অফবিট

মহাভারতের সাথে কেন বর্তমান পরিস্থিতির তুলনা করছে পৃথিবীর অন্যতম বিদেশমন্ত্রী ডঃ এস জয়শংকর?

ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকর কে এই মহূর্তে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদেশমন্ত্রী বলা হয়। সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারের কারনে তিনি ভাইরাল হয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন তাঁর কাছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কুটনীতিবিদ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ভগবান হনুমানজী। তিনি হনুমানজীর লঙ্কা অভিযানের উদাহারনও দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, যদি অন্য কোনও ভারতীয়কে জিজ্ঞেস করা হয় বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কুটনৈতিক বইয়ের কথা, তাহলে বেশীরভাগই ম্যাকিয়েভেলির দি প্রিন্সের উদাহারন দেবে কিন্ত তাঁর মতে মহাভারত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কুটনৈতিক বই যাতে বর্তমান বিশ্বের বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো ব্যাখা রয়েছে। বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে একাধিক শক্তি রয়েছে, যাদের বেশীরভাগই পরস্পরের বিরোধী। যার কারনে শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখা খুবই সমস্যার এখন। বর্তমান বিশ্বের পরিস্থিতির সাথে ভারতের মহাভারতের সময়ের সাথে মিল রয়েছে। বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক সংকট ঠিক যেন মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের ময়দান। পশ্চিমি কুটনীতিকে যেমন ম্যাকিয়াভেলির দি প্রিন্স এবং চীনের কুটনীতিকে থ্রি কিংডমসের মাধ্যমে জানা যায় ঠিক তেমনি ভারতের কথা বললেই প্রথমেই মহাভারতের কথা আসে। ডঃ এস জয়শংকরের দি ইন্ডিয়া ওয়ে বইয়ের একটি বিভাগ কৃষ্ণাস চয়েসে মহাভারতের সাথে বর্তমান পরিস্থিতির মেলবন্ধন তুলে ধরেছেন তিনি।

২৮ জানুয়ারি, ২০২৩, পুনেতে এস জয়শংকরের বই দি ইন্ডিয়া ওয়ে স্ট্রাটেজিস ফর এন আনশার্টেন ওয়ার্ল্ডের মারাঠি সংস্করন ভারত মার্গ প্রকাশিত হয়। এই অনুষ্ঠানে তিনি দ্রুত পরিবর্তিত হওয়া বিশ্বরাজনীতিতে ভারতের বৈদেশিক নীতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ভারতের বিদেশনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ। বেশীরভাগ দেশরই বৈদেশিক নীতি দেশটির কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনেই থাকে। ভারতের মতো বিশাল দেশের বিদেশ নীতি শুধু দেশটির রাজধানী কেন্দ্রিক হয়না। এস জয়শংকর জানান যদি উত্তর ভারতের কোন ব্যাক্তিকে প্রাচীন ভারতীয় নৌবাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে সে হয়ত ততটা নাও জানতে পারে। কিন্তু এই একই প্রশ্ন যদি ভারতের দক্ষিন উপকূলের কোন রাজ্যবাসীকে করা হয় সে গৌরবের সাথে ভারতীয় নৌবাহিনী সম্পর্কে জানাবে। অর্থাৎ ভারতের বিদেশনীতি তৈরির ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি রাজ্যের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা আছে। এস জয়শংকরের মতে বিদেশনীতি শুধু দেশের সীমান্ত থেকে শুরু হয়না বরং আমাদের সবার ঘর থেকেই শুরু হয় এবং ঘরে এসেই শেষ হয়। এর জন্য তিনি কোভিড ১৯ মহামারী ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের উদাহারন দিয়েছেন, এই দুটি ঘটনাই ভারতের বাইরে তৈরি হয়েছে কিন্তু এর প্রভাব আমাদের সবার উপরেই পড়েছে। 

ভারতের বৈদেশিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে বিশ্বায়ন। বিগত কয়েক বছরে পশ্চিমা বিশ্বের বানিজ্যের একটি বড় অংশ চীনের উপর নির্ভর ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ এর ফলে বড় ধাক্কা খেয়েছে চীন। সেজন্য পশ্চিমাবিশ্ব চীন+১ নীতি নিয়েছে, এটাই ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় সুযোগ। এর জন্য ভারতকে তার নিজস্ব উৎপাদন ক্ষমতা, শিল্প, কৃষি, প্রযুক্তি, ম্যানেজমেন্ট এবং জনবলকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করতে হবে। এস জয়শংকর ভারতের উন্নতির মাপকাঠিকে ছয়টি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমে রয়েছে আত্মনির্ভরতা বা মেক ইন ইন্ডিয়া। কোভিশিল্ড, কোভ্যাক্সিন এর মতোন করোনা ভ্যাকসিনের ভারতে ব্যাপক উৎপাদন, আইফোনের উৎপাদন ভারতে হওয়া এবং ভারতীয় অস্ত্রে বিদেশী দেশ গুলোর আগ্রহ প্রমান করছে ভারত কত দ্রুত আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠছে। দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। কোন দেশকে বিশ্বগুরু হয়ে উঠতে গেলে তাকে সব দেশের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, তবেই সেই দেশ সুপার পাওয়ার হয়ে উঠবে।

বর্তমানে ভারত শুধু দেশের মানুষই নয় বরং বিদেশেও যেকোন পরিস্থিতিতে সাহায্য করছে। যেমন করোনা মহামারীর সময়ে উহানে যাওয়া ভারতীয় বিমান ভারতীয়দের পাশাপাশি বিদেশীদেরও উদ্ধার করে। তুরস্কের ভূমিকম্পের উদ্ধার কার্যেও ভারত সহায়তা করেছে। বসুধাইবা কুটম্বকম ও জনকল্যান ভারতের মূল লক্ষ্য। এভাবে এই বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে এস জয়শংকর ভারতের বিদেশনীতি সম্পর্কে কিছু বক্তব্য বলেন কিন্ত যে কথাটা সবচেয়ে বেশী আলোচিত হচ্ছে তা হল মহাভারত নীতি।

ডঃ এস জয়শংকরের বই দি ইন্ডিয়া ওয়ের তৃতীয় বিভাগের নাম কৃষ্ণাস চয়েস, দি স্ট্রাটেজিক কালচার অফ এ রাইজিং পাওয়ার এর শুরুতে লেখা আছে যে জাতি তার অতীতকে সম্মান করেনা তার কোন ভবিষ্যত নেই। ডঃ জয়শংকর তার নীতি তৈরিতে ইতিহাসের উপর যথেষ্ট জোর দেন। তিনি মনে করেন ভারতের ইতিহাসে এমন কিছুু ভূল পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে যার ফল এখনও ভোগ করতে হচ্ছে যার জন্য তার লেখা এই বিভাগ বর্তমান ভারতকে অতীত ভারতের সাথে যুক্ত করে। এখানে তিনি জানিয়েছেন বর্তমান সময়ের মতো মহাভারত কালীন সময়েও ভারতে একাধিক শক্তিশালী রাজত্ব ছিল যারা বিভিন্ন পক্ষে বিভক্ত ছিল। বলরাম ও রুক্মার মতোন কিছু রাজা ছিল যারা কোন পক্ষেই ছিলনা। বর্তমান বিশ্বে অনেক দেশ বিদেশ নীতি সম্পর্কে অনেক সিদ্ধান্ত নেবার আগেই পরিস্থিতির চাপে পড়ে চুপ করে যায়। মহাভারতেও অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মীয় স্বজনদের দেখে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল। তার মানে এই নয় যে অর্জুনের মধ্যে ক্ষমতার অভাব ছিল, অর্জুন পরিস্থিতির কারনে, সাময়িক কারনে দুঃখিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে অর্জুনের সব কষ্ট চলে গিয়েছিল। ঠিক তেমনি ভারতও তার জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী নিজের শক্তিশালী বৈদেশিক নীতি তৈরি করেছে। মহাভারতে পান্ডবদের তুলনায় কৌরবরা সংখ্যায় বেশী ছিল। কৌরবদের পক্ষে ছিল এগারো অক্ষৌহিনী সেনা, যেখানে পান্ডবদের পক্ষে ছিল সাত অক্ষৌহিনী সেনা। কিন্তু জয় শেষ পর্যন্ত পান্ডবদেরই হয়েছিল। 

ভারতেরও প্রতিবেশী শক্তিশালী শত্রু দেশ চীন হলেও ভারত নিজেও যথেষ্ট শক্তিশালী এবং চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলে ভারতীয় সেনাবাহিনী তার যথেষ্ট সামর্থ্যের পরিচয় দেবে, কারন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইতিহাসে স্বর্নজ্জবল সমস্ত অধ্যায় আছে। ডঃ জয়শংকর মনে করেন অনেক পরিস্থিতিতে সরাসরি যুদ্ধের বদলে কিছুটা সহ্য করতে হয়। যেমন পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদের সাহায্য নিয়ে ভারতের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে ভারত তার জবাব দিচ্ছে কিন্তু ভারত জানে সবসময় সরাসরি যুদ্ধ করা উচিৎ নয়। অতীতে প্রত্যেকবার ভারতের কাছে শোচনীয় পরাজিত হয়েছে পাকিস্তানের, তাই ভারত তার ক্ষমতা সম্পর্কে জানে। 

মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ শিশুপালের একশো অপরাধ ক্ষমা করেছিলেন। তিনি মহাভারত যুদ্ধ থামানোর জন্যও অনেক চেষ্টা করেছিলেন। আসলে যুদ্ধ সবসময় শেষ পদক্ষেপ হয়ে থাকে। কারন যুদ্ধের অর্থই জীবনহানি ও দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হওয়া। অকারনে যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই, যেমন আমেরিকার ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানে এত লাখ লাখ ডলার খরচ করেও তেমন কোন লাভ হয়নি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পান্ডবরা যেমন নিজের অনেক পরিজনদের সাহায্য পায়নি ঠিক তেমনি ভারতেরও প্রধান শত্রু তার দুই প্রতিবেশী চীন ও পাকিস্তান। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন ও দুর্যোধনকে দুটি শর্ত দিয়েছিলেন একপক্ষে তিনি নিরস্ত্র হয়ে থাকবেন অন্যপক্ষে তার শক্তিশালী অপরাজেয় নারায়নি সেনা থাকবে। কিন্তু অর্জুন নিরস্ত্র শ্রীকৃষ্ণকেই বেছে নিয়েছিলেন যেখানে দুর্যোধন শক্তিশালী নারায়নি সেনাকে বেছেছিলেন এরপর বাকিটা ইতিহাস।

ভারতকেও তেমন অস্ত্র ছাড়াও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, উন্নত প্রযুক্তি এবং গবেষনা খাতে আরও খরচ করতে হবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের চোদ্দতম দিনে শ্রীকৃষ্ণ তার সুদর্শন চক্রের দ্বারা সূর্যকেই ঢেকে দিয়েছিলেন। কর্নের রথের চাকা মাটিতে বসে গিয়েছিল, সেই সুযোগে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। গুরু দ্রোনাচার্যকে যুধিষ্টির জানিয়েছিল অশ্বত্থামা মারা গেছে, যে কিনা দ্রোনাচার্যের ছেলে। এই খবর শুনে দ্রোনাচার্য দুঃখিত হয়ে পড়ে এবং এই সুযোগে তাঁকে হত্যা করা হয়। বাস্তবে অশ্বত্থামা নামে একটি হাতিকে মারা হয়েছিল। পিতামহ ভীষ্মকে হত্যা করার জন্য শীখন্ডিকে আনা হয়েছিল। অর্থাৎ মহাভারত আমাদের শেখায় যখন বড় কোন মঙ্গল উদ্দেশ্যে বা শান্তি স্থাপনে কোন কাজ করতে হয় তখন প্রয়োজনে যুদ্ধের নিয়ম বদলানো যায়। তবে বর্তমান বিশ্বরাজনীতে ভারত একটি বড় শক্তিশালী দেশ। শক্তিশালী সামরিক শক্তিশালী দেশ হওয়ার পাশাপাশি ভারত অর্থনৈতিক ভাবে ব্যাপক শক্তিশালী। আগামী দশকে ভারতের ক্ষমতা আরও বৃদ্ধি পাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *