‘গণিত-সম্রাট’ যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী
আমাদের স্কুল জীবনে প্রায় অনেকেই এমন আছে যারা অংকের নাম শুনলেই ভয় পেতো বা এখনো পায়। এরকম অনেক কম সংখ্যক লোকই আছেন যারা স্কুল বা কলেজ জীবনের বাইরে অংক নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করেছেন। তবে, যারা স্কুল-কলেজের সিলেবাসের বাইরেও গণিত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে, তাদের অনেকের কাছেই গণিত সম্রাট যাদব চন্দ্র একটি পরিচিত নাম।
গণিতের ভুবনে এই উপমহাদেশের যিনি এক কিংবদন্তির নাম, সেই পাটিগণিতের সম্রাট যাদব চন্দ্র চক্রবর্তীর কথা আমরা একরকমভাবে ভুলেই গিয়েছি, কারণ তাঁকে নিয়ে তেমন একটা আলোচনা হয় না। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন সিরাজগঞ্জের অনেক স্কুল পড়ুয়া ছাত্র গণিত পরীক্ষার আগে তাঁর বাড়ির মাটিকে সম্মান করে পরীক্ষা দিতে যেত। এমনকি ব্রিটিশরাও তাঁকে ভক্তিভরে সম্মান করতো। যার ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘গণিত-সম্রাট’ উপাধি দেয়।
চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক কে এই যাদব চন্দ্র?
তিনি মূলত কাজ করেছেন পাটিগণিত নিয়ে। ‘Arithmetic’ তাঁর লেখা একটি বিখ্যাত বই যেটিতে তিনি পাটিগণিতের বিভিন্ন শাখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি ‘Algebra’ নামক একটি বীজগণিতের বইও রচনা করেছিলেন। উপমহাদেশের মাধ্যমিক লেভেলের পাঠ্যসূচি অনেকাংশেই এই দুটি বইয়ের অবদান। ওনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। জীবনের বেশিরভাগ সময়ই গণিত চর্চা করে কাটিয়ে দিয়েছেন, লেখেননি কোনো আত্মজীবনী।
জন্ম ও ছেলেবেলা:
বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে কয়েক মাইল দক্ষিণে কামারখন্দ উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামে ১৮৫৫ সালে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যাদব চন্দ্র। পিতা কৃষ্ণচন্দ্র চক্রবর্তী ছিলেন একজন পুরোহিত এবং মাতার নাম দুর্গারাণী চক্রবর্তী। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবা পুরোহিতের কাজ করে যা পেতেন তাতে সংসার ঠিকমত চলতো না। প্রায় দিনই অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটতে থাকত। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে নেমে আসে চরম দুর্দশা। বলতে গেলে চরম দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে কেটে যায় যাদব চন্দ্রের ছেলেবেলা।
শিক্ষাজীবন:
যাদব চন্দ্রের লেখাপড়ার হাতেখড়ি গ্রামের একটি পাঠশালা থেকেই হয়েছিল। তারপর তিনি তেতুলিয়া প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। পরিবারে অভাব-অনটন থাকলেও লেখাপড়ায় তাঁর গভীর মনোযোগ ছিল। প্রাথমিকে অধ্যয়নকালেই তার গণিতের প্রতিভা বিকশিত হতে থাকে। এমনকি শিক্ষকগণ যেসব অঙ্কের সমাধান দিতে হিমশিম খেতেন, তা তিনি অনায়াসেই করে ফেলতেন। স্কুলের শিক্ষকগণ যাদবের অসম্ভব মেধা লক্ষ্য করে তাঁর লেখাপড়া চালানোর প্রতি আরো যত্নবান হয়ে ওঠেন।
১৮৭৬ সালে ২১ বছর বয়সে মাসিক ১৫ টাকা বৃত্তি সহ প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর চলে যান কলকাতায় এবং ভর্তি হন জেনারেল এসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশনে (বর্তমানে স্কটিশ চার্চ কলেজ)। কলেজ জীবনে টিউশনি করে পড়াশোনার খরচ চালাতেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ হতেই যাদব চন্দ্র ১৮৭৮ সালে এফ.এ. এবং ১৮৮০ সালে বি.এ. পাশ করেন। তারপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে এম.এ. ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৮৮২ সালে এম.এ. পাশ করেন।
কর্মজীবন:
বিদ্যানুরাগী যাদব চন্দ্র চক্রবর্তী কর্মক্ষেত্র হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালীন তিনি ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজে বি.এ. ক্লাসে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন পড়াতেন। পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা সিটি কলেজে গণিতের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। প্রায় ছয় বছর শিক্ষকতা করেন সেখানে। এরপর ১৮৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। কর্মজীবনের সবচেয়ে বড় সময় এখানেই কাটান তিনি। এই সময়েই তার গণিত বিষয়ক বইগুলো প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ২৮ বছর আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে ১৯১৬ সালে অবসর নেন।
রচিত গ্রন্থ:
গণিতে শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি অনেকগুলো বই রচনা করেন। সেসবের মধ্যে সেরা গ্রন্থ হলো ‘পাটিগণিত’ যা তিনি মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য লিখেছিলেন। কলকাতা সিটি কলেজে অধ্যাপনার সময় তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীদের জন্য পাটিগণিতের বই লেখায় ব্রতী হন। ১৮৯০ সালে ইংরেজি ভাষায় ‘Arithmetic’ নামে বইটি প্রকাশিত হয়। পরে এই বই বাংলা, হিন্দি, উর্দু, অসমীয়া, মারাঠি, তামিল ও নেপালি ভাষায় অনূদিত হয়। সে সময় বইটি দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্য ছিল। তিনি সপ্তম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠ্যসূচি সেখানে অনুসরণ করেছিলেন।
বইটিতে মোট ৬৬টি অধ্যায় রয়েছে। অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে অঙ্কপাতন, ব্যাবকলন, গুণন, মুদ্রা বিভাগ ও লঘূকরণ, জটিল ভগ্নাংশ, আবৃত্ত দশমিক ম্যাট্রিক, পূর্ণ সংখ্যার বর্গমূল, ভগ্নাংশের বর্গমূল, কমিশন, দালালি ইত্যাদি। এদের অনেকগুলো বিষয়ই এখন আমাদের পাঠ্যসূচি থেকে লোপ পেয়েছে। ১৯১২ সালে তার বীজগণিত বইটি প্রকাশিত হয়। এটি ছাড়াও নিম্নশ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের জন্য তিনি কয়েকটি বই প্রকাশ করেন।
শেষ জীবন ও জীবনাবসান:
১৯০১ সালে তিনি দেশে ফিরে সিরাজগঞ্জের ধানবান্ধিতে বাড়ি তৈরি করেন এবং ছেলে মেয়েদের এখানে রেখেই পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। এ সময় তিনি স্থানীয় শিশুদের জন্য একটি স্কুল নির্মাণেও কাজ করেন। ১৯১৬ সালে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর ফিরে আসেন এবং সিরাজগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি সিরাজগঞ্জ নাট্যভবন প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে পৌর ভাসানী মিলনায়তন নামে পরিচিত। গ্রামের বাড়ি তেতুলিয়ায় একটি পাকা মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন তিনি।
১৯২০ সালের ২৬ নভেম্বর কলকাতায় নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।