১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে বাংলাদেশের গরীবপুর কেন বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল?
নভেম্বর, ১৯৭১ আসতে আসতে দক্ষিন এশিয়ায় আরও একটি যুদ্ধের কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। পূর্ব পাকিস্তান বা অধুনা বাংলাদেশে তখন রীতিমতো গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তানের কয়েক কোটি বাঙ্গালী মানুষের দাবি ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কিন্তু এর বিপরীতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রচুর সেনা পাঠানে হয় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে অত্যাচার করবার জন্য। পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের নারকীয় অত্যাচারে পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাতারে কাতারে মানুষ ভারতে শরনার্থী হিসাবে আসতে শুরু করে যার কারনে ভারত আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার সম্পর্কে জানায়। এর জবাবে ইসলামাবাদ থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান জানায় তারা আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। তার আরও দাবি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী শুধুমাত্র অস্ত্রধারী বিদ্রোহীদেরই হত্যা করছে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তার এই মিথ্যা ভাষনের পর্দা ফাঁস হয়। ভারত কয়েক মাস আগে থেকেই প্রস্তুত হতে শুরু করেছিল কারন ইনটেলিজেন্স তথ্য অনুযায়ী ভারত বুঝে গিয়েছিল যুদ্ধ অবশ্যাম্ভাবী। তবে যুদ্ধের আগে ভারত কুটনৈতিক ভাবে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু এই পদ্ধতি ব্যার্থ হয় ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ ছিল সময়ের অপেক্ষা।
১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয় পূর্ব পাকিস্তানের গরীবপুরে। ভৌগলিক ভাবে গরীবপুর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ছিল ভারতের কাছে কারন এখানে ভারত ও বাংলাদেশের সীমানা রয়েছে। গরীবপুরের মাধ্যমে ভারতীয় সেনাবাহিনী সরাসরি যশোর পৌঁছাতে পারতো। পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নারকীয় অত্যাচারের প্রতিবাদে ভারত সেনাবাহিনী পাঠায় গরীবপুরে। ভারত জানতো গরীবপুরে সেনা পাঠালে আন্তর্জাতিক স্তরে সমস্যা হবে তবে ভারত এর জন্য প্রস্তত ছিল। গরীবপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে এয়ার সাপোর্ট দিতে উপস্থিত হয় পাকিস্তান বায়ুসেনার ১৪ নাম্বার স্কোয়াড্রনের তিনটি ক্যানাডিয়ার স্যেবার যুদ্ধবিমান। এর জবাবে ভারতীয় বায়ুসেনার ১১ নাম্বার স্কোয়াড্রনের চারটি ফোল্যান্ড গ্যানাট যুদ্ধবিমানও আসে গরীবপুরে। এই আাকাশ যুদ্ধই ১৯৭১ এর ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সূচনা করে। তবে এর আগে একটি গুরুত্বপূর্ন সংঘর্ষ হয় ভারত ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্যে।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকেই পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের কাছে ভারতের কৃষ্ণনগর, কৃষ্ণগঞ্জে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৪ পাঞ্জাব ব্যাটেলিয়ন, ৪২ ইনফ্রেন্টি ডিভিশন, ৯ ইনফ্রেন্টি ডিভিশনকে মোতায়েন করা হয়েছিল যাদের কাজ ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা লাখ লাখ শরনার্থীকে আটকানো এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর নজর রাখা। এদের কল্যানীতে ট্যাঙ্ক যুদ্ধের প্রশিক্ষনও দেওয়া হয়। ১৬ অক্টোবর ১৪ পাঞ্জাব ডিভিশন বামনডাঙ্গা পৌঁছায় ট্যাঙ্ক নিয়ে। ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের প্রশিক্ষিত মুক্তিবাহিনীর সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ হচ্ছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর।
১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর দিনটিকে সেনা অভিযানের জন্য বেছে নেয় ভারত। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট কর্নেল রাজকুমার সিংকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তানের ছয় কিলোমিটার ভিতরে ফতেহপুর এবং পরেরদিন অর্থাৎ ২১ নভেম্বর গরীবপুর বিজয় করার। ২০ নভেম্বর সকাল সাতটায় ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট গরীবপুরের দিকে যাত্রা শুরু করে। ভারতীয় ইঞ্জিনিয়াররা অসাধারন দক্ষতায় সেতু নির্মান করে সমস্ত ট্যাঙ্ককে নদী পার করায় এবং রাতে গরীবপুরে পৌঁছায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭ ডিভিশন গরীবপুর থেকে কিছু দূরে চৌগাছা গ্রামে ছিল, ফলে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই ভারতীয় সেনাবাহিনী গরীবপুর তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। ২১ নভেম্বর রাত দুটোর সময় ভারতীয় সেনাবাহিনী আরও আগে এগোনোর সিদ্ধান্ত নেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আলফা, ব্রাভো, ডেল্টা, চার্লি এরকম ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন মিশনের দায়িত্ব নেয়। ট্যাঙ্ক বাহিনী নিয়ে দক্ষিন জগন্নাথ পুরের দিকে এগোয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দল। ডেল্টা দলের ক্যাপ্টেন বলবীর সিং তার মেশিনগান দল নিয়ে দক্ষিন জগন্নাথ পুরের দিকে এগোয়। চার্লি দলের দায়িত্ব ছিল চৌগাছার পীতম্বরপুর রেলওয়ে ট্রাক পাহাড়া দেওয়া এবং সাধারন নাগরিকদের যুদ্ধের থেকে রক্ষা করা। আলফা ও ব্রাভো দলের ক্যাপ্টেন মেজর বিশ্বনাথন এবং মেজর মেকিয়ার দায়িত্ব ছিল চার্লি ও ডেল্টা দলের মাঝের ব্যবধানকে রক্ষা করা। রাত তিনটে নাগাদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমস্ত ইউনিট রেডিও বন্ধ করে দিয়ে নিজের নিজের মিশনে এগিয়ে যায়। ততক্ষনে পাকিস্তানের ১০৭ ইউনিট ভারতীয় সেনাবাহিনীর আসার খবর পেয়ে গিয়েছিল। তীব্র ঠান্ডায় ও প্রচন্ড কুয়াশার সামনে এগোতে শুরু করে মেজর নারায়ন ও ট্যাঙ্ক বাহিনী। হঠাৎই সকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি দলের মুখোমুখি হয়ে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল। দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তান সেনার সংখ্যা বেশী হলেও ভারতীয় সেনারা অসাধারন দক্ষতায় লড়াই করে। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চৌগাছাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। কর্নেল আর কে সিং এর নির্দেশে চার্লি কোম্পানি পীতাম্বরপুর রেলওয়ে ট্রাকের পূর্ন নিয়ন্ত্রন নিয়ে ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে সাহায্যের জন্য এগোয়। কিন্তু চার্লি কোম্পানি খবর পায় এক কিলোমিটারের মধ্যে বিশাল পাকিস্তানি সেনা রয়েছে। ফলে চার্লি কোম্পানি রাস্তা বদলে দক্ষিনের দিক দিয়ে যাত্রা শুরু করে। কিন্তু সেখানেও পাঁচশো মিটার দূরে প্রায় চারগুন সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা ট্যাঙ্ক উপস্থিত ছিল। চার্লি কোম্পানি যুদ্ধের জন্য প্রস্ততই ছিল। কিন্তু হঠাৎই ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সুবেদার মালকিয়াত সিং তার দল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয় এবং আক্রমন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর। হঠাৎ আক্রমনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বহু সেনা মারা যায় এবং যুদ্ধে সুবেদার মালকিয়াত সিং বীরগতি প্রাপ্ত হয়। তাঁর এই অসাধারন বীরত্বের জন্য তাঁকে মহাবীর চক্র সম্মানে সম্মানিত করা হয়। এরপর পাকিস্তান সেনা ডেল্টা দলের উপর আক্রমন শুরু করে। কিন্ত ডেল্টা সেনাবাহিনীর কাছে পরাজিত হয় পাকিস্তান সেনা এবং পাকিস্তানের দুটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়ে যায়। সকাল ৯ঃ২৫ নাগাদ সম্পূর্ন গরীবপুর ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। মুক্তিবাহিনী এবং সাধারন গ্রামবাসী এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানের কাছে ছিল ১৪ টি এমটুফোর চ্যাফে ট্যাঙ্ক এবং ২,৭০০ থেকে ৩,৬০০ সেনা৷ অন্যদিকে ভারতের ছিল ১৪ টি পিটি ৭৬ ট্যাঙ্ক এবং ৯০০ থেকে ১২০০ সেনা। অর্থাৎ প্রায় তিনগুন বেশী সেনা থাকা সত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরাজিত হয়। যুদ্ধে ছয়টি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়, চারটি ট্যাঙ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং তিনটি ট্যাঙ্ক ভারতীয় সেনাবাহিনী দখল করে। প্রায় ৩০০ পাকিস্তানি সেনা মারা যায় ও আহত হয়। অন্যদিকে ভারতের চারটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়। ২৮ জন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয় এবং ৪২ জন আহত হয়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এয়ার সাপোর্ট এর দরকার হয়ে পড়ে যার জন্য ঢাকা থেকে ২২ নভেম্বর সকাল ৯ঃ৪৫ এ পাকিস্তান বায়ুসেনার তিনটি এফ ৮৬ স্যেবার যুদ্ধবিমান গরীবপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয় এবং গরীবপুরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন করে যাতে ভারতের একটি পিটি ৭৬ ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়ে যায় এবং বেশ কিছু সেনা আহত হয়। পাকিস্তান বায়ুসেনা মোট ১৬ টি স্যেবার যুদ্ধবিমানকে তৈরি করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আক্রমনের জন্য। দুই দফায় আটটি স্যেবার জেট ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন করে। এরপর দুপুর ২ঃ৪৮ নাগাদ আরও তিনটি স্যেবার জেট বোয়রাতে প্রবেশ করে। ভারতের রেডার এই তিনটি যুদ্ধবিমানকে চিহ্নিত করে এবং ঠিক তিন মিনিটের মধ্যে দমদম থেকে ভারতীয় বায়ুসেনার চারটি গ্যানাট যুদ্ধবিমান রওনা দেয় এবং বোয়রাতে প্রবেশ করে। ভারতীয় চারটি বিমান দুটি দুটি করে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পাকিস্তানের স্যেবার জেটের সাথে সরাসরি আকাশ যুদ্ধে দুটি স্যেবার জেট ধ্বংস হয়ে যায়৷ বিমানদুটির পাইলট ইজেক্ট করে প্রানে বাঁচে। মজার ব্যাপার হল ইজেক্ট করা পাইলটদের মধ্যে একজন হল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ নং স্কোয়াড্রনের লিডার পারভেজ মেহেদি কুরেশি যার উপর ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর আক্রমনের পুরো দায়িত্ব ছিল। পারভেজ মেহেদি কুরেশি পরে পাকিস্তান বায়ুসেনার প্রধান হয়েছিল। তৃতীয় স্যেবার জেটটাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় কিন্তু পাইলট কোনওরকমে বেসে নিয়ে ফিরে যায়। পারভেজ মেহেদি কুরেশি প্যারাসুটে গিয়ে পড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চতুর্থ শিখ রেজিমেন্টের কাছে। সাথে সাথে তাকে যুদ্ধবন্দি করা হয়। এরপরের দিন অর্থাৎ ২৩ নভেম্বর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা জারি করে এবং জানায় আগামী দশ দিনের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পরিপূর্ন লড়াই হবে। এরপরে যা হয় তা ইতিহাস। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামনে পুরোদস্তুর পরাজিত হয় পাকিস্তান সেনা। ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পন করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে এবং পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন হয়।
