অফবিট

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাই দুর্ভোগ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনে প্রচুর সম্মান তথা খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। তাঁকে তাঁর জামাতাদের নিয়ে নানান বিড়ম্বনা এবং দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছিল। যদি অতি সংক্ষেপে বলতে হয় তাহলে বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাই ভাগ্য খুবই একটা তাঁর জন্য সুখকর ছিল না।     

১. বড় মেয়ে মাধুরীলতার স্বামী শরৎকুমার চক্রবর্তী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে মাধুরীলতার স্বামী ছিল শরৎকুমার চক্রবর্তী। মাধুরীলতা এবং  শরৎকুমারের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ছিল ১৬ বছর অর্থাৎ যখন মাধুরীলতা সাথে তার বিবাহ হয় তখন তার বয়স ছিল ৩১ বছর এবং তিনি তার শ্বশুরমশাইয়ের থেকে নয় বছরের ছোট আর তার শাশুড়ি মৃণালিনী দেবীর থেকে চার বছরের বড় ছিলেন। এই বিয়েতে পণ হিসাবে ২০ হাজার টাকা দাবি করা হয়েছিল তবে শেষ পর্যন্ত ১০ হাজার টাকায় মিটে ছিল বিষয়টি। কিন্তু শর্ত ছিল যে এই টাকা  বিয়ের অন্তত তিন দিন আগে দিয়ে দিতে হবে। কুলশীল দিক হোক বা  সুদর্শনের দিক কোন দিক থেকেই পাত্র পাত্রীর সমকক্ষ ছিল না।     

রবীন্দ্রনাথ তাঁর মেয়ে বিয়ের পর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তার জামাতা শরৎকে বিলাতে পাঠিয়েছিলেন এবং প্রতিমাসে খরচ ১০ পাউন্ড তাঁকে দিতে হত যা সেই সময়কার দিনে ১৫০ টাকা ছিল। শরৎকুমার বিলাত থেকে ফিরে তার স্ত্রীসহ তিনি উঠেছিলেন তার শ্বশুরবাড়ি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। সেখানে চার বছর থাকার পর হঠাৎ তার সাথে বিবাদ সৃষ্টি হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথের সাথে। যার কারনে এই ঠাকুরবাড়ি ত্যাগ করে শরৎকুমার তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন শ্রীরামপুরের তার পৈতৃক নিবাসে। এরপরই শরৎকুমার চক্রবর্তী তার শ্বশুর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টেনেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ তার মেয়ে ও জামাই এর সাথে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করার জন্য বিদেশ থেকে চিঠি লিখেছিলেন তাদের কাছে। কিন্তু কবির চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। মেয়ে এবং জামাই এর মনোভাব বুঝতে পেরে কবি তার জামাইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে লন্ডন থেকে চিঠি লিখেছিলেন, ‘কিছুদিন থেকে অনুভব করতে পারছি যে তোমরা কোনও কারণে আমার উপর রাগ করেছ এবং এই ব্যাপারে মনের মধ্যে খুব কষ্টও বোধ করেছি। এর ভিতরকার কারণটা কি তা আমি ভেবে স্থির করতে পারি নি, কেননা আমি ইচ্ছে করে তোমাদের প্রতি অন্যায় ব্যবহার করি নি। যদি তোমরা মনে করো থাকো যে, তোমাদের প্রতি আমার আন্তরিক স্নেহের অভাব আছে তাহলে তোমরা ভুল বুঝেছ-এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারি নে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর তাঁকে অভিনন্দন জানানোর জন্য বহু মানুষ  কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন কিন্তু  তাঁকে মেয়ে এবং জামাই যান নি। ১৯১৭ সালে ধরা পড়েছিল যে মাধুরীলতা যক্ষ্মা রোগে  আক্রান্ত। মেয়ের চিকিৎসার ভার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই  নিয়েছিলেন।  তিনি নিয়মিত মেয়েকে দেখতে যেতেন কিন্তু শ্বশুরের তার বাড়িতে আসা একদমই পছন্দ ছিল না শরৎকুমার চক্রবর্তীর। জামাই এর অপছন্দ থাকা সত্ত্বেও তিনি তার মেয়েকে দেখতে জামাই এর বাড়িতে যেতেন। মেয়ের কাছে গিয়ে বসে থাকতেন। সেই সময় শরৎকুমার টেবিলের ওপর পা তুলে সিগারেট খেয়ে অপমানকর মন্তব্য করতেন তার শ্বশুর রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু সেইসব অপমান নীরবে সহ্য করে দিনের পর দিন রবীন্দ্রনাথ তার মেয়েকে দেখতে যেতেন।   

ঠিক ওই দিনও রবীন্দ্রনাথ তার মেয়ে মাধুরীলতা দেখতে গিয়েছিলেন কিন্তু মেয়ের মুখ না দেখেই ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর বাড়িতে। কারন মাঝপথে তিনি শুনলেন যে মাধুরীলতা যক্ষ্মারোগে মারা গেছে যার কারনে তিনি আর ওপরে উঠলেন না। তার পুত্র রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন যে বাড়িতে এসে তার মুখে কোনো শোকের ছায়া নেই। কাউকে বুঝতে দিলেন না, কী অসহ্য বেদনার মধ্য দিয়ে তিনি সন্তানকে হারিয়েছেন …. 
২. দ্বিতীয় জামাতা সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য
এক দরিদ্র পরিবারের ছেলে ছিলেন কবির মেজো জামাতা দরিদ্র পরিবারের ছেলে। ডাক্তারি পাস করার পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য তাঁর আমেরিকায় যাওয়ার বাসনা ছিল। যেহেতু আমেরিকায় যাওয়া এবং থাকার ব্যয় নির্বাহ করা হবে সেই কারনে রেণুকার সাথে তাঁর বিয়েতে কোনো যৌতুক তাঁকে দেওয়া হয়নি। তবে রেণুকার পিতামহ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর চারটি গিনি সোনা যৌতুক হিসেবে দিয়েছিলেন এবং ৫০০ টাকা খরচ হয়েছিল এই বিবাহে। শুধু সত্যেন্দ্রনাথেরই নয় তাঁর  মাকে  ৫০ টাকা করে মাসোহারা দেওয়া হত। সেই সময়  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাশুড়ি দাক্ষায়ণী দেবীর ২০ টাকা মাসোহারা ছিল। উচ্চশিক্ষা লাভ করতে বিদেশে গেলেও মাঝপথে সেই পড়াশোনা ছেড়ে  দেশে ফিরে এসেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। সত্যেন্দ্রনাথের অকৃতকার্যতা নিয়ে নানান কথা ঠাকুরবাড়ির মেয়েমহলে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু কবি এই নিয়ে কোন কথাই বলেননি। তবে স্বামীর ব্যর্থতার কারনে মন ভেঙে গিয়েছিল রেণুকার। 

বিদেশে থাকাকালীন সময়ে সত্যেন্দ্রনাথকে নানা অঙ্কের অর্থ পাঠাতে হয়েছিল। এমনকি দেশে ফেরার পরই  ১৫০ টাকা তাঁর মাসোহারা ঠিক করা হয়েছিল এবং ২০০০ টাকা ব্যয় করে তাঁকে ডাক্তারির ডিসপেনসারি সাজিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রেও সফলতার মুখ দেখতে পান নি সত্যেন্দ্রনাথ।  

এরপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৩ সালে শান্তিনিকেতনে অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করেছিলেন তাঁর জামাতা সত্যেন্দ্রনাথকে। যার জন্য তাঁকে যথেষ্ট মূল্য দিতে হয়েছিল। কিন্তু এক্ষেতেও সে অকৃতকার্যতা হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল। আসলে তিনি কোনো কাজই মন দিয়ে করতে পারতেন না মাঝপথে ছেড়ে দিতেন সেই কাজ, আর এটায় ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি। সত্যেন্দ্রনাথ অধ্যক্ষ নিযুক্ত হওয়ার এক মাসের মধ্যে পদত্যাগ করে শান্তিনিকেতন ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন কবির অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মী মনোরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদায় নেওয়া কারন হিসাবে জানিয়েছিলেন ‘স্বাস্থ্যগত’ কারন কিন্তু এর পিছনে আসল কারণ ছিল জামাতার দুর্ব্যবহার। কবির জামাতা  কাউকে কিছু না জানিয়ে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের দায়িত্ব ত্যাগ করে পাঞ্জাবে বেড়াতে চলে যান। সেই সময় তাঁর স্ত্রী রেণুকা অসুস্থ। এরপর রেণুকার মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ পুনরায় তাঁর জামাতাকে শান্তিনিকেতনে শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। এমনকি তার দ্বিতীয়বার বিবাহের বন্দোবস্তও করেছিলেন।

৩. ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ
বরিশালের ছেলে ছিলেন নগেন্দ্রনাথ। উচ্চশিক্ষার লাভের জন্য তাঁর ইংল্যান্ড যাওয়ার বাসনা ছিল। তাঁর এই বাসনা পূর্ণ করার জন্য তিনি ধনবানদের কাছে অর্থসাহায্য চাচ্ছিলেন।এই জন্য নগেন্দ্র  রবীন্দ্রনাথের কাছে গিয়েছিলেন তখন তাঁকে দেখে কবির ভালো লেগে যায়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পছন্দ করতেন না বিদেশে যেতে ইচ্ছুক পাত্রদের। নগেন্দ্রনাথের সাথে তাঁর ছোট কন্যা মীরার বিবাহ দেওয়ার দু’বছর আগে কবি মোহিতচন্দ্র সেনকে একটি পত্রে লিখেছিলেন, ‘কোনও পাত্রকে আমি বিলেত পাঠাতে চাইওনে,পারবোও না।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এমনই ভোগ্য ছিল যে তাঁর   তিন জামাতাকেই বিলেতে পাঠাতে হয়েছিল। 

১৯০৭ সালের ৫ জুন শান্তিনিকেতনে নগেন্দ্রনাথ এবং মীরার বিবাহ হয়। বিবাহের সময় নগেন্দ্রনাথের বয়স ছিল ১৭ বছর ৭ মাস এবং মীরার বয়স ছিল  ১৩ বছর ৬ মাস। সেই সময়ে নগেন্দ্রনাথ এবং মীরার বিয়েতে ২৯২৩ টাকা ৮ আনা ৬ পাই খরচ হয়েছিল। ১১ জুন রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যা এবং জামাতাকে নিয়ে যান বরিশালে। রবীন্দ্রনাথ তার ভাগ্নে সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৭২১ টাকা ৫ আনা ধার করে তাঁর জামাতা নগেন্দ্রনাথের জাহাজের টিকিট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনেছিলেন। আমেরিকা থেকে নগেন্দ্র কৃষিবিদ্যায় শিক্ষালাভ করে আসার পর কবি তাঁকে কৃষি গবেষণায় সাহায্য করতে শিলাইদহে পাঠিয়ে ছিলেন। সেই সাথে জমিদারি ও পতিসরে কৃষি ব্যাংকের কিছু কিছু দায়িত্ব দিয়েছিলেন। এই কাজের জন্য ১৫০ টাকা মাসোহারার  ছিল। তবে অপরিমিত ব্যয়ের কারণে তাঁর ছোট জামাই ঋণ করতে থাকেন। এমনকি তিনি ঋণ করে বরিশালে একটি বাড়িও কিনেছিলেন।   

১৯১২ সালে নগেন্দ্রনাথের ওপর সংসার ও জমিদারির আর্থিক দায়িত্ব অর্পণ করে রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে গিয়েছিলেন। কবিকে আদি ব্রাহ্মসমাজের ট্রাস্টিগণ সমাজের সম্পাদক পদে নিয়োগ করেন। তবে তিনি এই সমাজের সদস্য ছিলেন না। তাঁর  জামাতার এই সমাজের বিশ্বাস এবং নিয়মাবলির ওপর আস্থাও ছিল না। ওই সময় তাঁর  জামাতার হঠকারী কার্যকলাপ, ক্ষমতাপ্রিয়তা এবং অহমিকা প্রকট হয়ে ওঠে। যার ফলে তাঁর সাথে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের প্রধান কর্মসহায়ক অজিতকুমার চক্রবর্তীর সাথে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছিলেন এবং  প্রচুর পরিমানে আর্থিক অনিয়মও করেছিলেন। আর এইসমস্ত  টাকার সুদ দেননি, এমনই আসল টাকাও শোধ করেননি। অবশেষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এই টাকা শোধের ভার নিতে হয়েছিল। 

তথ্য নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। বেশ কিছু রিসার্চ কপির উপর নির্ভর করে লেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *