অফবিট

রহস্যময় কৈলাশ মন্দির

আদি কাল থেকেই ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি অত্যন্ত উন্নত ছিল। যেসময় ইউরোপের মানুষ জঙ্গলে বাস করত, পশু শিকার করতো এবং আদিম জীবন যাপন করত সেসময় ভারতীয়রা নগরে বাস করত। ইংরেজরা ভারতে উপনিবেশ তৈরি করে ভারতকে আধুনিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে সভ্য করার দাবী করে। কিন্তু ইংরেজরা যখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে অনুসন্ধান করে একাধিক ঐতিহাসিক স্থাপত্যে আবিষ্কার করে এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত দুর্লভ পান্ডুলিপী তথ্য জেনে ইংরেজরা গোটা বিশ্বে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাস জেনে অবাক হয়ে যায়। মেসোপোটেমিয়া সভ্যতাকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন সভ্যাতা বলা হয় এবং ভারতের সিন্ধু সভ্যতাকে বিশ্বের চারটি পুরোনো সভ্যতার একটি বলে ধরা হয়। কিন্তু মহাভারতের বর্ননা অনুযায়ী ভারতীয় সভ্যতা এতটাই পুরোনো ও আধুনিক তা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা কারও নেই। বিজ্ঞান, চিকিৎসা, জীবনের সঠিক অর্থ সম্পর্কে যে জ্ঞান প্রাচীন ভারত বিশ্বকে জানিয়েছে তার শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। ভারতের মন্দির গুলো প্রাচীন ভারতের উন্নত স্থাপত্য শিল্পের সাক্ষী। এরকমই একটি মন্দির হচ্ছে কৈলাস মন্দীর। মহারাষ্ট্রের ঔরাঙ্গাবাদের এলোরাতে ৩৪ টি মন্দিরের মধ্যে সবচেয়ে বড় মন্দির এটিই। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মনোলিথিক পাথরের মন্দির এই কৈলাশ মন্দিরই। ৩০০ ফুট দৈর্ঘ্য, ১৭৫ ফুট প্রস্থ এবং ১০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট এই মন্দির ভারতের জটিল স্থাপত্য শিল্পের অসাধারন নিদর্শন। সাধারনত যেকোন পাথরের পুরোনো মন্দির নীচে থেকে উপর পর্যন্ত ধাপে ধাপে তৈরি করা হয় কিন্তু কৈলাশ মন্দির উপর থেকে ধাপে ধাপে নীচে পর্যন্ত অসাধারন ভাবে নির্মান করা হয়েছে, যা বিশ্বের বাকী সব পাথরের স্থাপত্যকার্য থেকে এই মন্দিরকে আলাদা করেছে। পুরোনো যুগে যেখানে বর্তমান দিনের স্থাপত্যে তৈরির মতো আধুনিক উপকরন ছিলনা সেখানে এত বিশাল পাথরের অসাধারন মন্দির কীভাবে নির্মান করা সম্ভব হল তা সত্যিই রহস্যময়।

মহারাষ্ট্রে অবস্থিত এলোরা গুহা বিখ্যাত। ইউনেস্কোর সংরক্ষনশীল জায়গার অন্তর্ভুক্ত এটি। এলোরা ৩৪ টি গুহার সমষ্টি। এলোরাতে তিন ধরনের গুহা রয়েছে বৌদ্ধ গুহা, প্রাচীন হিন্দু গুহা এবং জৈন গুহা। মহারাষ্ট্রের ছত্রপতি সম্ভাজি নগর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এলোরা গুহা। এই পুরো এলাকায় একশোর মতো গুহা রয়েছে। তবে ৩৪ টি গুহাতেই সাধারনের প্রবেশাধিকার রয়েছে। এলোরারা ১৬ নং গুহাতে অবস্থিত কৈলাশ মন্দির যা একইসাথে প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান এবং রহস্যের প্রতীক। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু মানুষ এই মন্দির দেখতে এখানে আসে। বলা হয় এই মন্দির যখন প্রথম আবিষ্কার হয় তখন এটি সাদা প্লাস্টারে ঢাকা ছিল এবং দেখতে কৈলাশ পর্বতের মতোন লাগছিল। কারন এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিলো ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে যার কারনে এই মন্দিরের নাম কৈলাশ বা কৈলাশা মন্দির। এই পুরো মন্দির একটি মাত্র পাথর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে যা আশ্চর্যের। সাধারনত যেকোন পাথরের স্থাপত্যকার্য করবার সময় পাহাড় কেটে কিংবা পাথরের সামনে থেকে খোদাই কার্য শুরু করা হয় এবং একাধিক পাথরের টুকরোকে জুড়ে বড় স্থাপত্য নির্মান করা হয়। কিন্তু এলোরা গুহাতে অবস্থিত কৈলাশ মন্দির তৈরির সময় আগে মন্দিরের উপরের কাজ করা হয়েছে তার পর ধীরে ধীরে নীচের কাজ করা হয়েছে, বিশ্বের এরকম অসাধারন পাথুরে স্থাপত্যের নিদর্শন কোথাও নেই। এই মন্দির সঠিক কখন নির্মান হয়েছে তা আজও জানা যায়নি তবে প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে এই পাথর ছয় হাজার বছরের পুরনো। ঐতিহাসিকদের মতে আট শতকে রাষ্ট্রকূট রাজা প্রথম কৃষ্ণ এই মন্দির তৈরি করেছিল ৭৫৬ থেকে ৭৭৩ এডির মধ্যে। তবে এটা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। কারন এই মন্দিরের কাছে স্থাপত্য রাষ্ট্রকূট ঘরানার মতো নয় অনেকটা পল্লব ও চালুক্যদের মতোন। এই কৈলাশ মন্দিরের সাথে উত্তর কর্নাটকের বীরুপাক্ষ মন্দিরের মিল আছে৷ এছাড়াও আরও একটি তথ্য প্রচলিত আছে মন্দির নির্মানকে ঘিরে। 

মধ্যযুগীয় সময়ে এই মন্দিরের বর্ননা বিভিন্ন সাহিত্যে রয়েছে। সেখানে এই মন্দিরকে মনিকেশ্বর মন্দির বলা হয়েছে। বলা হয় এলাপুরা রাজবংশের রানী মানিকাবতী এই মন্দির নির্মান করিয়েছিলেন। প্রচলিত কথা অনুসারে এলাজাপুরার রাজা পূর্ব জীবন থেকে কিছু অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মহিশামালাতে শিকারের সময় রাজা ও রানী ভগবান ঘৃষ্নেশ্বের উপাসনা করেন এবং রাজা সুস্থ হলে ভগবান শিবের জন্য মন্দির তৈরির প্রতিজ্ঞা করেন। মহিশামালার কুন্ডে স্নানের পর রাজা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যান এবং তখন রানী এই মন্দির তৈরি করান এবং নাম রাখেন মনিকেশ্বর। সেই রাজাই এলাপুর শহর তৈরি করেন এখানে যাকে আজ এলোরা বলা হয়।

প্রত্নতত্ববিদরা দাবি করে এই মন্দির নির্মানের সময় চার লাখ টন পাথরকে পাশ থেকে কাটা হয়েছে কিন্তু অদ্ভুত বিষয় সেই চার লাখ টন পাথরের কোন খোঁজ আজও পাওয়া যায়নি, এত বিশাল পরিমান পাথরকে কোথায় ফেলা হয়েছে আজও জানা যায়নি। ঐতিহাসিকরা এটাও জানিয়েছেন মাত্র আঠারো বছরে এই মন্দির নির্মান করা হয়েছে। প্রায় কয়েক হাজার বছর আগে হাতুড়ি সহ সামান্য কিছু উপকরনের সাহায্যে কি করে চার লাখ টন পাথর কেটে এই বিশাল মন্দির তৈরি করা হল তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। সেসময় স্থাপত্যকার্য এতটাই উন্নত ছিল যে পাথর কেটে সুন্দর বারান্দা, সিঁড়ি, জল নিকাশী ব্যবস্থা, বৃষ্টির জল ধরে রাখার ব্যবস্থা, মাটির নীচে গুহা, সেতু নির্মান করা হয়েছিল। স্থাপত্যকাজ এতটাই নিখুঁত ছিল যে একবার পাথর কেটে ফেলার পর তারপর অন্য কোন পাথরের টুকরো জুড়ে কোন কিছু করা হয়নি।

কৈলাশ মন্দির সম্পর্কে অনেক ধারনাই প্রচলিত আছে। যেমন বলা হয় এই মন্দির নির্মান করেছে কোন উন্নত সভ্যতার মানুষ যারা মানব জাতির থেকেও উন্নত, সোজা কথায় আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায় যাদের এলিয়েনস বলা হয়। এই ধারনার পেছনে কারনও আছে। আধুনিক যুগেও এত বিশাল, নিখুঁত মন্দির একটি পাথর কেটে বানাতে অনেক সময় লাগবে। প্রাচীন ভারতে যদি ধরা হয় ৭০০০ লোক প্রতিদিন ১২ ঘন্টা করে কাজ করতো তাহলে চার লাখ টন পাথর কাটতে হলে প্রতিবছর ২২,০০০ টনের বেশী পাথর কাটতে হতো। সেই হিসাবে প্রতিদিন ৬০ টন এবং প্রতি ঘন্টায় ৫ টন করে পাথর কাটতে হত। তখনকার দিনে শুধু হাতুড়ি, ছেনি দিয়ে এই কাজ করা রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার ছিল। শুধু পাথর কাটাই নয় মন্দিরের নকশা, পরিকল্পনা এবং স্থাপত্যকার্যও করা হয়েছে এই একই সময়ে। এটা কখনওই সম্ভব নয় বাইরের সাহায্য ছাড়া। 

১৬৮২ সালে ঔরাঙ্গজেব এক হাজার সেনাকে পাঠিয়েছিল তিন বছরের মধ্যে পুরো মন্দির ভেঙে ফেলতে কিন্তু তারা মন্দিরের বাইরে একটু ক্ষতি করা ছাড়া কিছুই করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে ঔরাঙ্গজেব ফিরে যায় ব্যর্থ হয়ে। এটাও বলা হয় এলোরা গুহার নীচে অসম্ভব উন্নত সভ্যতা ছিল তারাই এই মন্দির তৈরি করেছে। কারন এলোরার বিভিন্ন গুহার মধ্যে নীচে যাবার জন্য বেশ সংকীর্ন পথের সন্ধান পাওয়া গেছে কিন্তু এলোরা গুহার নীচে দশ ফুটের মধ্যে প্রবেশপথ এতটাই সংকীর্ন যে এখানে কোন মানুষ প্রবেশ করতে পারেনা। এখানে স্বাভাবিকভাবেই এটা মনে হয় যদি কেউ নীচে নামতেই না পারে তাহলে ওই সংকীর্ন পথগুলো কেন তৈরি করা হয়েছিল! প্রত্যেকটি গুহার মেঝেতে ছোট ছোট অনেক ছিদ্র আছে ঠিক অনেকটা বাতাস চলাচলের জন্য। এগুলো কিজন্য তৈরি করা হয়েছিল তা বোঝা যায়নি এখনও। এর কারনেই বলা হয় সম্ভবত মাটির নীচে এখানে কোন শহর ছিল এবং ওই ছিদ্র গুলো দিয়ে বাতাস চলাচল করত। এলোরার গুহাচিত্র দেখেও উন্নত সভ্যতার কথা মনে হয়। 

কৈলাশ মন্দিরকে বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের মধ্যে রাখা হয়নি কিন্তু কৈলাশ মন্দিরের স্থাপত্যকার্য এবং গুহাচিত্র আজও মানুষের কাছে রহস্যময়। শুধু কৈলাশ মন্দিরই নয় সনাতন হিন্দু ধর্ম গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে এমন অনেক আশ্চর্য স্থাপত্য রয়েছে যা আধুনিক মানুষকে অবাক করে দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *