভাবে অমানবিক ভাবে ভারতীয় সেনাদের হত্যা করেছিল

আঠারো শতক শেষ হতে হতে ক্যালকাটা, বোম্বে এবং মাদ্রাজ ভারতের এই তিনটি বড় শহরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। এই তিনটি প্রধান শহরের অনেক ছোট বড় ভারতীয় রাজ্য ছিল। এসমস্ত রাজ্যের মধ্যেই অনেক রাজ্যেই ব্রিটিশদের প্রভাব ছিল অথবা ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ছিল। কিন্ত দক্ষিন ভারতে তখন এক রাজা ছিল যে ব্রিটিশদের আধিপত্য স্বীকার করেনি এবং যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজিত করেছিল। এই রাজাটি হল মহীশুরের রাজা টিপু সুলতান। পুরো জীবনকালে টিপু সুলতান ২০ বছর ইংরেজদের সাথে লড়াই করেছে। টিপু সুলতানের জীবনের শেষ যুদ্ধ ছিল ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সেরিঙ্গাপটমের যুদ্ধ। বলা হয় ব্রিটিশরা টিপু সুলতানকে এতটাই ভয় পেত যে তার মৃত্যুর পরও তার মৃতদেহের কাছে যেতেও প্রথমে ভয় পেয়েছিল ব্রিটিশরা। টিপু সুলতানের পর দক্ষিন ভারতে এমন কোনও রাজা ছিলনা যারা ব্রিটিশদের পরাস্ত করতে পারতো। কিন্তু ব্রিটিশরা জানতো টিপু সুলতানের অনেক ছেলে রয়েছে, এদের মধ্যে কোনও একজনও যদি ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় তাহলে পুরো দাক্ষিনাত্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে চলে যাবে। এজন্য ব্রিটিশরা টিপু সুলতানের সমস্ত ছেলেকে দক্ষিন ভারতের অতীব সুন্দর একটি জায়গা ভেল্লোরের দুর্গে রেখে দেয়।

টিপু সুলতানের বারো ছেলে, আট মেয়ে ছিল, এই পুরো পরিবারকে ব্রিটিশরা ভেল্লোর দুর্গে এক প্রকার গৃহবন্দী রাখে। এদের ব্রিটিশরা বছরে ২৫,০০০ টাকা পেনশনও দিত। ব্রিটিশরা লোক দেখানো এই পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ২০০০ সেনা মোতায়েন রেখেছিল দুর্গের আশেপাশে যার মধ্যে ৩৮৩ জন ইউরোপীয়ান ছিল এবং বাকীরা ভারতীয় ছিল। কিন্তু ব্রিটিশদের এত বিশাল সেনা মোতায়েনের উদ্দেশ্য ছিল যাতে বাইরের কারোর সাথে মিলিত হয়ে টিপু সুলতানের সন্তানরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে না পারে। তবে দুর্গের ভিতর টিপু সুলতানের নিজস্ব কিছু লোকও ছিল যারা ব্রিটিশদের অধীনে ছিলনা। তবে দুর্গ সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা এক ব্রিটিশ অফিসার উদ্বর্তন কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেছিল টিপু সুলতানের পরিবারকে বছরে ২৫,০০০ টাকা করে না দেওয়ার। তবে ব্রিটিশরা টিপু সুলতানের পরিবারকে বছরে ২৫,০০০ টাকা দেওয়া বন্ধ করেনি কারন ব্রিটিশরা জানতো এর থেকে কয়েকগুন বেশী সম্পদ তারা ভারত থেকে লুঠ করছে। দুর্গের দায়িত্বে থাকা ইংরেজ অফিসাররা প্রায়ই অভিযোগ করতো ভারতীয় সেনাদের পোষাক ভালো নয়, তাদের কেউ তিলক কাটে, কারও বড় দাড়ি আবার কারো চওড়া গোঁফ। এজন্য একজন বড় ব্রিটিশ অফিসার জন ক্রাড্যাক নির্দেশ দেন সমস্ত ভারতীয় সেনাদের দাড়ি কাটতে হবে, গোঁফ সবাইকে সমান রাখতে হবে এবং বিশেষ একটি পাগড়ি পড়তে হবে। সমস্যা তৈরি হয় এই পাগড়ি নিয়ে। ব্রিটিশদের নির্দেশিত পাগড়ি অনেকটা ইউরোপীয়ান সৈন্যদের মতোন ছিল দেখতে, যার জন্য ভারতীয় সেনারা বলতে শুরু করে এই পাগড়ি পড়িয়ে ব্রিটিশরা তাদেরকে ইউরোপীয়ানদের মতো তৈরি করতে চাইছে। এই পাগড়ি নিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল পাগড়ি তৈরিতে গরু ও শুয়োরের চর্বি ব্যবহার করা হত। সেসময় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই ছিল। তাই ধর্ম ভ্রষ্ট হওয়ার ভয়ে উভয়পক্ষই বিরোধীতা শুরু করে। এরকম পরিস্থিতিতে দেখে ব্রিটিশ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জন ফ্যানকোর্ট জন ক্রাড্যাককে চিঠি লিখে অনুরোধ করে পাগড়ির নিয়ম পরিবর্তন করতে। কিন্তু জন ক্রাড্যাক জানায় নিয়ম পরিবর্তন হলে ভারতীয় সেনারা বারবার এমন বিরোধীতা করবে। জন ক্রাড্যাক নির্দেশ দেয় যারা বিরোধীতা করছে তাদের গ্রেফতার করতে তাদের বিরুদ্ধে বিচার হবে। এই ঘটনায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে থেকে ২১ জনকে গ্রেফতার করা হয় যাদের মধ্যে হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মের লোকই ছিল। বিচারের পর প্রত্যেক সেনাকে ৫০০ টি করে বেত্রাঘাত করা হয়। এই অমানবিক সাজার পরেও ভারতীয় সেনারা পাগড়ি পড়তে বিরোধীতা করে। কিন্তু ভারতীয় সেনারা বুঝে গিয়েছিল সরাসরি ব্রিটিশদের বললে তারা তাদের দাবী মানবেনা উল্টে সাজা দেবে। এই জন্য ভারতীয় সেনারা একটি বিদ্রোহ করবার পরিকল্পনা করে যাতে ভেল্লোর দুর্গে থাকা সমস্ত ব্রিটিশ সেনাদের হত্যা করা হবে। ১৮০৬ সালের ১৭ জুন প্রথম মাদ্রাজ নেটিভ ইনফ্রেন্টির একজন সেনা এক ইংরেজ অফিসারের কাছে গিয়ে জানায় তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবার পরিকল্পনা চলছে। কিন্তু ব্রিটিশরা ওই সেনার কথা বিশ্বাস না করে তাকে গ্রেফতার করে। ৯ জুলাই ভেল্লোর দুর্গে টিপু সুলতানের মেয়ের বিয়ে ছিল সেজন্য বহু অতিথি বাইরে থেকে দুর্গে আসে। কিন্তু অতিথির পোষাকে বেশীরভাগ লোকই সেনা ছিল। সেসময় ব্রিটিশরা সেনাবাহিনীর গুলি চালানোর প্রশিক্ষনের জন্য প্রতিমাসে সেনাবাহিনীকে দুর্গ থেকে এক দুইদিনের জন্য বাইরে নিয়ে যেত এবং যেদিন বাইরে যাওয়ার কথা থাকতো তার ঠিক একদিন আগে সমস্ত সেনা তাদের অস্ত্র নিয়ে দুর্গের ভিতর চলে যেত। সেজন্য এইরকম সময়কেই বিদ্রোহের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল। 

১৮০৬ সালের ১০ জুলাই নিয়মমাফিক গুলি প্রশিক্ষনের জন্য সেনাদের বাইরে যাবার কথা ছিল অর্থাৎ টিপু সুলতানের মেয়ের বিয়ের পরের দিন। ৯ জুলাই সেনার দুর্গের ভিতর চলে যায়। ৯ জুলাই মধ্যরাতে জন ফ্যানকোর্ট তার ঘরের বাইরে বিস্ফোরনের শব্দ পায়। ফ্যানকোর্ট বাইরে বেরিয়ে দেখে চারদিকে গুলি চলছে। আসলে ভারতীয় সেনারা বিদ্রোহ শুরু করে দিয়েছিল এবং ইংরেজ সেনাদের উপর তারা গুলি চালাচ্ছিলো। ভেল্লোর দুর্গে বিদ্রোহে সেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীরই জয় হত কিন্তু ভাগ্য ব্রিটিশদের সহায় ছিল। জন ফ্যানকোর্টের এক বন্ধু কর্নেল রোলো গিলেসপি ভোর বেলায় তার বন্ধুর সাথে দেখা করতে ভেল্লোর আসছিল। রোলো গিলেসপি জানতোনা ভেল্লোরে বিদ্রোহ চলছে। ভেল্লোরের কাছে আসতেই তিনি দেখেন এক ব্রিটিশ সেনা ঘোড়া করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। ওই সেনা গিলেসপিকে বিদ্রোহের ব্যাপারে জানায়। সাথে সাথে গিলেসপি তার দুর্গে ফিরে গিয়ে ব্রিটিশ সেনাদের সাথে নিয়ে ভেল্লোর দুর্গের দিকে রওনা দেয়। গিলেসপি তার সাথে করে দুটি ছোট কামানও নিয়ে এসেছিল। এই কামানের সাহায্যেই দুর্গের দরজা ভেঙে গিলেসপি ও তার বাহিনী দুর্গে প্রবেশ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমন শুরু করে। যেহেতু সমস্ত ভারতীয় সেনা দুর্গের ভিতরেরই ছিল সেজন্য তাদের বাইরে পালানোর কোনও উপায় ছিলনা। সেসময় ব্রিটিশ শাসনে নিয়ম ছিল বিদ্রোহ হলে বিদ্রোহীদের গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে বিচার চলবে। কিন্তু গিলেসপি এই নিয়ম না মেনে নিজের ইচ্ছে মতো শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গিলেসপি সমস্ত ভারতীয় সেনাকে গ্রেফতার করে ভেল্লোরে এবং তাদের একটি ফাইভস কোর্টে বন্দী করে। ফাইভস কোর্টে তিনদিকে দেয়াল থাকে এবং ভিতরে দেওয়ালে বল মেরে খেলোয়াড় খেলে, অনেকটা স্কোয়াশের মতোন। এই ফাইভস কোর্টে ভারতীয় সেনাদের বন্দী করে। তাদের সামনে কামান নিয়ে আসা হয় এবং বন্দীদের উপর ফায়ারিং শুরু করা হয়। যতক্ষননা শেষ বন্দী মারা যাচ্ছে ততক্ষন পর্যন্ত ফায়ারিং চলতে থাকে। এভাবে গিলেসপি ৩৫০ জন ভারতীয় সেনাকে হত্যা করেছিল। এই ঘটনাকে দি ফাইভস কোর্ট গনহত্যা বলা হয়। রোলো গিলেসপি টিপু সুলতানের সমস্ত ছেলেেদর হত্যা করবার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল কিন্তু তাকে ব্রিটিশ অফিসাররা আটকায়। এই ঘটনার পর ভেল্লোর দুর্গের অবশিষ্ট সমস্ত ভারতীয় সেনাদের গ্রেফতার করা হয় এবং তাদের মধ্যে অনেককে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। জন ফ্যানকোর্টের এই বিদ্রোহে মৃত্যু হয়েছিল এবং জন ক্রাড্যাককে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে বের করে দিয়ে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *