অফবিট

২০ জুন কী পশ্চিমবঙ্গ দিবস!! এর ঐতিহাসিক সত্যতা কী?

২০ জুন দিনটিকে বিজেপি ও আরএসএস পশ্চিমবঙ্গের প্রতিষ্ঠা দিবস বা পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করে। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন আজকের দিনেই পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের গঠন হয়েছিল। এই জন্য ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০ জুন দিনটিকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করার চিন্তাভাবনা শুরু করেন। 

২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করার নির্দেশ দেন। পাশপাশি ভারতের বাকী সব রাজ্যকেও এই নির্দেশ দেওয়া হয়৷ সেই অনুযায়ী ২০২৩ সালের ২০ জুন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস রাজভবনে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করেন। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঘটনার বিরোধীতা করে সিভি আনন্দ বোসকে একটি চিঠি পাঠান। চিঠিতে তিনি রাজ্যপালকে জানান ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করার ঘটনায় তিনি যথেষ্ট অবাক হয়েছেন কারন ইতিপূর্বে পশ্চিমবঙ্গে এরকম বিশেষ কোনও দিন পালন করা হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের ঐতিহাসিক কোনও ভিত্তি নেই বলেও লিখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য ছিল ২০ জুন বাংলাকে বিভক্ত করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য তৈরি করা হয় তা খুবই দুঃখজনক ঘটনা, বিজেপি সাম্প্রদায়িক কারনেই এই ২০ জুন দিনটাকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরপরে আগস্ট মাসে মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে একটি বৈঠক করেন যেখানে পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবি গোষ্ঠী ও বিজেপি ছাড়া অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১ বৈশাখ দিনটিকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করা হবে এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা বাংলার মাটি বাংলার জল গানটিকে রাজ্য সংগীত হিসাবে পালন করা হবে। 

ভারতে দীর্ঘদিন ধরে শাসন করার জন্য ব্রিটিশরা ১৯০৫ সালে বাংলাকে বিভক্ত করে। বহুদিন ধরেই বাংলাতে হিন্দু মুসলিম বিভেদ চলছিলো ব্রিটিশরা এই পরিস্থিতির সুযোগ নেয়। ব্রিটিশরা জানতো হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে অশান্তি লাগাতে পারলে আরও বহুকাল ভারতবর্ষের ক্ষমতায় থাকা যাবে। সেজন্য ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড কার্জনের নেতৃত্বে ১৯০৫ সাল বাংলাকে দুভাগে বিভক্ত করা হয়, আসাম ও পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ। সেসময় বিহার, ওড়িশাও পশ্চিমবঙ্গেরই অংশ ছিল। ব্রিটিশদের এই বিভক্তিকরন রাজনীতির বিরুদ্ধে সেসময় সাধারন মানুষ গর্জে ওঠে, ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশদের এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমারা সোনার বাংলা গানও লেখেন। অবশেষে তীব্র প্রতিবাদের কারনে ব্রিটিশরা ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে বাধ্য হয়। তবে এটাও বেশী দিনের জন্য স্থায়ী ছিলনা। দেশে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। মহম্মদ আলি জিন্নাহ মুসলিমদের জন্য আলাদা একটি দেশ চাইছিলো যার জন্য তার ইশারাতে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত ১৯৪৬ সালে। নোয়াখালী গনহত্যা, দি গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এর মতো হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বাংলা জুড়ে অসংখ্য হিন্দুদের হত্যা করা হয়। সেসময় বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, তার ইশারাতেই কলকাতায় গনহত্যা হয়েছিল। এসব ঘটনার পরেই বাংলার হিন্দুরা বাংলা বিভাগের পক্ষে চলে যায়। 

ভারত পাকিস্তান বিভাগের সময় পুরো বাংলা পাকিস্তানেই চলে যেত যদি না শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় থাকতেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভারতকে বিভক্ত করে তিনটি দেশ তৈরির দাবী করেছিল ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তবঙ্গ। যুক্তবঙ্গতে সম্পূর্ন অবিভক্ত বাংলা থাকার কথা ছিল। কিন্তু হিন্দু মহাসভার নেতা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বুঝতে পারেন এটাও মহম্মদ আলি জিন্নাহ ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একটি জঘন্য ষড়যন্ত্র। একটা সময় যুক্তবঙ্গও পাকিস্তানে চলে যাবে। কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় নেতারা জওহরলাল নেহেরু, বল্লভভাই প্যাটেলও যুক্তবঙ্গ গঠনের প্রস্তাব অস্বীকার করে। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বুঝে যান বাংলায় হিন্দুদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে বাংলা বিভাগ জরুরী। 

১৯৪৭ সালের ২০ জুন বাংলা ভাগ নিয়ে আইনসভায় ভোট হয় যাতে পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনপ্রতিনিধিরা বাংলা ভাগের বিপক্ষে ভোট দেয়। আইনসভায় বাংলা ভাগের বিপক্ষে ১০৬টি ও বাংলা ভাগের পক্ষে ৩৫টি ভোট পড়েছিল। পূর্ববঙ্গের মুসলিম জনপ্রতিনিধিরা জানতো বাংলা ভাগ হলে কলকাতা আলাদা হয়ে যাবে, কলকাতা ছিল সেসময় ভারতের প্রথম পাঁচটি অর্থনৈতিক কেন্দ্রের একটি, তাই তাদের কলকাতা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে বাংলা ভাগের পক্ষে ৫৮টি ও বিপক্ষে ২১টি ভোট দেয়। যার জন্য পশ্চিমবঙ্গ ভারতের রাজ্য হিসাবে পরিচিতি পায়। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিল বলেই বাংলার হিন্দুরা সেসময় পাকিস্তানে যাওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছিল। এজন্য ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে পশ্চিমবঙ্গের জনক বলা হয়।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ঐতিহাসিক সুগত বসু জানিয়েছিলেন ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিল বাংলা ও পাঞ্জাবকে ভাগ করা হবে। ১৯৪৭ সালে ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বাংলা ভাগে পূর্ন সমর্থন দিয়েছিল কংগ্রেস সহ বাংলার বুদ্ধিজীবীরা। তাই ইতিহাস অনুযায়ী আক্ষরিক অর্থে ২০ জুনই পশ্চিমবঙ্গ তৈরি হয়েছিল। সেই হিসাবে ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করা একদিক দিয়ে ঠিকই। কিন্তু ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে রাজ্যের শাসকদল বিধানসভায় ১ বৈশাখকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস বা বাংলা দিবস হিসাবে ঘোষনা করার প্রস্তাব দেয়। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী এর বিরোধীতাও করেছিল কিন্ত বিধানসভায় এই প্রস্তাবের পক্ষে ১৬৭টি ও বিপক্ষে ৬২টি ভোট পড়ে যার ফলে প্রস্তাবটি পাশ হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *