অফবিট

মশারা মাছেদের রক্ত পান করে! কোন প্রজাতির মশা?

মশা আমাদের অতি পরিচিত একটি প্রাণী। কিন্তু কখনও কি এই ক্ষুদে প্রাণীটির সম্পর্কে একটু গভীর ভেবে দেখেছেন যে কেন মশা রক্তই খায় আর কেনই বা কানের কাছে এসে গান শোনাই? জেনে এই ক্ষুদে প্রাণীর সম্পর্কে কিছু তথ্য।

মশার ধরনভেদ

মশা হল প্রাণীজগতের সবচেয়ে বড় পর্ব আর্থ্রোপোডার মাছি বর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী। গোটা পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজারের বেশি মশার জাত রয়েছে। তবে যদি দেশভিত্তিক বিচার করতে হয় তাহলে সেই সংখ্যাটা এসে দাঁড়াবে শ’পাঁচেক। যুক্তরাষ্ট্রে মশার প্রজাতি দুই শতাধিক রয়েছে। আর বাংলাদেশে মশার প্রায় ১২৩ প্রজাতি রয়েছে। যার মধ্যে কিছুসংখ্যক মশা ক্ষতিকারক। বাংলাদেশে থাকা ১২৩ প্রজাতির মশার মধ্যে ২২ প্রজাতির মশা রোগ ছড়ায়। এই মশাগুলি মানুষের রক্ত পান করার পাশাপাশি ধরন, বৈশিষ্ট্য কিংবা স্বভাবভেদে অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্তও পান করে। এছাড়াও এমনও কিছু মশার প্রজাতি রয়েছে যারা মাছের রক্তও পান করে।

তবে যে সমস্ত মশা প্রাণীর রক্ত খেয়ে জীবন অতিবাহিত করে তারা হল স্ত্রী মশা। স্ত্রী মশা যেহেতু ডিম পারে এবং বংশবিস্তার করে সেই জন্য তাদের বাড়তি প্রোটিনের প্রয়োজন হয় সেই কারণেই এরা রক্ত পান করে তাদের চাহিদা মেটায়। আর পুরুষ মশারা উদ্ভিদের বিভিন্ন উপাদানের উপর নির্ভর করে বেঁচে থাকে। তারা মধু, ফুলের রস এবং গাছের কাণ্ড থেকে বিভিন্ন প্রকারের রস শোষণ করে জীবন অতিবাহিত করে।  

কতগুলি অংশ থাকে মশার? 

একটি প্রাপ্ত বয়স্ক মশার মূলত ৩টি অংশ থাকে। মাথা, বক্ষ এবং পেট।

ক. মাথা 

মশার মাথা বিভিন্ন অংশে বিভক্ত থাকে। যার সাহায্যে খাবার গ্রহণ করা, দেখা এবং গন্ধ পাওয়া ইত্যাদি কাজ করে মশা। 

১. এন্টেনা: এই অঙ্গের সাহায্যে কোন ব্যক্তির নিঃশ্বাস থেকে নির্গত হওয়ার কার্বন ডাই অক্সাইড মশা চিহ্নিত করতে পারে। পাশাপাশি এই অঙ্গের সাহায্যে বাতাসের তারতম্যও ধরতে পারে।

২. চোখ: মশারও দুটি চোখ আছে। আর এর মাধ্যমে সামনে থাকা কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর চলাফেরাকে তারা চিহ্নিত করতে পারে। 

৩. পাল্প: দুটি এন্টেনার মধ্যখানে এই অঙ্গটি  থাকে। যার সহায়তায় মশা গন্ধ শুঁকতে পারে।

৪. হাতিশুঁড়: হাতিশুঁড় এই অঙ্গটি সব মশাতেই থাকে তবে এই অঙ্গটি পুরুষ মশার থেকে স্ত্রী মশাদের জন্য বেশি কার্যকরী। অর্থাৎ স্ত্রী মশারা এই অঙ্গটির সাহায্যে কোনো ব্যক্তি বা প্রাণীর ত্বক ছিদ্র করে এবং রক্ত ​​বের করে দেয় কিন্তু পুরুষ মশাদের এই অঙ্গটির ত্বক ছিদ্র করার মতো শক্তিশালী নয়। 

খ. বক্ষ 

উপরের দিকে মাথা এবং নিচের পাখা ও পায়ের সাথে সংযুক্ত থাকে মশার বক্ষ 

১. গলরজ্জুঃ  

মশার  একটি ছোট পাখার মতো অঙ্গটি উড়ন্ত অবস্থায় স্টিয়ারিংয়ের জন্য ব্যবহার করে। 

২. ডানা: মশার দুটি ডানা রয়েছে যা ওড়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। 

৩. পা: মশার ছয়টি পা রয়েছে। 

৪. উরুর হাড়: পায়ের উপরের অংশ এটি। 

৫. টিবিয়া: পায়ের মধ্য-অংশ এটি। 

৬. টার্সাস: মশার পায়ের নিচের অংশ এটি। এটির সহায়তায় মশা দাঁড়িয়ে থাকতে এবং জলের উপর হাঁটতে পারে।  

গ. পেট 

মশার বক্ষের সাথে সংযুক্ত থাকে পেট। এটি পাকস্থলি, প্রজনন ব্যবস্থা পাশাপাশি শ্বাসযন্ত্রের অংশ হিসেবেও কাজ করে।

১. জেনিটালিয়া: জেনিটালিয়া হল মশার যৌনাঙ্গ। এই অঙ্গের মাধ্যমে স্ত্রী মশারা ডিম নির্গত করে। 

মানুষের রক্তের নেশা কেন মশাদের? 

এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী এক গবেষণা শুরু করেছিলেন। এই গবেষণা করার জন্য ওই বিজ্ঞানীরা আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চলের প্রায় ২৭টি আলাদা আলাদা জায়গা থেকে এডিস এজিপ্টি জাতের মশার ডিম সংগ্রহ করে সেগুলিকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি ল্যাব বক্সে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

এই গবেষণাটির ফলাফল কি হয়েছিল তা জানিয়েছিলেন গবেষণা দলটির সদস্য অধ্যাপক নোহ রোজ। তিনি জানিয়েছিলেন যে যে অঞ্চলগুলি খরা প্রবণ বা তাপমাত্রা বেশি সে সমস্ত অঞ্চলের মশা প্রজননের জন্য আদ্রতা প্রয়োজন মেটাতে রক্তের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে অর্থাৎ এই গবেষকের মত অনুযায়ী, এই মশা একপ্রকার নিরুপায় হয়ে বেছে নিতে হয় এই পথটিকে।

কেন মশা কানের কাছে গান গায়?  

আমরা যেটিকে মশার গান গাওয়া ভাবি সেটি আসলে মশার দুটি ডানা ঝাপটানোর শব্দ। মশারা সেকেন্ডে প্রায় আড়াই শতাধিক বার তার ছোট্ট দুই ডানা ঝাপটায়। যেহেতু আকারে মশা খুবই ছোট একটি প্রাণী সেই কারণে আমাদের কানের কাছে এলেই আমরা শুনতে পাই সেই শব্দ। 

কিন্তু মশারা কেন আমাদের কানের কাছেই এসে ঘোরাঘুরি করে? কেন এত প্রিয় মানুষের কান?

গবেষণা অনুযায়ী বলা হয়েছে, এই প্রশ্নের উত্তর হল গন্ধ। অর্থাৎ আমাদের কানকে দেহের সবথেকে নোংরা স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে বিশেষ করে কানের ভিতরের অংশকে। সব সময় কানের ছিদ্র খোলা থাকার কারণে ধুলো ময়লা সহজেই কানের ভেতরে চলে যায় যার ফলে এই ময়লা পরিষ্কার না করা হলে ময়লাগুলি কানের ভিতর জমে থাকে। এই ময়লাকে ওয়াক্স বা ‘খোল’ বলা হয়। কানের ভিতর জমে থাকা এই ওয়াক্স বা ‘খোল’ থেকে এক ধরনের গন্ধ নির্গত হয় যা মশার অত্যন্ত প্রিয়। এই কারণেই আমাদের কানের আশেপাশে মশা বেশি ঘোরাঘুরি করে।

তবে আরও একটি কারণ আছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছে। তাদের মত অনুযায়ী, এই কারণটি হতে পারে আমাদের শরীর থেকে নিঃশ্বাসের সাথে নির্গত হওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইড। আমাদের শরীর থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়, এবং মশা আমাদের শরীরের উষ্ণতা এবং আর্দ্রতার মাধ্যমে আমাদের চিহ্নিত করে থাকে বলে ধারণা করে বিজ্ঞানীরা। আর এই কারণেই  আমাদের নাক ও মুখের আশেপাশে মশাকে বেশি ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়।

মানুষ ভেদে মশার আকর্ষণ ভিন্নতা

মশা কিন্তু সব মানুষকেই কামড়ায় না। এই নিয়ে ১৯৯৮ সালে এক গবেষণা প্রকাশিত হয়েছিল। সেই গবেষণার উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা বলছে যে, মশা  নারী এবং পুরুষের মধ্যে পুরুষদের রক্তের প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হয়। গবেষকরা জানান যে, মশাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে হিসাবে পুরুষদের থাকার কারণ হচ্ছে তাদের বিশালাকার শারীরিক গঠন। স্থূলকায় পুরুষদের নিঃশ্বাসের সাথে বেশি পরিমাণে কার্বন ডাইঅক্সাইডও নির্গত হয় এবং শরীরে তাপমাত্রাও বেশি থাকে।

অন্য আরেকটি গবেষক দলের মত অনুযায়ী, মশারা নারীদের মধ্যে বেশি আকৃষ্ট হয় সন্তানসম্ভবা নারীদের প্রতি। এর কারণটিও পুরুষদের চিহ্নিত করা কারণগুলির মতোই অর্থাৎ নিঃশ্বাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের আধিক্য ও দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি। বাকি নারীদের থেকে সন্তানসম্ভবা নারীদের তুলনামূলক ২১ শতাংশ বেশি হারে নিঃশ্বাসের সাথে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হয়।

নিউইয়র্কের অ্যালার্জি ও অ্যাজমা কেয়ার বিষয়ক চিকিৎসক ক্লিফোর্ড ডব্লিউ ব্যাসেট বলছেন যে, শুধু কার্বন ডাইঅক্সাইড নয় মানুষের শরীরে থাকা ল্যাকটিক এসিডের প্রতিও মশা আকৃষ্ট হয়। এই ধরনের কেমিকেলগুলো প্রাণীদেরকে প্রায় ৩০ মিটার দূরে থেকেই চিহ্নিত করতে পারে।

আবার যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করেন তাদের প্রতিও মশা বেশ আকৃষ্ট হয়। এর কারণেও এই ল্যাকটিক এসিডই। ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করার পর আমাদের শরীরের মাংসপেশি গুলো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে ল্যাকটিক এসিড নির্গত করে থাকে। যার ফলে এই ল্যাকটিক অ্যাসিডের গন্ধ পেয়েই মশারা ছুটে আসে।

এছাড়াও আরও একটি কারণ চিহ্নিত করা হয় মশাদের আকর্ষণের কারণ হওয়ার। এটি হল মানুষের রক্তের গ্রুপ। ‘ও পজিটিভ’ রক্তের গ্রুপ মশাদের অত্যন্ত প্রিয় খাবার। তাই ‘ও পজিটিভ’ রক্তের মানুষের প্রতি বেশি আকৃষ্ট থাকে মশা। এমনকি গবেষকরা জানাচ্ছেন যে, এই গ্রুপের ক্ষেত্রে মশার কামড় খাওয়ার হার প্রায় ৮৩ শতাংশ। 

একটি মশা কতদিন বাঁচে?  

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী একটি প্রাপ্তবয়স্ক মশা প্রজাতি, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং অন্যান্য কারণের উপর ভিত্তি করে দুই-চার সপ্তাহ বেঁচে থাকতে পারে। 

তবে পুরুষ মশাদের থেকে স্ত্রী মশারা বেশি দিন বেঁচে থাকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *