গুজরাটের এক সাধারন পরিবারের ছেলে থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এক অসাধারন যাত্রার নাম নরেন্দ্র মোদী
বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতাদের তালিকায় সবার প্রথমে রয়েছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মাননীয় নরেন্দ্র মোদীর নাম। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিশাল বিজয়ের পর ভারতের চোদ্দতম প্রধানমন্ত্রী হন শ্রী নরেন্দ্র মোদী। বলা হয় জওহরলাল নেহেরু ও ইন্দিরা গান্ধীর পর যদি ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রীকেও হয়ে থাকে তবে তিনি নরেন্দ্র মোদীই। প্রধানমন্ত্রী মোদীর রাজনৈতিক জীবন যতটা বিখ্যাত ততটাই মহান তার ব্যক্তিত্বও যার জন্য আজ বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় রাষ্ট্রনেতা তিনি। প্রধানমন্ত্রী মোদী এমনই একজন মানুষ যে অনেক সময় অতি কট্টর বিরোধীও তার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়। তবে গুজরাটের এক অতি সাধারন পরিবারের ছেলে থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার এই যাত্রা কিন্ত মোটেও সহজ ছিলনা। একজন সাধারন চাওয়ালা থেকে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার এই যাত্রার বাঁকে বাঁকে রয়েছে অসাধারন সব অভিজ্ঞতা।
১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর গুজরাটের মেহসানা গ্রামের ভাডনগর গ্রামে এক গরীব পরিবারে জন্মগ্রহন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ওনার মায়ের নাম হীরাবেন মোদী এবং বাবা দামোদরদাস মূলচন্দ মোদী। তিনি তার ছয় ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। দামোদরদাস মোদীর স্থানীয় রেলস্টেশনে একটি ছোট চায়ের দোকান ছিল। ছোটবেলা থেকেই মোদীজি তার বাবাকে চায়ের দোকানে সহয়তা করতেন এবং ট্রেনে উঠে চা বিক্রি করতেন। নিত্য বহু যাত্রীদের সাথে কথা বলার কারনে মোদীজি হিন্দি ভাষাকে রপ্ত করে ফেলেন। ভাডনগর থেকেই স্কুলের পড়া শেষ করেন তিনি। নরেন্দ্র মোদীজী স্বামী বিবেকানন্দকে আদর্শ মনে করেন, এই জন্য অবসর সময়ে তিনি প্রায়ই বিবেকানন্দের বই পড়তেন। এছাড়া ভারতের ইতিহাস সম্পর্কেও ব্যাপক কৌতূহল ছিল ওনার। এই জন্য তিনি প্রায়ই লাইব্রেরী গিয়ে কয়েক বছরের পুরোনো খবরের কাগজ এনে পড়তেন। আট বছর বয়সে মোদীজি হিন্দি শিক্ষক চন্দ্রকান্ত দেবের কারনে রাষ্ট্রীয় স্বয়মসেবক সংঘ বা আরএসএসে যোগদান করেন।
১৯৬২ সালের ভারত চীন যুদ্ধের পর তিনি সেনাবাহিনীতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু অর্থের অভাবের কারনে তিনি সেনা স্কুলে যেতে পারেননি বরং এনসিসিতে ভর্তি হন। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ওনার ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতি এতটাই ভালোবাসা জন্মে যায় যে তিনি ভাডনগর রেলস্টেশনে ট্রেনে ভারতীয় সেনাদের চা ও খাবার সরবরাহ করতেন। অর্থাৎ খুব ছোটবেলা থেকেই ওনার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। এইসময়ে মোদীজির সাথে যশোদাবেন চিমনলালের বিবাহ দেন তার পরিবার। কিন্ত নরেন্দ্র মোদীজি দেশের জন্য কিছু করবার তাগিদে এবং ঘর থেকে বাইরে বেড়িয়ে জীবনের সঠিক অর্থ খোঁজার জন্য ১৯৬৭ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে পারিবারিক জীবন ত্যাগ করেন। পরবর্তীকালে তিনি নিজের নাম রাখেন অনিকেত যার অর্থ যে ব্যক্তির কোনও ঘর নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়েই তিনি স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে রামকৃষ্ণ মঠ যান দীক্ষার জন্য। কিন্তু সেসময় তিনি স্নাতক না হওয়ায় এবং বয়স কম থাকায় রামকৃষ্ণ মঠ থেকে তিনি দীক্ষা পাননি। এরপর তিনি উত্তর ভারত, উত্তরপূর্ব ভারত হয়ে দুইবছর পর ১৯৬৯ সালে আবারও ভাডনগরে ফিরে আসেন। কিন্ত কিছু দিন পরেই তিনি আবারও ঘর থেকে বেড়িয়ে পড়েন এবং আমেদাবাদ যান। আমেদাবাদে তার কাকার চায়ের দোকানে কাজ শুরু করেন, এইসময়ে আরএসএসের কার্যালয়েও যাতায়াত করা শুরু করেন তিনি। সেসময় লক্ষনরাও ইনামদারের নজর পড়ে নরেন্দ্র মোদীর উপর যা তার রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। লক্ষ্মনরাও ইনামদারকে আরএসএসে উকিল সাহেব নামে ডাকা হত। উকিল সাহেব নরেন্দ্র মোদীকে দেখে এবং তার ইচ্ছাশক্তি, দেশভক্তির প্রমান পেয়ে যথেষ্ট প্রভাবিত হন। উকিল সাহেব গুজরাটে আরএসএসের প্রধান কার্যালয়ে নরেন্দ্র মোদীজির থাকার যাবতীয় ব্যবস্থা করে দেন।
১৯৭১ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে আরএসএসের সক্রিয় সদস্য হন তিনি। ১৯৭১ সাল থেকেই পুরো গুজরাট জুড়ে আরএসএসের প্রচার শুরুর করেন তিনি এবং সাধারন মানুষের সেবা করতে থাকেন। মোদীজি পারিবারিক জীবন ত্যাগ করায় পড়াশোনা মাঝ পথেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্ত উকিল সাহেব ওনাকে পুনরায় পড়া শুরু করবার কথা বলেন। মোদীজির যুবক অবস্থার বেশীর ভাগ সময় উকিল সাহেবের সাথেই কেটেছে, ওনার রাজনৈতিক জীবনে উকিল সাহেবের সবচেয়ে বড় অবদান রয়েছে। ১৯৭৫ সালে দেশে চলা জরুরী অবস্থার সময় আরএসএসের মতোন সংগঠনকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্ত এরকম সময়েও মোদীজি আরএসএসের হয়ে কাজ বন্ধ করেননি যার জন্য আরএসএসে তার সম্মান আরও বেড়ে যায়। জরুরী অবস্থার সময়ে তিনি গ্রেপ্তার এড়াতে প্রায়ই ছদ্মবেশে গুজরাটের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমন করেছিলেন, কখনও সন্ন্যাসী বা কখনও শিখের ছদ্মবেশে।
১৯৭৮ সালে মোদীজিকে আরএসএসের আঞ্চলিক সংগঠকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিছুদিন সুরাট ও ভদোদরাতে কাজ করার পর ১৯৭৯ সালে মোদীজিকে আরএসএসের দিল্লি শাখায় পাঠানো হয়। কিছু সময় পর তিনি আবারও গুজরাট ফিরে আসেন। এইসময় মোদীজি একটি বই লেখেন সংঘর্ষ মা গুজরাট, এই বইয়ে তিনি জরুরী অবস্থার সময় গুজরাটের পরিস্থিতি সম্পর্কে বর্ননা করেছেন। ১৯৮৩ সালে গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম বিভাগে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন নরেন্দ্র মোদী। মোদীজির কোঠোর পরিশ্রম ও দেশের প্রতি নিষ্ঠাভাব দেখে আরএসএস ১৯৮৫ সালে মোদীজিকে বিজেপিতে পাঠায়।
১৯৮৬ সালে আহমেদাবাদে পৌরসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে জয় লাভ করে বিজেপি। যার জন্য অটলবিহারি বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আডবানির মতো বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সুনজরে আসেন তিনি। ১৯৯০ সালে বিজেপির রাম রথযাত্রা এবং ১৯৯১ সালে একতা যাত্রাতে অংশ নেন তিনি। ১৯৯৫ সালে গুজরাটের বিধানসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীজীর অসাধারন নীতির কারনেই বিজেপি জয়লভা করে। এই জন্য ১৯৯৮ সালে বিজেপির সাধারন সম্পাদক নিযুক্ত করা হয় মোদীজিকে। মোদীজির রাজনৈতিক জীবনে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০০১ সালে, এই বছর তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন। ২০০১ সালে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাই প্যাটেলের পরিবর্তে তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন। কেশুভাই প্যাটেলে শারীরিক অসুস্থতার কারনে গুজরাটে মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি হিসাবে নরেন্দ্র মোদীকেই বেছে নেয় বিজেপি। কিন্তু এইসময় গুজরাটে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গোধরা দাঙ্গা। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি বারবার নরেন্দ্র মোদীজির বিরুদ্ধে অভিযান করে এসেছে কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তদন্তের পর নরেন্দ্র মোদীর তৎকালীন গুজরাট সরকারকে এই বিষয়ে নির্দোষ ঘোষনা করে। নরেন্দ্র মোদীজি পরপর তিনবার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হন, এই সময়কালে গুজরাটে অর্থনীতি, কৃষিকাজ ও প্রযুক্তিগত ব্যাপক উন্নয়ন হয়। নরেন্দ্র মোদীজির যোগ্য নেতৃত্বে গুজরাট ভারতের প্রথম সারির রাজ্যে পরিনত হয়। গুজরাট গোটা ভারতের বাকী রাজ্যগুলোর জন্য একটি রোলমডেল হিসাবে গড়ে ওঠে।
মোদীজির নেতৃত্বে ২০০১-২০১০ সাল পর্যন্ত গুজরাটে বৃদ্ধির হার ছিল ১০.৯ শতাংশ যা সেসময় ভারতের সমস্ত রাজ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ছিল। এইসময় গুজরাটে মোদীজি দূর্নীতি কম করতে একাধিক পদক্ষেপের নেন, যার জন্য খুব অল্প সময়েই গুজরাট দেশের অন্যতম প্রধান বিনিয়োগ কেন্দ্রে পরিনত হয়। গুজরাটের অভূতপূর্ব উন্নয়নের জন্য নরেন্দ্র মোদীর নাম গোটা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। যার জন্য সমগ্র ভারতবর্ষে বিজেপির একজন শক্তিশালী ও জনপ্রিয় নেতা হিসাবে ওনার উত্থান হয়।
বিজেপি ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীকে সামনে রেখে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী প্রথমবারের জন্য বারানসি কেন্দ্র থেকে লোকসভা নির্বাচনে অংশ নেন। এই নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে বিজেপি। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ন ছিল কারন ১৯৮০ এর দশকের পর থেকে ভারতীয় রাজনীতিতে কোনও রাজনৈতিক দলই একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায়নি কিন্তু ২০১৪ সাধারন নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠ দল হিসাবে বিজেপির উত্থান হয় এবং ভারতের চোদ্দতম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহনকরেন নরেন্দ্র মোদী। কংগ্রেসের দীর্ঘকাল পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতিকে দূরে সরিয়ে ভাডনগরের এক সাধারন পরিবারের ছেলের দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার এই যাত্রা প্রমান করে ভারতকে কেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় গনতান্ত্রিক দেশ বলা হয়।
নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে নিজের পরিবারকে সর্বদা রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছেন। ২০১৪ সাল কিংবা ২০১৯ সাল কখনওই ওনার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ গ্রহনকালে ওনার পরিবারের কোনও ব্যক্তি আসেননি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেন সম্পূর্ন দেশই তার পরিবার, তার কোনও উত্তরাধিকার নেই, দেশের প্রতিটি পরিবারই তার উত্তরাধিকার। দেশের মানুষের সাথে অটুট সম্পর্কই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তার বড় কারন। যার জন্য ২০১৪ সালের পর ২০১৯ সাল এবং বর্তমানে ২০২৪ সালেও বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করবে বলে রাজনৈতিক মহলের ধারনা।