অফবিট

ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে গবেষনার জন্য অভিনব প্ল্যান ইসরোর। এক্সপোস্যাট পাঠালো মহাকাশে

প্রতিবছর মহাকাশ গবেষনার ক্ষেত্রে নতুন নতুন নজির তৈরি করছে ইসরো। সম্প্রতি ভারতের মহাকাশ গবেষনা সংস্থা ইসরো বা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন সফলভাবে মহাকাশে এক্সপোস্যাট লঞ্চ করেছে। ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে গবেষনার জন্য ইসরো এই এক্সপোস্যাট লঞ্চ করেছে। মহাকাশের অদ্ভুত জিনিস এই ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহ্বর। 

বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে অসংখ্য গ্রহ, নক্ষত্র রয়েছে, এক একটি নক্ষত্রের আয়তন গ্রহগুলোর থেকে অনেক বেশী হয়। স্বাভাবিক নিয়মে একটা সময় প্রতিটি নক্ষত্রেরই মৃত্যু হয়। নক্ষত্র ধ্বংস হওয়ার আগে বিশাল বিস্ফোরন ঘটে, এই ঘটনাকে সুপারনোভা বলে। কোনও বিশাল নক্ষত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে সেই বিশাল নক্ষত্রের ভর ও অভিকর্ষীয় বল একটি বিন্দুতে মিলিত ভাবে মহকাশের কোনও স্থানে একটি বিশাল অন্ধকারময় এলাকা তৈরি করে, একেই ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহ্বর বলে। এই কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষন বল এতটা তীব্র হয় যে আশেপাশের সমস্ত কিছু কোনও গ্রহ হোক কিংবা নক্ষত্র সবই কৃষ্ণ গহ্বরে প্রবেশ করে, এমনকী আলো ও তড়িতচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ পর্যন্ত ব্ল্যাকহোল থেকে রেহাই পায়না। যেমন সূর্যের আয়তন কয়েক লাখ কিলোমিটার, সূর্য কোনওদিন ব্ল্যাকহোলে প্রবেশ করবে যদি সূর্যের আয়তনের ও ভরের তুলনায় তিনগুন ভরের কোনও ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়। ব্ল্যাকহোলে প্রবেশের পর সমস্ত কিছুর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় চিরকালের জন্য। খালি চোখে এই কৃষ্ণ গহ্বরকে চোখে দেখা যায়না। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা গবেষনার সময় মহাজাগতিক রশ্মির উপর নজর রাখে। যদি আলো তার গতিপথে কোনও জায়গায় বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন ধরে নেওয়া হয় সেই জায়গায় কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি হয়েছে। এই ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে এখনও আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। মহাকাশে কতগুলো ব্ল্যাকহোল আছে, তাদের অবস্থান বিশেষ করে দানবীয় ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে তেমন কোনও তথ্যই নেই মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে। দানবীয় ব্ল্যাকহোল সাধারনত ছায়াপথের মাঝখানে থাকে। যেমন আমাদের সৌরজগত আকাশগঙ্গা ছায়াপথে অবস্থিত। একটি ছায়পথে কোটি কোটি নক্ষত্র থাকে। যেমন আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে ২০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে। এই আকাশগঙ্গা ছায়াপথের মাঝামাঝি জায়গায় রয়েছে বিশাল বড় দানবীয় ব্ল্যাকহোল। 

আমাদের সৌরজগত আকাশগঙ্গা ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে ২৭,০০০ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। এসব ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে গবেষনা ও তথ্যের জন্যই ইসরো এই মিশন লঞ্চ করেছে যা ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানের সাফল্যে আরও একটি অনন্য নজির তৈরি করেছে।

একস্পোস্যাট অর্থাৎ এক্সরে পোলারিমিটার স্যাটেলাইট একটি অত্যন্ত জটিল মিশন। আমেরিকার নাসার পর ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় দেশ হিসাবে এইধরনের আধুনিক মহাকাশ পর্যবেক্ষন মিশন লঞ্চ করেছে। ভূমি থেকেও বিশেষ সেন্টার থেকে মহাকাশ পর্যবেক্ষন করা হয়, যেমন লাদাখে হ্যানলে পর্যবেক্ষন কেন্দ্র রয়েছে কিন্ত আবহাওয়াতে দূষনের কারনে, বায়ুমন্ডলের স্তরের কারনে অনেক সময় সঠিক ভাবে পর্যবেক্ষন করা সম্ভব হয়না যার জন্য মহাকাশে উপগ্রহ বা মহাকাশযান পাঠাতে হয়। এই একস্পোস্যাট ব্ল্যাকহোল সহ নিউট্রন স্টার সম্পর্কে পর্যবেক্ষন করবে। কোনও বিশাল নক্ষত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে তার ছোট অংশকে নিউট্রন তারা বলা হয়। মহাকাশে ব্ল্যাকহোল সহ নিউট্রন তারা থেকে নির্গত এক্সরে ও মহাজাগতিক রশ্মি সম্পর্কে গবেষনার জন্য পাঠানো এক্সপোস্যাট প্রথম কোনও বিশেষ স্যাটেলাইট। গত ১ জানুয়ারি পিএসএলভি সি৫৮ রকেটে করে শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান সকাল ৯:১০ এ লঞ্চ করা হয় এক্সপোস্যাটকে। লঞ্চ করার ২২ মিনিট পর এক্সপোস্যাট পৃথিবীর ৬৫০ কিলোমিটার উপরে নিম্ন কক্ষপথে প্রবেশ করে। তবে পিএসএলভি সি৫৮ রকেটকে শুধু একস্পোস্যাটের জন্যই মহাকাশে পাঠানো হয়নি।

পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে ৬৫০ কিলোমিটার উপরে নিম্নকক্ষপথে একস্পোস্যাটকে কক্ষপথে স্থাপন করার পর পিএসএলভি রকেটকে পৃথিবীপৃষ্ঠের ৩৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় নামিয়ে আনা হয় এবং চতুর্থ স্টেজ বা পিএস৪ স্টেজ শুরু করা হয়। পিএসএলভি রকেটে ইনস্পেস ও ইসরোর পাঠানো আরও দশটি পলোডকে রয়েছে। এই পদ্ধতিকে পোয়েম ৩ বা পিএসএলভি এক্সপিরিমেন্টাল অরবিটাল মোডেল ৩ বলা হয়। এই মিশন পিএসএলভি রকেটের ষাটতম উড়ান ছিল এবং ডিএল ভার্সনের চতুর্থ উড়ান ছিল। এক্সপোস্যাটের ওজন ৪৮০ কেজি, এতে দুটি পেলোড রয়েছে যার ওজন ১৪৪ কেজি। এক্সপোস্যাটে ব্যবহৃত দুটি পেলোড হচ্ছে পোলিক্স বা পোলারিমিটার ইন্সট্রুমেন্ট ইন এক্সরে এবং এক্সপেক্ট বা এক্সরে স্পেকট্রোস্কোপি এন্ড টাইমিং। পোলিক্স তৈরি করেছে রামান রিসার্চ ইন্সটিটিউট এবং এক্সপেক্ট তৈরি করেছে ইউ আর রাও স্যাটেলাইট সেন্টার। এক্সপোস্যাট মহাবিশ্বের ৫০ টি উজ্জ্বল উৎস যেমন ব্ল্যাকহোল, সুপারনোভা, পালসার, এক্সরে বাইনারিস, নিউট্রন তারার উপর গবেষনা করার পাশপাশি মহাজাগতিক রশ্মির পৃথিবীর উপর কী প্রভাব পড়ে তা সম্পর্কেও অধ্যায়ন করবে। এই মিশন ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের মহাকাশ সম্পর্কে জ্ঞান আরও বৃদ্ধি করবে। লিকুইড প্রোপালশন সিস্টেম সেন্টারের ডিরেক্টর ভি নারায়ন জানিয়েছেন আমেরিকার নাসার পর ভারতের এক্সপোস্যাটই বিশ্বের দ্বিতীয় স্যাটেলাইট যা মহাজাগতিক বস্তর এক্সরে ও মহাজাগতিক রশ্মি পর্যবেক্ষনের জন্য পাঠানো হয়েছে। নাসা ২০২১ সালে একস্পোস্যাটের মতোনই ইমেজিং এক্সরে পোলারিমেট্রি এক্সপ্লোরার বা আইএক্সপিই পাঠিয়েছে। 

২০১৭ সালেই ইসরো এক্সপোস্যাট মিশন শুরু করে যার জন্য প্রাথমিক ভাবে নয় কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা বাজেট দেওয়া হয়েছিল ইসরোকে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে এক্সপোস্যাটের পোলিক্স ধাপের পরীক্ষা করা হয়। স্যাটেলাইট ডিরেক্টর বৃন্দাবন মাহাতা জানিয়েছেন এক্সপোস্যাট গোটা বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়কে সাহায্য করবে। পিএসএলভি সি৫৮ রকেটের পোয়েম ৩ স্টেজকে একপ্রকার স্পেস স্টেশনও বলা চলে। আন্তর্জাতিক স্পেশ স্টেশনে যেমন মহাকাশচারীরা যায়, গবেষনা হয় ঠিক তেমনই পোয়েম ৩ তেও গবেষনা হবে কিন্তু এখানে কোনও মহাকাশচারী যেতে পারবেনা৷ পোয়েম ৩ তে যে দশটি পেলোড রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ওমেন ইঞ্জিনিয়ারিং স্যাটেলাইট বা উইস্যাট যা তৈরি করেছে তিরুবন্তপুরমের এলবিএস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি ফর ওমেন। এছাড়াও কেজি ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির তৈরি বিলিফস্যাটো, টেকমি২স্পেসের তৈরি রেডিয়েশন শিল্ডিং এক্সপেরিমেন্টাল মডিউল, ইন্সপেসিটি স্পেস ল্যাব প্রাইভেট লিমিটেডের তৈরি গ্রীন ইম্পালস ট্রান্সমিটার, ধ্রুব স্পেস প্রাইভেট লিমিটেডের একটি পেলোড, বিক্রম সারাভাই স্পেস সেন্টার ও বেলাট্রিক্স এরোস্পেস প্রাইভেট লিমিটেডের দুটি করে পেলোড এবং ইসরোর ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির একটি পেলোড রয়েছে পিএসএলভি সি৫৮ তে। এসব পেলোডের দ্বারা অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করা হবে। এক্সপোস্যাটের জীবনকাল পাঁচ বছর। এক্সপোস্যাটের সফল উৎক্ষেপনের পর ইসরোর চেয়ারম্যান কে সোমনাথ বলেছেন ২০২৪ হবে গগনযানের। ২০২৪ সালে ইসরো আরও দুটি ফ্লাইট টেস্ট করবে, তাছাড়া পিএসএলভি, জিএসএলভি ও এসএসএলভির উৎক্ষেপন হবে অর্থাৎ ২০২৪ সাল ইসরোর জন্য খুব ব্যস্ততম বছর হতে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *