যে যুদ্ধে গ্রীকদের পরাজয় হলে বেশীরভাগ দেশে আজ রাজতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা দেখা যেত
একটি বিশাল শক্তিশালী সাম্রাজ্য গঠনে অনেক সময় লাগে। সেনা প্রশিক্ষন, শক্তিশালী সেনা দল গঠন, সঠিক রননীতি, যুদ্ধাস্ত্র, লোকবল গঠন করে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ জেতার মাধ্যমে একটি বড় সাম্রাজ্য গঠন হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াতে অনেক সময় ব্যয় হয়। কিন্তু কখনও এত পরিশ্রমের পর সামান্য একটি ভুলে গোটা সাম্রাজ্যের পতন হতে পারে। ঠিক এমনই একটি ঘটনা ঘটে ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে(BCE)। সেসময় ইউরোপ সহ মধ্য এশিয়াতে দুটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল পার্সিয়ান সাম্রাজ্য এবং গ্রীক সাম্রাজ্য। পার্সিয়ান সাম্রাজ্য অনেক ধনী, শক্তিশালী ও আয়তনে বড় সাম্রাজ্য ছিল। সেই তুলনায় গ্রীক সাম্রাজ্য আকারে ছোট ও অর্থনৈতিক সমস্যায় ছিল। পার্সিয়ায় রাজার আদেশ এতটাই চলতো যে সাধারন মানুষের চিন্তাধারার তেমন গুরুত্ব দেওয়া হতো না কিন্তু গ্রীক সাম্রাজ্যে প্রত্যেক নাগরিককে গুরুত্ব দেওয়া হত। ৪৮০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে পার্সিয়ান সম্রাট ছিল জারসেস, যিনি গ্রীকদের থেকে বদলা নেওয়ার জন্য গ্রীক আক্রমন করেন।
গ্রীকদের সাথে ম্যারাথনের যুদ্ধে জারসেসের বাবা ডারিয়াস দি গ্রেট পরাজিত হয়। সেই কারনে জারসেস গ্রীকদের পরাজিত করে গ্রীসকে পার্সিয়া সাম্রাজ্যভুক্ত করবার জন্য যুদ্ধ শুরু করে। জারসেস আধুনিক তুরস্কের এশিয়া ও ইউরোপ অংশের মধ্যে হ্যালেসপন্ট সেতু নির্মান করে গ্রীস আক্রমনের জন্য। সেসময় এত মজবুত সেতু তৈরি এবং বিশাল সেনাকে সেখান দিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রমান করে সেসময় কারিগরি বিদ্যা কতটা আধুনিক ছিল। গ্রীক সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে ছোট ছোট প্রদেশ জয় করে যাচ্ছিল জারসেস। গ্রীক সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ন শহর ম্যাসিডোনিয়া জিতে জারসেসের সেনা গ্রীসের উপকূল হয়ে দক্ষিন প্রান্তে উপস্থিত হয় এবং আরও একটি গুরুত্বপূর্ন শহর এথেন্স দখল করবার চিন্তা করে। এথেন্সের বেশীরভাগ মানুষ এই খবর পেয়ে প্রান বাঁচাতে সালামি নামে একটি দ্বীপে চলে যায়। জারসেসের সেনা এথেন্স দখল করে সেখানে আগুন লাগিয়ে দেয়। জারসেস এটা করেছিল প্রতিশোধ নিতে কারন কিছুবছর আগে গ্রীসে অ্যারিসটাগোরাসের নেতৃত্বে আয়োনিয়ান বিদ্রোহ হয়। এরা পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ন শহর লিডিয়ার রাজধানী সারডসে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। তারই প্রতিশোধ নিতে জারসেস এথেন্সে আগুন লাগিয়ে দেয়। তবে পার্সিয়ানদের বিজয় এত সহজ হয়নি। এথেন্সে আসার আগে তাদের থার্মোপলি অতিক্রম করে আসতে হয়েছিল। এই থার্মোপলি এমন এক জায়গা যার ঘটনার উপর বিখ্যাত ৩০০ সিনেমা তৈরি হয়েছে। যেখানে ৩০০ স্পার্টান সেনা বহু পার্সিয়ান সেনাকে হত্যা করে। ফলে তাদের মোনোবল প্রায় ভেঙে যায় কিন্ত তারপরেও পার্সিয়ানরা এগোতেই থাকে। গ্রীকরা যোদ্ধা ছিল কিন্তু এত বিশাল সেনাকে কিভাবে পরাস্ত করবে তা বুঝে উঠতে পারছিলনা তারা।
পার্সিয়ান সেনাবাহিনীকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষন করে গ্রীকরা তাদের একটি দুর্বলতা খুঁজে পায়৷ পার্সিয়ান সেনাবাহিনী সংখ্যায় বিশাল ছিল কিন্তু পুরো গ্রীসে তাদের জন্য খাদ্য, রসদ দেওয়া সম্ভব ছিলনা। সেজন্য পার্সিয়ান সেনাবাহিনীর পেছনে একটি সরবরাহকারী দল ছিল যারা খাদ্য, পানীয় সহ প্রয়োজনীয় জিনিস সবসময় সরবরাহ করতো। এটা যুদ্ধের নিয়ম, কোন দেশ কাউকে আক্রমন করলে সরবরাহ কারী দল সব প্রয়োজনীয় জিনিস বহন করে। গ্রীকরা ভাবে যদি এই দলের উপর আক্রমন করা যায় তাহলে হয়ত পার্সিয়ানদের আটকানো সম্ভব হবে। পার্সিয়ান সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় রসদ দেবার জন্য এজিয়ান সাগরে প্রচুর জাহাজ ছিল জারসেসের। স্থল সেনার পাশাপাশি শক্তিশালী নৌবাহিনীও ছিল জারসেসের। এজিয়ান সাগরে প্রবল সামুদ্রিক ঝড় ও ঢেউ এর কারনে জারসেসের নৌবাহিনীর এক তৃতীয়াংশ ধ্বংস হয়ে যায়। কিন্তু তার পরেও জারসেসের কাছে এত বিশাল নৌবহর ছিল যা গ্রীকদের মোট নৌবহররের চার গুন। গ্রীকদের কাছে ৩৭০ যুদ্ধজাহাজ ছিল সেসময় অন্যদিকে এক তৃতীয়াংশ নৌবাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবার পরেও জারসেসের কাছে প্রায় বারোশোর বেশী যুদ্ধজাহাজ ছিল অর্থাৎ কোন ভাবেই গ্রীকরা পার্সিয়ানদের হারাতে পারতোনা। পার্সিয়ান যুদ্ধজাহাজ গুলো আকারে গ্রীক জাহাজ গুলোর তুলনায় বড় ছিল এবং তাতে প্রশিক্ষিত অভিজ্ঞ যোদ্ধা ছিল। বাধ্য হয়ে গ্রীকরা তাদের যুদ্ধজাহাজ গুলো সালামি দ্বীপের পেছনে লুকিয়ে ফেলেছিল। ওই জায়গা ছিল সংকীর্ন এবং পার্সিয়ান জাহাজ গুলোর থেকে দূরে। গ্রীকরা জানতো পার্সিয়ান জাহাজ আকারে বড় হওয়ায় সহজে মোড় ঘুরতে পারবেনা এবং তাদের গতিও কম। অন্যদিকে জারসেস জানতো গ্রীকরা তাদের নৌবাহিনী কোথাও লুকিয়ে রেখেছে কিন্তু তাঁর কাছে গ্রীক নৌবাহিনীর কোন গুরুত্ব ছিলনা তাঁর লক্ষ্য ছিল পার্সিয়ান সেনাবাহিনীর সরবরাহ যেনো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চলতে থাকে। সেসময় গ্রীক নৌবাহিনীর প্রধান কম্যান্ডার ছিল থার্মেস্টোক্লিস। তিনি জানতেন তাঁর নৌবাহিনী যদি এভাবেই লুকিয়ে থাকে তাহলে পার্সিয়ান সেনাবাহিনীর সরবরাহ ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে এবং পার্সিয়ান স্থলসেনার সামনে গ্রীক স্থলসেনার কিছুদিনের মধ্যেই পরাজিত হবে কিন্তু তাঁর কাছে কোনও উপায়ও ছিলনা। তাঁর তুলনায় চারগুন শক্তিশালী শত্রুকে আক্রমন করার অর্থ আত্মহত্যারই সমান।
এর মধ্যেই হঠাৎ এমন একটি ঘটনা ঘটে যা এই যুদ্ধের গতি প্রকৃতি পুরো পরিবর্তন করে দেয়। একদিন সকালে পার্সিয়ান সেনাদের ছাউনিতে একজন লোক এসে উপস্থিত হয় এবং সে নিজেকে গ্রীকদের থেকে এসেছে বলে পরিচয় দেয় এবং বলে সে জারসেসের সাথে দেখা করতে চায়। জারসেসের কাছে গিয়ে সে জানায় তার নাম সিশিনাস এবং সে গ্রীক নৌবাহিনীর কম্যান্ডার থার্মেস্টোক্লিসের ক্রীতদাস ছিল। গ্রীকরা তার উপর অনেক অত্যাচার করেছে, যার কারনে সে প্রতিশোধ চায়। সিশিনাস জারসেসকে জানায় গ্রীক নৌবাহিনী সালামি দ্বীপে লুকিয়ে আছে এবং তারা দ্বিধাবিভক্ত। তাদের মধ্যে ঐক্য নেই, এটাই সঠিক সময় তাদের আক্রমন করার। জারসেস সাথে সাথে গ্রীক নৌবাহিনীকে আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। পরেরদিন সকালেই জারসেস তাঁর সমস্ত কম্যান্ডারদের ডেকে আদেশ দেয় গ্রীক নৌবাহিনীকে আক্রমন করার।
পার্সিয়ান যুদ্ধজাহাজ এগোতে শুরু করে সালামি দ্বীপের দিকে। কম্যান্ডাররা প্রথমে জারসেসকে আক্রমন না করার ব্যাপারে বোঝালেও জারসেস তাঁর কথায় অনড় থাকে। জারসেস স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি তাঁর সাথে কি হতে চলেছে। সিশিনাসকে পাঠানো, জারসেসকে লোভ দেখানো এটা পুরো ছিল থার্মেস্টোক্লিসের পরিকল্পনা। সালামি দ্বীপ গ্রীসের মূল ভূখন্ড থেকে অল্প দূরে অবস্থিত একটি দ্বীপ। গ্রীসের মূল ভূখন্ড ও সালামি দ্বীপের মধ্যে জলভাগ খুবই সংকীর্ন। এখানে একসাথে একটি বা দুটি জাহাজ প্রবেশ করতে পারতো। থার্মেস্টোক্লিস জানতো সমুদ্রে সরাসরি বিশাল পার্সিয়ান নৌসেনাকে আক্রমন করা সম্ভব নয়, তাই সে এই পরিকল্পনা তৈরি করে। গ্রীস নৌসেনা আগে থেকেই তৈরি ছিল। পার্সিয়ান যুদ্ধজাহাজ গুলো একে একে সেই সংকীর্ন অংশে প্রবেশ করে আর তাদের ধ্বংস করে গ্রীকরা। এভাবে বিশাল পার্সিয়ান নৌবাহিনীর বেশীরভাগ জাহাজ ধ্বংস হয়ে যায়। অবস্থা এমন হয় জারসেস বেঁচে যাওয়া অল্প কিছু জাহাজ নিয়ে একটি বড় সেনা উত্তর গ্রীসে রেখে পালিয়ে যায়। তাঁর গ্রীক বিজয়ের স্বপ স্বপ্নই থেকে যায়। থার্মেস্টোক্লিসের নেতৃত্বে প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে গ্রীকরা। সিশিনাস আগে ক্রীতদাস ছিল কিন্তু পরে তাকে মুক্ত করে গ্রীক নাগরিক করে দেওয়া হয়েছিল। সে থার্মেস্টোক্লিসের বড় বিশ্বাসী ব্যাক্তি ছিল। প্রথম দিনের পর দ্বিতীয় দিনে সিশিনাসকে পার্সিয়ান ছাউনিতে খুঁজে পাওয়াও যায়নি এটা জারসেস জানতো কিন্তু তাও বিশাল নৌবাহিনী থাকায় তাঁর মনে হয়েছিল সে অপরাজেয়। শুধুমাত্র ভুল সিদ্ধান্তের কারনে চারগুন বেশী শক্তিশালী হবার কারনে পার্সিয়ানদের পতন হয়েছিল। যদি সেইসময় যুদ্ধে গ্রীকদের পতন হত তাহলে আজ হয়ত ইতিহাস অন্যরকম হত। কারন গ্রীকরা গনতন্ত্র, স্বাধীন মতাদর্শে বিশ্বাস করতো যা পরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে কিন্তু পার্সিয়ানরা রাজতন্ত্র নীতিতে চলতো যেখানে জনগনের থেকে রাজার কথাই মানা হত। যদি সেসময় পার্সিয়া জিতে যেত তাহলে বেশীরভাগ দেশে রাজতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী শাসন ব্যাবস্থা দেখা যেত। অতীতে সেই পার্সিয়াই বর্তমানের ইরান।