অফবিট

দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলো কেন চীনের থেকে বেশী ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ছে?

গত মে, ২০২৩ সালে যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাপুয়ানিউগিনি সফরে গিয়েছিলেন তখন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছিলেন ভারত গ্লোবাল সাউথের আদর্শ নেতা এবং ভারতবর্ষের নেতৃত্বের উপর তাদের ভরসা আছে। এই বক্তব্য প্রমান করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব কতটা বাড়ছে। পাপুয়ানিউগিনির এই বক্তব্যে বোঝা যাচ্ছে উন্নয়নশীল গ্লোবাল সাউথ দেশ গুলোর মধ্যে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারতকেই আদর্শ নেতা হিসাবে বিশ্বাস করছে।

গ্লোবাল সাউথ এবং গ্লোবাল নর্থ দেশ বলতে ভৌগোলিক ভাবে পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিন প্রান্তের দেশগুলোকে বোঝায়না, ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড এন্ড ডেভেলপমেন্ট বা ইউএনসিটিএডির দ্বারা নির্দেশিত এশিয়া, আফ্রিকা, ওশিয়ানিয়া, লাটিন আমেরিকা, ক্যারাবিয়ানস দেশগুলোকে গ্লোবাল সাউথ দেশ বলা হয়। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে গোবাল সাউথ বা দক্ষিন বিশ্বের এবং গ্লোবাল নর্থ বা উত্তর বিশ্বের দেশ ভাগ করা হয়েছে। জনঘনত্ব, কম রোজগার, দুর্বল পরিকাঠামো দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলোর বৈশিষ্ট্য। তবে এশিয়ার মধ্যে জাপান, দক্ষিন কোরিয়া ও ইসরায়েল এবং ওশিয়ানিয়ার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে উত্তর বিশ্বের দেশ বলা হয়। এছাড়া উত্তর আমেরিকা, ইউরোপের দেশগুলোকে উত্তর বিশ্বের দেশ বলা হয়। অর্থাৎ উন্নত দেশগুলোকে উত্তর বিশ্বের এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দক্ষিন বিশ্বের দেশ বলা হয়। 

১৯৮০ সালে দেশগুলোর মধ্যে এই ভাগ করা হয়। ডব্লিউটিও বা ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলো অনেক সুবিধা পায়। যেমন দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলো বানিজ্যক ক্ষেত্রে কর ছাড় পায় এবং ঋন পরিশোধের ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত সময় পায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে উত্তর বিশ্বের দেশগুলোকেই দায়ী করা হয় যার কারনে উত্তর বিশ্বের দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে এবং অপ্রচলিত শক্তি উৎসের প্রযুক্তি দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলোকে দেয়। যেকোনও দেশ পার ক্যাপিটা জিডিপির বিচারে নিজেকে উত্তর বিশ্বের দেশ হিসাবে ঘোষনা করতে পারে। কোনও দেশের মোট জিডিপিকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে জনপ্রতি রোজগারকে পার ক্যাপিটা জিডিপি বলা হয়। এখানে মজার ব্যাপার হল চীন নিজেকে দক্ষিন বিশ্বের দেশ হিসাবে দাবী করে। 

চীনের জিডিপি ভারতের তুলনায় অনেক বেশী, চীন আর্থিক ভাবেও ভারতের থেকে অনেক শক্তিশালী। ২০২১ সালে চীনের পার ক্যাপিটা জিডিপি ছিল ১২,৫৫৬ আমেরিকান ডলার, সেখানে ২০২১ সালে ভারতের পার ক্যাপিটা জিডিপি ছিল ২,২৫৭ আমেরিকান ডলার। এই হিসাবে চীন উত্তর বিশ্বের দেশ হওয়ার কথা, উন্নত দেশগুলোও দাবী করে চীনের উত্তর বিশ্বের দেশ, কিন্ত চীন জানিয়েছে তাদের গ্রামাঞ্চলে এখনও দারিদ্র্যতা রয়েছে। আসলে চীন নিজেকে দক্ষিন বিশ্বের দেশ হিসাবে ঘোষনা করেছে যাতে বানিজ্যিক সুবিধা নেওয়া যায়। শুধু অর্থনৈতিক কারনই নয় রাজনৈতিক কারনও কোনও দেশ উত্তর বিশ্বের কি দক্ষিন বিশ্বের তা ঠিক করে। যেমন মধ্য প্রাচ্যের দেশ কাতার ও কুয়েতের পার ক্যাপিটা জিডিপি অনেক বেশী কিন্ত তা সত্বেও দেশ দুটিকে দক্ষিন বিশ্বের বলা হয় কারন এই দেশ দুটিতে গনতান্ত্রিক ব্যবস্থা নেই রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। দক্ষিন এশিয়ায় চীনের প্রভাব ক্রমশ বাড়ছে। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী হওয়ার কারনে চীন আমেরিকার মতো নিজেকে সুপার পাওয়ার দাবি করে। বিশ্ব রাজনীতিতে নিজের প্রভাব বাড়ানোর জন্য চীন মধ্যপ্রাচ্যেও তার উপস্থিতি বাড়িয়েছে। মধ্য প্রাচ্য বিগত কয়েক দশক ধরেই ভূ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এখানে বিগত সত্তর বছরে একাধিক রাজনৈতিক সমস্যা এবং সংঘর্ষ হয়েছে যেমন সৌদি আরব ইরানের বিতর্ক, সৌদি আরব ইয়ামেনের যুদ্ধ, ইরান ইরাক যুদ্ধ, ইসরায়েল আরব যুদ্ধ, গল্ফ যুদ্ধ,  ইরাক যুদ্ধ, হামাস, হিজবুল্লাহ, আইএসআইএস এর মতোন সন্ত্রাসী সংগঠনের উদ্ভব। 

চীন বর্তমানে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বিতর্ক সমাধানের চেষ্টা করছে যা বিগত কয়েক দশক ধরেও আমেরিকা পারেনি। এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে চীন তাদের উপস্থিতি বোঝাচ্ছে। চীনের একটি উচ্চাকাঙ্খী প্রজেক্ট হচ্ছে বিআরআই বা বর্ডার রোড ইনিশিয়েটিভ। এই প্রজেক্টে চীন এশিয়া, আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিকাঠামো যেমন বিমানবন্দর, বন্দর সহ একাধিক নির্মানের জন্য প্রচুর অর্থ ঋন দেয়। কিন্ত বেশীরভাগ পরিকাঠামোতেই তেমন লাভ না হওয়ায় ছোট দেশগুলো অর্থ পরিশোধ করতে পারেনা তখন চীন ওইসব দেশগুলোর পরিকাঠামো লিজ নিয়ে নেয়। চীনের এই নীতিকে ডেব্ট ট্রাপ বা লোনের ফাঁদ বলা হয়। শ্রীলঙ্কা, কেনিয়া সহ একাধিক দেশ এর স্বীকার। শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরই ৯৯ বছরের জন্য চীনের অধীনে চলে গেছে। খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এর স্বীকার হতে চলেছে। বিশেষ করে সিপেক প্রজেক্ট সহ একাধিক প্রজেক্টে চীনের বিপুল লোনের জালে আটকে পড়েছে পাকিস্তান। ছোট উন্নয়নশীল দেশগুলো যখন চীনের এই নীতি বুঝতে পারলো তখন থেকে চীনকে এড়িয়ে চলা শুরু করেছে উন্নয়নশীল দেশগুলো অর্থাৎ দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলো। চীনের প্রত্যেক প্রতিবেশীর সাথেই সীমানা নিয়ে বিতর্ক আছে ভারত, মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, জাপান সহ পুরো আসিয়ান দেশগুলোর সাথেই চীনের সীমানা বিবাদ আছে। বিশেষ করে আসিয়ান দেশগুলোর জলসীমা দক্ষিন চীন সাগরে চীন একতরফা ভাবে নিজের সামরিক বেস তৈরি করছে। এই আসিয়ান দেশগুলো সবই দক্ষিন বিশ্বের দেশ। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলো চীনের থেকে ভারতকে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে। উন্নত দেশগুলোর জি ৭ সম্মলনে ভারতকে আমন্ত্রন জানানো হয়, এখানে চীনকে ডাকাও হয়না অর্থাৎ ভারত উত্তর বিশ্ব এবং দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে একটি সেতু হিসাবে কাজ করছে। 

এবছর জি ২০ সম্মেলনের সময় গত ১২- ১৩ জানুয়ারি ভারত ভার্চুয়াল ভাবে ভয়েস অফ গ্লোবাল সাউথ সম্মেলনের আয়োজন করে। এই সম্মলনে দক্ষিন বিশ্বের ১২০ টি দেশকে আমন্ত্রন জানানো হয়েছিল। সাধারনত আন্তর্জাতিক সংস্থা গুলোতে যেকোনও নীতি নির্ধারন করে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো। কিন্ত এই সম্মেলনে দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলোর তরফ থেকে তাদের সমস্যা উন্নত দেশগুলোর সাথে আলোচনা করে ভারত। 

ভারতের কুটনৈতিক দক্ষতার কারনেও ভারতের উপর ক্রমশ আস্থা বাড়ছে দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলোর। সাধারনত দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলোর উপর বিশ্বের উন্নত, শক্তিধর দেশগুলোর একটা চাপ থাকে কিন্তু ভারতের বিদেশনীতি বরাবরই ভারত নিজেই ঠিক করে। যেমন ইউরোপের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সমস্যা রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। যেখানে আমেরিকা, ব্রিটেন সহ পশ্চিমা দেশগুলো ভারতকে চাপ দিচ্ছিল রাশিয়ার সাথে বানিজ্য বন্ধ করতে সেখানে ভারত সরাসরি রাশিয়া থেকে তেল কিনছে কারন রাশিয়া ভারতকে কম দামে তেল বিক্রি করছে যা ভারতের অর্থনীতির জন্য লাভজনক। চীন যেমন ছোট দেশগুলোকে লোনের ফাঁদে ফেলে ভারত কিন্তু সেক্ষেত্রে অন্য নীতি গ্রহন করেছে। ভারত দক্ষিন বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট কিছু প্রজেক্টে বিনিয়োগ করছে। এর পাশাপাশি জরুরী প্রয়োজনে ভারত দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলোকে সাহায্যও করে। যেমন শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ভারত শ্রীলঙ্কাকে ৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার সাহায্য করেছে এবং খাদ্য, জ্বালানি পাঠিয়েছে। কিন্তু চীন শ্রীলঙ্কাকে সাহায্যের বদলে আরও ঋন দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। এছাড়া ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাবও দিয়েছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঁচটি স্থায়ী সদস্য দেশ রয়েছে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স। এখানে দক্ষিন বিশ্বের কোনও প্রতিনিধি নেই। ভারত, দক্ষিন আফ্রিকা, ব্রাজিলের মতোন দেশের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের জন্য আলোচনা চলছে জাতিসংঘে। ভারতের বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শংকরও জানিয়েছে ভারতেরই দায়িত্ব দক্ষিন বিশ্বের দেশগুলোর কন্ঠস্বর হওয়ার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *