প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টোকে যেভাবে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল
১৯৭০ এর দিকে দক্ষিন এশিয়ার ভৌগোলিক মানচিত্রটি একটু আলাদা ছিল। ভারতের পশ্চিমে তখন পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব দিকে ছিল পূর্ব পাকিস্তান যা আজকের বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জুড়ে সাধারন নির্বাচন হয় ৩১৩ টি আসনে। এই নির্বাচনে ১৬৭ টি আসনে জয় লাভ করে মজিবুর রহমানের আওয়ামি লীগ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পায় জুলফিকর আলি ভু্ট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি, ৮৬ টি আসনে। এই নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরম সংকটে পড়ে। যার কারন ছিল মুজিবুর রহমানের পূর্ব পাকিস্তানকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ গঠনের দাবি। ফলে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে পাকিস্তানি সেনা মোতায়েন হয় এবং বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচার শুরু হয়।
ভারতও বাংলাদেশ গঠনের দাবিকে সমর্থন জানায় এবং ১৯৭১ সালে শুরু হয় ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে পরাজিত হয় পাকিস্তান সেনা, ৯৩,০০০ পাকিস্তান সেনা আত্মসমর্পন করে ভারতের কাছে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয় জুলফিকর আলি ভুট্টো। ১৯৭৭ সালের ৭ মার্চ পাকিস্তানে পুনরায় সাধারন নির্বাচন হয় যাতে জুলফিকর আলি ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ২০০ আসনের মধ্যে ১৫৫ টিতে জয়লাভ করে। এরই সাথে সাথে পাকিস্তানের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতা হয় জুলফিকর আলি ভুট্টো। কিন্তু ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক বিশাল পরিবর্তন আসে। সেই দিন সকালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল জিয়াউল হক রেডিওর মাধ্যমে ঘোষনা করে পাকিস্তানে সেনাশাসনের ঘটনা এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টোর গ্রেফতারের খবর। নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় জুলফিকর আলি ভুট্টোকে। জেনারেল জিয়াউল হক দেশবাসীকে জানায় আগামী নব্বই দিনের মধ্যে একটি সুষ্ঠ গন নির্বাচন করার কথা। পাকিস্তান একটি এমনই দেশ যেখানে সেনাবাহিনীর কথাই শেষ কথা। দেশের কেন্দ্রে কোন সরকার থাকবে তা সেনাবাহিনীই ঠিক করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল।
পাকিস্তানে হঠাৎ করে হওয়া এই সেনাশাসন সম্পর্কে বুঝতে হলে দুটি চরিত্র সম্পর্কে জানা খুবই দরকার পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর আলি ভুট্টো এবং পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান মহম্মদ জিয়াউল হক। জুলফিকর আলির জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে ১৯২৮ সালে। তার বাবা শাহ নাওয়াজ ভুট্টো গুজরাটের জুনাগড়ের বাসিন্দা ছিল। ১৯৫০ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে স্নাতক হয় জুলফিকর আলি ভুট্টো। ১৯৫১ সালেই তার বিয়ে হয় এক ইরানিয়ান বংশোদ্ভূত মহিলার সাথে। এরপর শুরু হয় তাঁর রাজনীতিতে উত্থান। ১৯৫৭ সালে জাতিসংঘে পাকিস্তানের সবচেয়ে কম বয়সী প্রতিনিধি এবং ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সবচেয়ে কমবয়সী মন্ত্রী হয় জুলফিকর আলি ভুট্টো। ১৯৬০ সালে পাকিস্তানের জল, বিদ্যুৎ এবং যোগাযোগ ব্যাবস্থার মন্ত্রী এবং ১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ বিদেশমন্ত্রকের মন্ত্রী হয় জুলফিকর আলি ভুট্টো। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন জুলফিকর আলি ভুট্টো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের কাছে শোচনীয় পরাজয় এবং ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সেনার ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের মতো লজ্জাজনক ঘটনার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরানো হয় জেনারেল ইয়াইয়া খানকে এবং সেই জায়গায় রাষ্ট্রপতি হয় জুলফিকর আলি ভুট্টো। এর থেকে বোঝা যায় জুলফিকর আলি ভুট্টোর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার কতটা শক্তিশালী ছিল। এবার আসা যাক এই ঘটনার সাথে জড়িত দ্বিতীয় ব্যাক্তি জেনারেল জিয়াউল হক প্রসঙ্গে।
১৯২৪ সালে পাঞ্জাবের জলন্ধরে জন্ম হয় জিয়াউল হকের। তার বাবা মহম্মদ আকবর আলি দিল্লি সেনাবাহিনীর মুখ্য কার্যালয়ে কাজ করতেন। ১৯৪৩ সালে দিল্লির সেন্ট স্টিফান কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক হয়ে ১৯৪৫ সালে দেরাদুনে ভারতীয় মিলিটারি অ্যাকাডেমি থেকে সেনা অফিসার হয় জিয়াউল হক। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান বিভক্ত হবার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মেজর পদে যোগ দেয় জিয়াউল হক।
১৯৫০ সালে তার বিবাহ হয়। ১৯৬০-৭০ এর সময়ে জিয়াউল হককে জর্ডানে পাঠানো হয় সেখানকার সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষক হিসাবে। এরপর ১৯৭৬ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তাকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল করে দেওয়া হয় এবং মূলতানে পাঠানো হয়। অর্থাৎ জুলফিকর আলি ভুট্টো এবং জিয়াউল হক উভয়েই নিজেদের বিভাগে অতিদ্রুত উন্নতি করছিলেন। জিয়াউল হককে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিযুক্ত করেন জুলফিকর আলি ভুট্টো। সেইসময় পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ছিল জেনারেল টিক্কা খান। কিন্তু টিক্কা খানের অবসরে যাবার সময় হয়ে আসছিল যার জন্য পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য নতুন সেনাপ্রধানের দরকার ছিল। জেনারেল টিক্কা খান সাতজন লেফটেন্যান্টের নাম প্রস্তাব রাখে জুলফিকর আলি ভুট্টোর সামনে পরবর্তী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে। কিন্তু জুলফিকর আলি ভুট্টোর দরকার ছিল এমন একজন সেনাপ্রধান যে তাঁর ইশারায় কাজ করবে।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান তৈরি হবার পর মহম্মদ আলি জিন্নাহ ভারতের ভয়ে দেশ চালাবার দায়িত্ব একপ্রকার সেনাবাহিনীকে দিয়ে দেয়। সেই থেকেই পাকিস্তানের পূর্ন ক্ষমতা সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করে। জুলফিকর আলি ভুট্টো সেনাবাহিনীকে তাঁর অধিনস্ত রাখবার জন্য জিয়াউল হককে পরবর্তী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করেন। জেনারেল টিক্কা খান জিয়াউল হক সম্পর্কে জুলফিকর আলি ভুট্টোকে সাবধান করেছিলেন, যে এই ব্যাক্তির মধ্যে সেনাপ্রধান হবার কোন যোগ্যতা নেই কিন্তু জুলফিকর আলি ভুট্টো কোনও কথাই শোনেননি। জুলফিকর আলি ভুট্টোর পূর্ন ভরসা ছিল জিয়াউল হকের প্রতি।
১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের সাধারন নির্বাচনে ২০০ এর মধ্যে ১৫৫ আসনে জয়লাভ করে জুলফিকর আলি ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান নেশনস লিগ পায় মাত্র ৩৬ টি আসন। এরপরেই পাকিস্তান নেশনস লিগের সদস্যরা বিক্ষোভ ও হিংসা শুরু করে। যাতে ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাকিস্তানের অর্থনীতি। প্রায় ৭৬৫ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয় পাকিস্তানের এবং রপ্তানি ৩৫ শতাংশ কমে যায়। এরকম অবস্থায় ৫ জুলাই একে একে সমস্ত ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের গ্রেফতার করে পাকিস্তান সেনা এবং জুলফিকর আলি ভুট্টোকেও গ্রেফতার করা হয় এবং দেশে সেনা শাসনের ঘোষনা করা হয়। জুলফিকর আলি ভুট্টো কোনওদিন স্বপ্নেও ভাবেনি তারই সবচেয়ে কাছের ব্যাক্তি জেনারেল জিয়াউল হক তাঁকে গ্রেফতার করবে। এরপর দুইবার জুলফিকর আলি ভুট্টো জেল থেকে মুক্তি পায় কিন্তু আবারও কয়েকদিনের মধ্যে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জুলফিকর আলি ভুট্টোর উপর তারই প্রতিদ্বন্দ্বী নেতা আহমেদ রেজাকে গ্রেফতারের অভিযোগ ছিল। জুলফিকের বেশ কয়েকজন মন্ত্রীও এই ঘটনার সত্যতা আদালতে স্বীকার করে নেয়।
১৮ মার্চ, ১৯৭৮ সালে লাহোর আদালত জুলফিকর আলি ভুট্টোকে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ডের ঘোষনা করে। ভুট্টোকে রাওয়ালপিন্ডির জেলে পাঠানো হয়। ভুট্টোর আইনজীবি সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে। ৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৭৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট জুলফিকর আলি ভুট্টোর ফাঁসির আদেশ দেয়। সেইসময় জিয়াউল হক পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিও ছিল। ৪ এপ্রিল ১৯৭৯ রাওয়ালপিন্ডির জেলেই ফাঁসি হয় জুলফিকর আলি ভুট্টোর। ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানে মন্ত্রীর হাতেই রাজার মৃত্যু হল এভাবে।