অফবিট

হত্যাকারী, নিষ্ঠুর কমিউনিস্ট নেতা! নিষ্ঠুর কমিউনিস্ট শাসক চে গুয়েভারার অজানা দিক

কমিউনিজম বা সাম্যবাদ তৈরি হয়েছিল একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য। কমিউনিজম সাধারন মানুষকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল এমন একটি সমাজ সম্পর্কে যেখানে কোনও শোষিত নিপিড়ীত মানুষ থাকবেনা, সর্বস্তরের মানুষে সমান হয়ে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে যখন কমিউনিস্ট সরকার যখন বিভিন্ন দেশে ক্ষমতায় আসে তখন সম্পূর্ন বিপরীতধর্মী চিত্র লক্ষ্য করা যায়। পুঁজিবাদকে সরিয়ে যেসব দেশে কমিউনিস্ট সরকার গঠন হয় সেখানকার মানুষদের অবস্থা পূর্বের তুলনায় আরও খারাপ হয়ে যায়। কমিউনিস্ট সরকারে দেশগুলোর জনগনের ব্যক্তি স্বাধীনতা নষ্টই হয়ে যায়, কয়েক বছরের মধ্যে দেশ গুলো সীমাহীন দারিদ্র্যতার কবলে পড়ে। উপরন্তু মাও জে ডং, জোসেফ স্তালিন, ফিদেল কাস্ত্রোর মতোন নিষ্ঠুর কমিউনিস্ট শাসকদের কারনে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এরকমই একজন অদক্ষ কমিউনিস্ট শাসক হচ্ছে চে গুয়েভারা। আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরে জন্মানো আর্নেস্তো গুয়েভারা বা চে গুয়েভারা বামপন্থী সংগঠন গুলোর কাছে এক আদর্শের নাম। 

কার্ল মার্ক্সের আদর্শে বিশ্বাসী চে গুয়েভারা চীনের ক্রুড় শাসক মও জেডংকেও অনুসরন করতো। ফিদেল কাস্ত্রোর সাথে যৌথভাবে কিউবাতে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করে চে গুয়েভারা। তারপরেই রীতিমতো নায়ক হিসাবে তার নাম বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফিদেল কাস্ত্রো চে গুয়েভারাকে কিউবার নাগরিকত্ব দেয়। সেসময় কিউবা সহ কমিউনিস্ট দেশগুলোতে চে গুয়েভারা রীতিমতো স্বপ্নের নায়ক ছিল। আজও বহু মানুষ তাদের টিশার্টে চে গুয়েভারার ছবি ব্যবহার করে বিদ্রোহের প্রতীক হিসাবে। কিন্তু বামপন্থী মানুষগুলোর নায়ক চে গুয়েভারা বাস্তবে একজন ক্রুর শাসক ছিল। আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএ চে গুয়েভারাকে নিষ্ঠুর কমিউনিস্ট বলেছে। 

যেকোনও সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষকের কাছে চে গুয়েভারা একজন হত্যাকারী, নিষ্ঠুর কমিউনিস্ট নেতা কিন্তু মার্ক্সবাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত, মগজ ধোলাই হওয়া ব্যক্তিদের কাছে চে গুয়েভারা একজন মহান নায়ক,  বিপ্লবের প্রতীক। আসলে বিশ্বের ইতিহাসে বাকী সমস্ত অত্যাচারী কমিউনিস্ট শাসকদের মতো চে গুয়েভারাও ভিন্ন ছিলনা। শুধুমাত্র বামপন্থী সংগঠনগুলো এরকম অত্যাচারী ব্যক্তিকে মহান বিপ্লবী হিসাবে জনসমাজে উপস্থাপন করেছে। 

আর্নেস্তো চে গুয়েভারার অন্ধকার দিকঃ——

১) চে গুয়েভারা সম্পর্কে বলা হয় সে একজন বর্নবাদী ছিল, চে মনে করতো যে কালো মানুষগুলি নিকৃষ্ট। চে গুয়েভারা এটাও মনে করতো যে সমকামীদের হত্যা করা উচিত। চে তার জীবনে বহুমানুষকে হত্যাও করেছে। 

২) ১৯৫৯ সালে ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবাতে কমিউনিস্ট বিপ্লবের সময় চে গুয়েভারা সহ বিপ্লবীরা সিয়েরা মায়েস্ত্রো পাহাড়ে লুকিয়ে সরকার বিরোধী কাজকর্ম করতো। এখানে চে সরকারপন্থী অনেক মানুষকে নির্মম ভাবে হত্যা করে এবং এটা সে উপভোগ করতো রীতিমতো। একটি সাক্ষাৎকারে চে গুয়েভারা সিয়েরা মায়েস্ত্রো পাহাড়ে এক ব্যাক্তিকে. ৩২ ক্যালিবারের পিস্তল দিয়ে হত্যা করার কথা নিজেই বর্ননা করেছে। 

৩) কিউবাতে ফিদেল কাস্ত্রো ক্ষমতা দখলের পরেই হাভানা শহরের একটি দুর্গ লা কবানা এবং সেন ছাঁউনিগুলো সাময়িকভাবে জেলে পরিনত করা হয়েছিল যার দায়িত্বে ছিল চে গুয়েভারা। এখানে পূর্ববর্তী বাতিস্তা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের এবং সরকার বিরোধীদের বন্দী করে রাখা হত। এসব জেলে একতরফা বিচারের মাধ্যমে চে গুয়েভারা গনহত্যা করে রীতিমতো। ঐতিহাসিকদের মতে এখানে কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে চে গুয়েভারা নিজের হাতে এখানে বন্দীদের হত্যা করতো। 

৪) সব কমিউনিস্ট বিপ্লবেই একটি বিশেষ ধরন লক্ষ্য করা যায় তাহল সমাজের উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করা। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবার মতো সমস্ত কমিউনিস্ট দেশেই ক্ষমতা দখলের নামে কমিউনিস্টরা সামরিক অফিসার, ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারদের হত্যা করেছে। চে গুয়েভারাও তার ব্যতিক্রম ছিলনা। সমস্ত কমিউনিস্ট নেতাদের মতোই চে গুয়েভারাও মনে করতো দেশের কলকারখানা, জমির মতো জিনিসে সরকারের নিয়ন্ত্রন থাকা দরকার।

৫) ১৯৬২ সালে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ চলাকালীন কিউবাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরমানু মিসাইল রাখাকে কেন্দ্র করে দুইদেশের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা চরমে পৌঁছে যায়, ইতিহাসে এই ঘটনাকে কিউবা মিসাইল সংকট বলা হয়েছে। সেসময় পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে দুইদেশের মধ্যে পরমানু যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি নিকিতা ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে দু’পক্ষের মধ্যে সমস্যা সমাধান করা হয়। এই সমস্যা সমাধানে বাকী বিশ্ব যখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তখন আমেরিকা বিরোধী ফিদেল কাস্ত্রো ও চে গুয়েভারা রীতিমতো হতাশ হয়, তাদের ইচ্ছেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাতে আক্রমন করুক। কিউবার সরকার এইসময় আমেরিকাতে বোমা হামলার চেষ্টা করেছিল। ১৭ নভেম্বর, ১৯৬২ সালে এফবিআই কিউবার দুজন রাষ্ট্রদূত এলসা মন্টেরো এবং হোসে গোমেজ আবাদকে গ্রেফতার করে নিউইয়র্কের ম্যাসিস, গিম্বেল এবং ব্লুমিংডেলের ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এবং গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল টার্মিনালে বোমা হামলার পরিকল্পনার অভিযোগে। এদের কাছে ডজন খানেক অগ্নিসংযোগকারী ডিভাইস এবং বিপুল পরিমান টিএনটি পাওয়া যায়। সেসময় নিউইয়র্ক টাইমসের প্রথম পৃষ্ঠায় এই গ্রেপ্তারের ছবি প্রকাশ করা হয়েছিল। এই বোমা হামলার পরিকল্পনায় ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারা সমেত কিউবা সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। 

৬) যুবক অবস্থার সময় থেকে চে গুয়েভারা তার গৃহ পরিচারিকাদের সাথে নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক করার দাবী করতো। ১৯৫৫ সালে হিলডা গাদিয়া নামে এক মহিলার সাথে থাকা শুরু করে চে। হিলডা প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়লে তাকে বিয়ে করে চে। কিন্তু বিয়ের পরই চে কাস্ত্রোর ডাকে কিউবা চলে যায়। ১৯৫৯ সালে কিউবা দখলের সময় চে তার প্রথম স্ত্রী হিলডাকে ডিভোর্স দিয়ে আলেদা মার্চ নামে এক মহিলাকে বিবাহ করে। দ্বিতীয় স্ত্রী আলেদা মার্চের থেকে চারটি সন্তান ছিল চের। 

৭) কিউবায় বৈপ্লবিক আন্দোলন সফল হওয়ার ফলে ফিদেল কাস্ত্রোর চে গুয়েভারার প্রতি ভরসা ও বিশ্বাস এতটাই বেড়ে যায় যে গুয়েভারাকে কিউবার অনেক অর্থনৈতিক বিভাগের দায়িত্ব দিয়ে দেয় কাস্ত্রো। চে বিভিন্ন সময়ে কিউবার জাতীয় ব্যাঙ্কের প্রধান, কৃষি সংস্কারের দায়িত্বে থাকা শিল্প বিভাগের প্রধান এবং ১৯৬১ সালে শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে। চে গুয়েভারা অত্যন্ত অদক্ষ একজন প্রশাসক ছিল। তার ভুল নীতির কারনে কিউবাতে চিনির উৎপাদন কমে যায়, শিল্পায়ন ব্যাহত হয়। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে একটা সময় ক্যারিবীয় অঞ্চলের সমৃদ্ধশালী দেশ কিউবাতে জনগনকে রেশন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা যায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ভর্তুকির উপর সেসময় কিউবা নির্ভরশীল ছিল। কিউবার অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারনেই চে গুয়েভারা বাধ্য হয়ে ১৯৬৫ সালে কিউবা থেকে অন্য বিভিন্ন দেশে বিপ্লব ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একপ্রকার পালিয়ে যায়। 

১৯৬৫ সালে কিউবা থেকে কঙ্গো চলে যায় চে গুয়েভারা। কিউবার মতো কঙ্গোতেও সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করাই লক্ষ্য ছিল তার। এই উদ্দেশ্যে তাঙ্গানিকা হ্রদের তীরে উপস্থিত হয় চে গুয়েভারা। কিন্ত সাতমাস ধরে কঙ্গোতে কিউবার মতো কোনও সশস্ত্র আন্দোলন করতে ব্যর্থ হয় চে, উপরন্তু নিজে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কঙ্গোতে নিজের পরাজয় স্বীকার করে তানজানিয়া পালিয়ে যায় চে গুয়েভারা। পরবর্তী লক্ষ্য স্থির করার উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালের বেশীরভাগ সময় দার এস সালাম এবং প্যারাগুয়েতে কাটায় চে গুয়েভারা। এই সময়কালে চে গুয়েভারা নিকারাগুয়া, ডোমেনিকান প্রজাতন্ত্র, পানামা এবং হাইতিতেও কিউবার মতো সশস্ত্র বিদ্রোহের মধ্যমে কমিউনিস্ট সরকার গঠনের চেষ্টা করেছিল কিন্ত সে ব্যর্থ হয়। 

১৯৬৬ সালের মে মাসে চে গুয়েভারা ঠিক করে বলিভিয়া তার পরবর্তী লক্ষ্যের জন্য একদম আদর্শ। চে বলিভিয়া যাওয়ার আগে কিউবাতে তার পরিবার ও কাস্ত্রোর সাথে দেখা করবার জন্য ছদ্মবেশে এসেছিল একবার। বলিভিয়ার গহীন অরন্যে একটি গেরিলা দল গঠন করে চে গুয়েভারা, কিউবা থেকেও কিছু যোদ্ধা নিয়ে এসেছিল চে। তবে চে গুয়েভারা জানতোনা বলিভিয়া সরকার তার বিরুদ্ধে আগে থেকেই প্রস্তত আছে। কিউবার অবস্থা দেখে বলিভিয়ার সেনাবাহিনীকে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রশিক্ষন দিতে আমেরিকা আগেই সিআইএ এবং স্পেশাল ফোর্সের সদস্যদের বলিভিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিল। চে গুয়েভারা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি বলিভিয়ার মতো গরীব দেশ আমেরিকার সহযোগিতা পাচ্ছে। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর বলিভিয়ার হিগুয়েরা গ্রামের কাছে আমেরিকার স্পেশাল ফোর্স গ্রেফতার করে চে গুয়েভারাকে এবং পরেরদিনই তাকে গুলিকরে হত্যা করা হয়। চে গুয়েভারাকে গুপ্তস্থানে কবর দেওয়া হয়েছিল। ত্রিশ বছর পর ১৯৯৭ সালে চে গুয়েভারার কবর খুজে বের করে কিউবা নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সহিত দ্বিতীয়বার সমাধিস্থ করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *