অফবিট

ইসরায়েলকে মধ্য প্রাচ্যের সিংহ কেন বলা হয়?

রাজেশ রায় : আজ আমরা আলোচনা করব বিশ্বের ইতিহাসে এমন এক দেশ সম্পর্কে যারা অসাধারণ বুদ্ধি ও বীরত্বের মাধ্যমে বিশ্বের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। ভারতের ছোট্ট একটি রাজ্যের আয়তনের সমান এই দেশটি মাত্র ছয় দিনে তার সমস্ত শত্রুদের পরাজিত করেছিল। ইতিহাসের বিখ্যাত এই যুদ্ধ “সিক্স ডে ওয়ার” বা ছয়দিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত। এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতেই পেরেছেন কোন দেশের সম্পর্কে বলা হচ্ছে,  হ্যাঁ ঠিকই অনুমান করেছেন দেশটির নাম ইসরায়েল, যাকে দি লায়ন অফ মিডলইস্ট বা মধ্য প্রাচ্যের সিংহ বলা হয়। তুলনামূলক কম  সংখ্যাক সেনা, যুদ্ধবিমান, অস্ত্র নিয়ে ইসরায়েল মাত্র ছয় দিনে তার প্রতিপক্ষ চারটি দেশকে লজ্জাজনক ভাবে হারিয়েছিল। ইসরায়েল কিভাবে এই অসম্ভব কে সম্ভব করল? কী ছিল ইসরায়েলের পরিকল্পনা? 

সময়টা ১৯৫৬ সালের দিকে, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হচ্ছে। যদি মানচিত্রে মধ্যেপ্রাচ্যের অবস্থান দেখেন দেখবেন একপাশে বিশাল আয়তনের মিশর, সৌদি আরব, অন্যদিকে সিরিয়া, ইরাক, জর্ডন। এদের মাঝখানে ছোট্ট একটি দেশ ইসরায়েল। মাত্র ৯৪ লাখ জনসংখ্যার ছোট্ট এই দেশ কীভাবে আশেপাশের বড় বড় দেশ গুলোকে হারাল সেটা সত্যিই বিস্ময়কর! ছয়দিনের যুদ্ধ কিন্তু হঠাৎ করেই হয় নি এর পেছনে অনেক বড় গল্প ছিল। 

ইসরায়েল হচ্ছে ইহুদী ধর্মালম্বীদের দেশ। ইসরায়েলের জন্মের বহু আগে থেকেই ইহুদিরা জেরুজালেমে শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকত। কিন্তু খ্রীষ্টান ধর্মের আবির্ভাবের পর থেকে ইহুদিদের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। বিশেষ করে যখন ইউরোপে রোমান সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল সেইসময় ইউরোপের সরকারি ধর্ম হয়ে যায় খ্রিষ্টান ধর্ম। তখন ইউরোপের বিভিন্ন শহরে ইহুদিদের রীতিমতো হত্যা করা হত। যখন ইসলাম ধর্মের উত্থান হয় তখন ইহুদিদের অবস্থা ভাল হতে শুরু করে কারন তখন খ্রীষ্টানদের প্রধান প্রতিপক্ষ হয় ইসলাম।  ইহুদিরা তখন মুসলিম ও খ্রীষ্টান উভয়ের সাথেই ব্যাবসা করত, যার ফলে ইহুদীদের সমৃদ্ধি হয়। সমস্যা কী হল ইহুদীদের এই উন্নতি অনেকের চোখে লাগতে শুরু করে। 

এগারো শতকের শুরুতে তুর্কীরা এবং খ্রীষ্টানরা উভয়েই অত্যাচার শুরু করে ইহুদীদের উপর। জেরুজালেমে থেকে ইহুদিদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়, ইহুদীদের বড় অংশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যায় এবং কীছু রাশিয়াতে চলে যায়। রাশিয়ার ইহুদীদের উপর প্রবল অত্যাচার করা হয়,স্পেন তো ইহুদীদের আশ্রয়ই দেয় নি। শেষমেশ ইহুদীরা এসে উপস্থিত হয় পোল্যান্ডে। বিশ্বের অর্ধেক ইহুদী পোল্যান্ডে থাকতে শুরু করে। এরপর আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, এইসময় ব্রিটেন জানায় তারা ইহুদীদের জন্য একটা দেশই তৈরি করে দেবে। এরপর আসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, আসল সমস্যা এখানেই শুরু হয়। ১৯৩৯ সালে হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করে, পোল্যান্ডে সেইসময় বিশ্বের অর্ধেক ইহুদী থাকত। হিটলার ইহুদীদের গনহত্যা শুরু করে, প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদী কে হত্যা করা হয়। হিটলার গ্যাসচেম্বার তৈরি করে যাতে সায়ানাইডের সাহায্যে ইহুদীদের হত্যা করা হত। ইতিহাসে এই ঘটনা হলোকাস্ট নামে পরিচিত। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর ইসরায়েল তৈরির কথা শুরু হয়, শেষ পর্যন্ত ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল তৈরি হয়, ইহুদীদের তাদের আদি বাসস্থান জেরুজালেমে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এবার হল কী আরবরা এটা সহ্য করতে না পেরে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ করে বসে ১৯৪৯ সালে যাতে আরবদের পরাজিত হতে হয়। আপনারা হয়ত ভাবছেন ছয় দিনের যুদ্ধ কথাটা আসছে না দেখুন পুরো ব্যাপারটা প্রথম থেকে জানতে হবে যার জন্য এত আলোচনা করা হচ্ছে, একটার সাথে একটা লিংক রয়েছে।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল জন্মের পর থেকে তার আশেপাশের একটু একটু অংশ নিজেদের দখলে নিতে শুরু করে, বিশেষ করে ১৯৪৮ এ ইসরায়েল প্যালেস্টাইন যুদ্ধে ইসরায়েলের জয়লাভের পর থেকে ইসরায়েল আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করে। যার ফলে আরব দেশগুলো ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই সময় আরব দেশগুলোকে নেতৃত্ব দিতে শুরু করে মিশর। মিশর ও সিরিয়া এই সময় একটি চুক্তি করে যে কোন একটি দেশ কে শত্রু দেশ আক্রমণ করলে উভয়দেশই একে অপরের সহায়তা করবে। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ ক্যানেল ক্রাইসিসের পর থেকে মিশর আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে শুরু করে। ধীরে ধীরে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একজোট হতে শুরু করে মিশর, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া, সৌদি আরব ও লেবানন। এইসময় বিশ্বের দুই সুপার পাওয়ার আমেরিকা সাপোর্ট করতে শুরু করে ইসরায়েলকে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন সাহায্য করতে শুরু করে মিশরকে। ঝামেলা চরমে ওঠে তখন যখন ইসরায়েল সিরিয়ার কিছু যুদ্ধবিমান কে ধ্বংস করে দেয়। আগুনে ঘি ঢালে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত মিশর কে বলে যে ইসরায়েল মিশর সীমান্তে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে যদি মিশর ব্যাবস্থা না করে তাহলে উত্তর সীমান্ত ইসরায়েল দখল করে নেবে। এটা পুরোপুরি ভুল তথ্য ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের দেওয়া এই ভুল তথ্য যথেষ্ট ছিল আরব- ইসরায়েল যুদ্ধের জন্য। ইসরায়েল বুঝতে পারে যুদ্ধ এবার হবেই।

এবার সেই সময়ে আরব ও ইসরায়েল এর সেনাবাহিনী ও যুদ্ধ অস্ত্রের একটা তথ্য দিই। ইসরায়েলের সেনা সংখ্যা ছিল এক লক্ষ,  যেখানে মিশর, জর্ডান, ইরাক ও সিরিয়ার মিলিত সেনাবাহিনী ছিল প্রায় আাড়াই লক্ষ, পাশাপাশি সৌদি আরবের ২০,০০০ সেনা ছিল। ইসরায়েলের যুদ্ধ বিমান ছিল ২৫০-৩০০ টা, যেখানে আরবদের ছিল ৯৫৭ টি, ইসরায়েলের ট্যাংক ছিল ৮০০, আরবদের ২,৫০৪ টি। অর্থাৎ সবদিক দিয়ে আরব দেশ গুলো অন্তত ইসরায়েলের থেকে তিনগুন শক্তিশালী ছিল। যুদ্ধ হলে আরবদেশ গুলো যে জিতবে এটা একটা বাচ্চা ছেলেও বুঝতে পারত। এখানে এবার ইসরায়েল একটা মাস্টার প্ল্যান বানাল। ইসরায়েলের মিডিয়া গোটা বিশ্বে প্রচার করে যে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর বেশীর ভাগ সদস্য এবং পাইলটরা ছুটিতে আছে। এতে আরবদেশ গুলো ভাবল ইসরায়েল বোধহয় যুদ্ধের জন্য প্রস্তত না। এই সুযোগে ইসরায়েল করল কী, ৫ জুন ইসরায়েল অপারেশন ফোকাস শুরু করে। ২০০ ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান মিশরের উপর আক্রমণ শুরু করে। মিশর কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিশরের ১৪ টি এয়ারফিল্ড ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল। মিশরের ৩৫০+ যুদ্ধবিমান ঘাটিতেই ধ্বংস হয়ে যায়, ১০০ পাইলট মারা যায়। মাত্র ৪ ঘন্টায় কোন প্রতিরোধ ছাড়াই মিশরের ৯০% বিমানবাহিনী কে পুরো ধ্বংস করে দেয় ইসরায়েল। এরপর ২০০ ইসরায়েল বিমান জর্ডন, সিরিয়া, ইরাকে আক্রমণ করে। জর্ডানের ২৮ টি যুদ্ধবিমান, সিরিয়ার ৫৩ টি ও ইরাকের ১০ টি যুদ্ধবিমান সাথে সাথে ধ্বংস করে ইসরায়েল। ইসরায়েলের নীতি ছিল শত্রুর আক্রমণের আগেই শত্রুর দেশে ঢুকে শত্রুকে মেরে দেওয়া। এবার যুদ্ধ শুরু হয় সেনাবাহিনীর, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী সংখ্যায় অনেক কম ছিল কিন্তু ইসরায়েলের বিমানবাহিনী সাহায্য করতে শুরু করে সেনাবাহিনীকে। অন্যদিকে আরব দেশগুলোর মোটামুটি অর্ধেক যুদ্ধবিমান ইসরায়েল ধ্বংস করে দেওয়ায়, তারা পড়ে বিপদে যার জন্য আকাশের পাশাপাশি জমিতেও লজ্জাজনক ভাবে হারে আরবদেশ গুলো। শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে মাত্র ৬ দিনের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হয়। ১৯৬৭ সালের ৫ ই জুন যুদ্ধ শুরু হয়, ১০ ই জুন যুদ্ধ বন্ধ হয়। ১৩২ ঘন্টার এই যুদ্ধে ২০,০০০ আরবসেনা মারা যায়, যেখানে ৮০০ ইসরাইলি সৈনিক মারা যায়। এই যুদ্ধে ইসরায়েল সিরিয়া থেকে গোলান হাইটস, জর্ডান থেকে সিনাই এবং পুরো জেরুজালেম শহর দখল করে নেয়৷ এই যুদ্ধে ইসরায়েল বুঝিয়েদেয় মধ্যপ্রাচ্যের সুপার পাওয়ার কারা।

সবশেষে একটা কথা না বললেই নয়, তাহল ইসরায়েলের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক ইসরাইলি নাগরিককে ১৮ বছর বয়সের পর অন্তত ২.৫ বছর সেনাবাহিনী তে কাজ করতেই হবে। এই জন্য ইসরায়েলের ৯৪ লাখ জনসংখ্যার প্রায় সবটাই সেনাবাহিনী। চারিপাশে শত্রু বেষ্টিত হবার কারনে ইসরায়েল বাধ্য হয়ে এটা করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *