মৃত্যু রহস্যের সমাধান আজও হয়নি। বলিদান দিবসে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মরনে ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশেষ কার্যক্রম
২৩ জুন ভারতের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক দিন। ৭১ বছর আগে ২৩ জুনেই কাশ্মীরে রহস্যময় ভাবে মৃত্যু হয়েছিল ভারত মায়ের বীর সন্তান ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। বাংলার বাঘ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের গুনী পুত্র ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় না থাকলে আজ পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তানে চলে যেত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় মহম্মদ আলি জিন্নাহের মুসলীম লীগের ঘৃন্য পরিকল্পনা থেকে পশ্চিমবঙ্গ তথা বাঙালি হিন্দুদের পাকিস্তানের নাগরিক হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন এই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। আজীবন অখন্ড ভারত গঠনের সংকল্পে বিশ্বাসী ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন।
১৯৫০ এর দশকে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হন ওমর শেখ আবদুল্লাহ যিনি জওহরলাল নেহেরুর বন্ধু ছিলেন। সেসময় কাশ্মীরকে বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার নামে আর্টিকেল ৩৭০ জারি করা হয় কাশ্মীরে। আর্টিকেল ৩৭০ অনুযায়ী কাশ্মীরের নিজস্ব পতাকা, প্রধান ও সংবিধান ছিল। সেসময় ভারতের রাষ্ট্রপতিকেও কাশ্মীরে প্রবেশ করতে হলে কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি লাগতো, এমনকী ভারতীয়দের কাশ্মীরে যেতে গেলেও অনুমতি পত্রের প্রয়োজন হত। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এই আর্টিকেল ৩৭০ এর বিরোধী ছিলেন। তাঁর দাবী ছিল কাশ্মীর যেহেতু ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ সুতরাং একই দেশে দুইরকম পতাকা, বিধান কেন থাকবে? এই জন্য তিনি জওহরলাল নেহেরুর মন্ত্রীসভা ত্যাগ করে কাশ্মীর আসেন প্রতিবাদ জানাতে। কাশ্মীরে তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন এই ঘটনার প্রতিবাদে। যার জন্য ১৯৫৩ সালের ১১ মে কাশ্মীরে ওমর আবদুল্লাহ সরকারের পুলিশ অনৈতিক ভাবে গ্রেফতার করে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে। ডঃ মুখোপাধ্যায়ের সেসময় বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও তাকে শ্রীনগরে একটি জেলে রীতিমতো অবহেলায় বন্দী করে রাখা হয়েছিল। শ্রীনগরে জেলে থাকা অবস্থায় ২৩ জুন অদ্ভুত ভাবে মারা যান তিনি। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু রহস্যের সমাধান আজও হয়নি। তৎকালীন সরকার এই ঘটনার জন্য কোনওরূপ তদন্ত কমিশন পর্যন্ত গঠন করেনি। এমনকী ডঃ মুখোপাধ্যায়ের মায়ের বহু অনুরোধ সত্বেও প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তদন্ত কমিটি গঠন করেননি। ভারত মায়ের এই মহান সন্তানের মৃত্যু দিবস উপলক্ষে ২৩ জুন দিনটাকে বলিদান দিবস হিসাবে পালন করা হয়। গতকাল সারাদেশে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সম্মানে বলিদান দিবস পালন করা হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বলিদান দিবস উপলক্ষে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে সম্মান জানিয়েছেন। কাশ্মীরের লালচকে খুব শীঘ্রই ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের একটি মূর্তিও বসাবে ভারত সরকার।

বলিদান দিবসের স্মরনে গতকাল দক্ষিন কলকাতায় অবস্থিত কেওড়াতলা মহাশ্মশানে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বিশেষ শ্রদ্ধা অর্পন করেন রাজ্য বিজেপির কর্মকর্তা ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়। মহাশ্মশানে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ব্রোঞ্জের মূর্তিতে মাল্যদান করা হয়। ১৯৫৩ সালের ২৪ জুন এই কেওড়াতলা মহাশ্মশানেই অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অন্তিম সংস্কার করা হয়েছিল। সেসময় ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত দেহ দিল্লি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। সরাসরি কাশ্মীর থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে স্থানীয় বিজেপি কর্মী সমর্থকদের উপস্থিতিতে ১৯৫৩ সালের ২৫ জুন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের এক জনপ্রিয় সংবাদপত্র সত্যযুগে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে প্রকাশিত একটি প্রতিবদেনও পাঠ করা হয় মহাশ্মশানে। এরপর বলিদান দিবসের স্মরনে হাজরা মোড়ের যতীন দাস পার্কে ভারতীয় জনতা যুব মোর্চার উদ্যোগে হওয়া একটি রক্তদান শিবিরেও যান ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়। গত ৪৫ বছর ধরে যতীন দাস পার্কে ২৩ জুন তারিখে এই রক্তদান শিবির আয়োজিত হয়ে আসছে। সেখানে বলিদান দিবস উপলক্ষে একটি বক্তব্য রাখেন ডঃ গঙ্গোপাধ্যায়। এরপর সন্ধ্যা নাগাদ যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত দক্ষিন সোনারপুর থানা মোড়ে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মরনে আয়োজিত একটি সভা থেকেও সাধারন মানুষের উদ্দেশ্যে একটি বক্তৃতা দেন ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়। বক্তব্যের শুরুতেই উপস্থিত সকল মানুষকে সম্মান জানিয়ে ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন আজ পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যে মানুষ অবাধে যাতায়াত করতে পারছে, বসবাস করছে এর সিংহভাগ কৃতিত্বই ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের দূরদর্শীতার জন্যই পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্য তৈরি হয়েছে এবং বাঙালি হিন্দুরা পাকিস্তানের উদবাস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। মঞ্চ থেকে দক্ষিন সোনারপুরের মানুষদের অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন তিন দক্ষিন সোনারপুরের মানুষদের কাছে কৃতজ্ঞ যে তারা বিজেপিকে ভোট দিয়েছে এবং পুনরায় মাননীয় নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রী করেছে। পাশাপাশি রাজ্যবাসীর কাছে তিনি ক্ষমাও চান কারন শাসকদল বলিদান দিবস সম্পর্কে কোনওরূপ কর্যক্রম না করায়। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন যদি পশ্চিমবঙ্গ গঠন না হয়ে অবিভক্ত বাংলা থাকতো তবে হিন্দুরা সেখানে সংখ্যা লঘু হত। জিন্নাহ ও মুসলীম লীগ ষড়যন্ত্র করে অবিভক্ত বাংলা গঠনের চেষ্টা করেছিল যাতে পরে বাংলাকে পাকিস্তান করে দেওয়া যায়। এরকম হলে আজ সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ পাকিস্তানের অংশ হত। ডঃ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন পশ্চিমবঙ্গ গঠন করা সেই ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কেই বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে বাঙালিকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। সভা থেকে বামপন্থীদের কটাক্ষ করে ডঃ অনির্বান বাবু বলেন বামপন্থীরা পাকিস্তান গঠনে সমর্থন করেছিল। বামপন্থীরা চট্টগ্রাম, কলকাতা, নোয়াখালী সর্বত্র পাকিস্তান গঠনের সমর্থনে মিছিল করেছিল। বামপন্থীদের দাবী ছিল পাকিস্তান গঠন হলে তবেই ভারত স্বাধীনতা পাবে। কিন্তু ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তার অসাধারন দূরদর্শীতায় বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ভাগ হলে বাঙালি হিন্দুরা শরনার্থী হয়ে যাবেন, তাই তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায় সোনারপুরের মঞ্চ থেকে জানান ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় শুধু পশ্চিমবঙ্গকে নয় ত্রিপুরা এবং আসামকেও পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হওয়া থেকে আটকেছিলেন।
ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ১৯৪৭ সালে ত্রিপুরার আগরতলাতে বিশাল জনসভা করেছিলেন ত্রিপুরাকে পাকিস্তানে যাওয়াতে আটকাতে। ত্রিপুরার রাজার সাথে ডঃ মুখোপাধ্যায়ের সুসম্পর্ক ছিল, সেই জন্য রাজাকে সাথে নিয়ে এবং সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সহযোগিতায় ত্রিপুরাকে রক্ষা করেন তিনি। ১৯৫৩ সালের ১১ মে কাশ্মীরে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গ্রেফতার হওয়ার প্রসঙ্গও উঠে আসে ডঃ অনির্বান গঙ্গোপাধ্যায়ে গলায়। তিনি বলেন দক্ষিন কলকাতার সাংসদ হওয়া সত্বেও উজ্জ্বল রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিসর্জন দিয়ে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কাশ্মীরকে বাঁচাতে ছুটে যান। ছয় মাস ধরে তিনি ওমর শেখ আবদুল্লাহ ও জওহরলাল নেহেরুকে আর্টিকেল ৩৭০ তুলে নেওয়ার ব্যপারে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় তিনি কাশ্মীরে গিয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করবার স্থির করেছিলেন। কিন্তু তাকে কাশ্মীর পুলিশ গ্রেফতার করে ৪১ দিন ভয়াবহ অবস্থায় বন্দী রেখেছিল। জওহরলাল নেহেরু সাতদিন কাশ্মীরে ছুটি কাটাতে গেলেও তিনি ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করতে যাননি। অনির্বান বাবু আরও বলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয় ভুল ঔষধ প্রয়োগের দ্বারা। দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে সমগ্র দেশবাসী আজীবন মনে রাখবে।