কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে নিউক্লিয়ার ফিশন। বিজ্ঞান জগতে মহিলাদের ৫ টি অবদান অনস্বীকার্য
কালের পরিবর্তনের সাথে যুগ যতই সভ্য হয়ে উঠুক না কেন নারীরা সর্বত্রই অবহেলিত। পৃথিবীর সমস্ত সম্মান এবং ক্ষমতা যেন পুরুষদের হাতেই বন্দি রয়ে গেছে। বর্তমান যুগটা হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। তবে যাই আবিষ্কার হোক না কেন প্রচুর মানুষের একটাই ধারণা থাকে যে পুরুষের হাতেই সেটি আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞান জগতে মহিলাদের অবদান অনস্বীকার্য নয়। প্রাচীন যুগ থেকে বর্তমান পর্যন্ত মহিলারা আবিষ্কার করেছে এমন পাঁচটি জিনিস যা বৈজ্ঞানিক জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মহিলাদের মাধ্যমে তৈরি এই পাঁচটি আবিষ্কার নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
I) ডিএনএ ডাবল-হেলিক্স স্ট্রাকচার (রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন) :- রসায়নবিদ্যায় আলোড়ন তৈরি করেছিলেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। জানা যায় ১৯৫১ সালে কিংস কলেজে তার গবেষণার অংশ হিসাবে এক্সরে ছবি তোলা শুরু করেছিলেন। তবে ফ্রাঙ্কলিনের পুরুষ বন্ধু এক বৈজ্ঞানিক বক্তৃতায় তার অনুমতি না নিয়ে ডাবল হেলিক্সের উপরে কাজ করেছিলেন এবং ফ্রাঙ্কলিনের অনুমতি ছাড়াই তার ফটোগ্রাফিক আবিষ্কারটি ব্যবহার করেছিলেন ফ্রান্সিস এইচ.সি. ক্রিক এর সাথে। ডিএনএ তত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য।
পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীতে ডাবল হেলিক্স তত্ত্বটি ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। কারণ এই তথ্যটির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মানব শরীরের ডিএনএ সম্পর্কে অনেক ধারণা পেয়েছিলেন। এমনকি ১৯৫৩ সালে একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল এই থিওরিটি। যেহেতু বিজ্ঞান জগতে এই তথ্যটি অনবদ্য ভুমিকা রেখেছিল তাই ১৯৬২ সাল নাগাদ এই তথ্যটির আবিষ্কারক হিসেবে ওয়াটসন এবং ক্রিককে নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছিল। ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হয়েছিল ফ্রাঙ্কলিনের। সেক্ষেত্রে ডাবল হেলিক্স তত্ত্বের মূল আবিষ্কারক কোন সম্মান না পেয়েই অন্ধকারে রয়ে গিয়েছেন।
II)কম্পিউটার প্রোগ্রামিং (অ্যাডা লাভলেস) :- ইংরেজি রোমান্টিক যুগের সাহিত্যিক তথা কবি লর্ড বায়রন ও তার স্ত্রী লেডি বায়রনের কন্যা ছিলেন অ্যাডা লাভলেস। স্বামী সাহিত্যচর্চায় এতটাই মগ্ন থাকতেন যে লেডি বায়রনের এক সময় ভয় হয়ে গিয়েছিল তার কন্যাও বাবার মত পাগলাটে না হয়। তাই কন্যাকে সাহিত্যের দিক থেকে সরাতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভাবক চার্লস ব্যাবেজের সঙ্গে অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন’ এ সহযোগিতা করতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লেডি বায়রন। সেই সময় লাভলেসের বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। এই ‘অ্যানালিটিকাল ইঞ্জিন’ ছিল কম্পিউটারের প্রাথমিক মডেল তৈরি করার একটি পদ্ধতি। আর সেই সময় তিনি একটি কম্পিউটারে নোট যুক্ত করেছিলেন, যার মাধ্যমে শুধুমাত্র সংখ্যা নয় অক্ষর দিয়েও মানুষ কাজ করতে পারবে। তখনকার দিনের ভাষায় কম্পিউটারের এই নোটগুলিকে বর্তমান যুগে অ্যালগারিদম বা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং বলে। তবে আজকের বৈজ্ঞানিকদের মতে ব্যাবেজের স্মৃতি কোথাও সেভাবে লাভলেসের কথা উল্লেখ না থাকার কারণে কম্পিউটার জগতে তার অবদান খুব একটা উল্লেখ করা হয় না। তবে দীর্ঘ কয়েক বছর পর অর্থাৎ ২০১১ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং ওপেন-সোর্স প্রযুক্তিতে মহিলাদের প্রচারে সহায়তা করার জন্য ‘অ্যাডা ইনিশিয়েটিভ’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল লাভলেসকে স্মরণ করে।
III) মনোপলি (এলিজাবেথ ম্যাগি ফিলিপস) :- তখনকার দিনে পুরুষেরা একচেটিয়া গেম খেলার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। পুরুষদের একচেটিয়া প্রতিবাদ রুখতে এলিজাবেথ ম্যাগি ফিলিপস তৈরি করেছিলেন দ্য ল্যান্ডলর্ডস গেম’ নামক আসল বোর্ড গেমটি। ম্যাগি ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ। পাশাপাশি তিনি রাজা হেনরি জর্জের অ্যাকোলাইটও ছিলেন। সুতরাং রাজার জমি দখল অর্থনীতি পদ্ধতি হওয়ার পর অর্থনৈতিক প্রতিবাদ হিসেবে তিনি এই গেমটি আবিষ্কার করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯০৩ সালের ফিলিপ এইদিকে পেটেন্ট দাখিল করেছিলেন। তবে পরবর্তীতে যখন গেমটি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে এবং দেশ-বিদেশে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পরে তখন চার্লস ডুরো গেমটিতে কিছু নতুন সংস্করণ করে নিজের নামে কপিরাইট করেছিলেন। পরবর্তীতে ম্যাগির আবিষ্কৃত এই গেমটি পার্কার ব্রাদার্সের কাছে মোটা টাকায় বিক্রি করে নিজের নাম অর্জন করেছিলেন চার্লস ডুরো। যার কারণে বর্তমানে ইতিহাসে হারিয়ে গিয়েছে এই গেমের আসল সৃষ্টিকর্তার নাম।
IV) নিউক্লিয়ার ফিশন (লিজ মেইটনার) :- লিস মেইটনার ছিলেন জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদে প্রথম মহিলা। অস্ট্রিয়ান-সুইডিশ পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন এবং তার গুরু ছিল ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের। তবে দুর্ভাগ্যবশত শিক্ষা জগতে উঁচু পদে থাকলেও তিনি ছিলেন ইহুদি। তাই নাৎসি বাহিনী জার্মান দখল করতেই জার্মান থেকে পালাতে হয়েছিল মেইটনারকে। পরবর্তীতে জার্মান ছেড়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় চলে আসার পর আনুমানিক ১৯৩৮ সালে পারমাণবিক বিভাজনের রূপরেখা তৈরি করার জন্য তিনি অটো হ্যানের অংশীদারিত্ব নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন। মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই তাদের গবেষণার মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিল ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক বোমা। বিজ্ঞান জগতে এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৪৪ সালে হ্যানইকে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। এছাড়াও তিনি ছিলেন প্রথম, যাকে রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস থেকে রসায়নে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। পরবর্তীতে তার মহিলা সঙ্গী মেইটনারকে সম্মানিত করা হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। এমনকি মেইটনারের নাম অনুযায়ী রসায়নের সারিতে একটি মৌলের নামকরণ পর্যন্ত করা হয়েছিল। সেই মৌলটির নাম হল মেইটনেরিয়াম।
V) রেডিও গাইডেন্স সিস্টেম (হেডি লামার) :-অনেকেই ধারণা করেন যে সমস্ত নারীরা দেখতে সুন্দরী হয় তারা একটু বোকা ধরনের হয়। তবে সেই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত করেছিলেন হেডি লামার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে তিনি একমাত্র মহিলা ছিলেন যাকে সকলে বিউটি উইথ ব্রেন হিসাবে চিনতেন। ১৯৪২ সাল নাগাদ হেডি লামার এবং অ্যান্থিয়েল রেডিও গাইডেন্স সিস্টেম সম্পর্কে একটি নতুন বার্তা দিয়েছিলেন। তবে মার্কিন নৌবাহিনী প্রযুক্তিটি ব্যবহার করার জন্য সম্মতি জানাননি প্রথমে। পরবর্তীতে ১৯৬২ সাল নাগাদ কিউবার মিসাইল সংকট দেখা দিলে তখন সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিটি সফলতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছিল। যদিও তারই আবিষ্কারের জন্য তিনি সম্মান পেয়েছিলেন তার একদম শেষের জীবনে।
১৯৯৭ সালে ইলেক্ট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন আধুনিক বার্তা আদান-প্রদানের এই প্রযুক্তি আবিষ্কার করার জন্য পাওনিয়ার’ ও ‘বাল্বি ন্যাস স্পিরিট অফ অ্যাচিভমেন্ট’ ব্রোঞ্জ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। তিনি সেই সময় হলিউডের সবথেকে সুন্দরী মহিলা হয়েও শুধুমাত্র নায়িকা হয়ে থেকে যাননি। তার অনবদ্য ভুমিকা রয়ে গেছে বিজ্ঞান জগতেও। নায়িকা হেডি লামারের যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য জিপিএস, ব্লুটুথ, ওয়াইফাই প্রযুক্তি অনেক সমৃদ্ধ হয়েছে। যদিও তারা অনস্বীকার্য কৃতিত্বের জন্য তার মৃত্যুর পর অর্থাৎ ২০০০ সালে তাকে ‘ন্যাশনাল ইনভেন্টার্স হল অফ ফেম’-এর সদস্য পদ দেওয়া হয়েছিল।