মোদী সরকারের বিদেশনীতির আরও একটি সাফল্যে চীনের বিরুদ্ধে মায়ানমারের সিটওয়ে বন্দরে প্রবেশাধিকার ভরতের
যেদেশের বিদেশনীতি যত শক্তিশালী সেই দেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ততবেশী শক্তিশালী। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকারে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করবার পাশাপাশি কুটনৈতিক স্তরেও ভারতের প্রভাব বিস্তার শুরু করে। যার কারনে বর্তমানে বিশ্বের সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী দেশ হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও ভারতের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে, যার অন্যতম উদাহারন ভারত মায়ানমারের সুসম্পর্ক। বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নিয়ম আছে যে যখন দুটি দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত থাকে তখন থেকেই এটা ভেবে রাখা দরকার যে যদি কখনও কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? কারন অনেকসময় দুটি দেশের মধ্যে রাজনৈতিক কারনে কুটনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেলে তা পুনরায় দৃঢ় হতে অন্তত পনেরো, কুড়ি বছর লেগে যায়। এরকমই একটি ঘটনা হচ্ছে ভারতের মায়ানমারের সিটওয়ে বন্দরে বিনিয়োগ। ভারতের কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টের অংশ এই সিটওয়ে বন্দরে বিনিয়োগ।
কালদান মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশের একটি নদীর নাম। উত্তর-পূর্ব ভারত ভারতের মূল ভূখন্ডের সাথে শিলিগুড়ি করিডরের মাধ্যমে যুক্ত। যদি কলকাতা থেকে মিজোরামে বানিজ্য করতে হয় তবে দুটি পথ আছে শিলিগুড়ি করিডর হয়ে এবং বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সময় অনেকটাই বেশী লাগে। ঠিক এই জন্যই গুরুত্বপূর্ন কালাদান প্রজেক্ট। এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হলে কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পন্য পরিবহনে বর্তমানের তুলনায় অর্ধেক সময় লাগবে এবং বাংলাদেশের প্রতি নির্ভরতাও কমবে। ভারত সরকার আইপিজিএল বা ইন্ডিয়ান পোর্টস গ্লোবাল লিমিটেডকে সিটওয়ে বন্দরের নিয়ন্ত্রনের জন্য অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে। রাখাইন প্রদেশের সিটওয়ে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর, ভারতের কাছেই অবস্থিত হওয়ায় এই বন্দরকে কেন্দ্র করে আশেপাশের সমুদ্রসীমায় ভারতের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পবে। সিটওয়ে বন্দরের ধারন ক্ষমতা ২০,০০০ টন থেকে বৃদ্ধি করে ৪০,০০০ টন করা হয়েছে। গভীর সমুদ্র বন্দর যেকোনও দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ন। যদি কোনও দেশে অথবা দেশটির নিয়ন্ত্রনে গভীর সমুদ্র বন্দর না থাকে, তবে বড় বড় পন্যবাহী জাহাজ দেশটির বন্দরে প্রবেশ করতে না পেরে সমুদ্রেই দাঁড়িয়ে থাকে, সেখান থেকে ছোট জাহাজে করে পন্য নিয়ে আসতে হয়। এর ফলে পন্য পরিবহনে খরচ অনেকটাই বেড়ে যায়। ঠিক এই কারনেই সিটওয়ে বন্দর ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। ভারত ভবিষ্যতে দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক আরও মজবুত করতে চলেছে। এই জন্য সিটওয়ে বন্দরের মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে পন্য পরিবহন আরও সহজ হবে। কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট মায়ানমারের রাখাইন ও চীন দুটি প্রবেশের মধ্যে দিয়ে গেছে, কিন্তু এই দুটি অঞ্চলেই রাজনৈতিক অস্থিরতা রয়েছে যার জন্য ভারতের কালাদান প্রজেক্ট সম্পূর্ন করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
কলকাতা থেকে সিটওয়ে বন্দরের দূরত্ব ৫৩৯ কিলোমিটার, এই পর্যন্ত রাস্তা সম্পূর্ন হয়ে গেছে। কালাদান নদীতে ড্রেজিং এর কাজও সম্পূর্ন হয়ে গেছে অর্থাৎ কালাদান নদীর গভীরতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। সিটওয়ে বন্দর থেকে তিনধাপে সড়ক নির্মান করা হচ্ছে মিজোরাম পর্যন্ত। প্রথম ধাপে সিটওয়ে বন্দর থেকে পালেতওয়া পর্যন্ত ১৫৮ কিলোমিটার, দ্বিতীয়ধাপে পালেতওয়া থেকে কালেতওয়া পর্যন্ত ৬০.৮ কিলোমিটার এবং তৃতীয়ধাপে কালেতওয়া থেকে মিজোরামের জোরিনপুই পর্যন্ত দূরত্ব ৪৯.২ কিলোমিটার রাস্তা নির্মানের কাজ চলছে। পালেতওয়া থেকে কালেতওয়া পর্যন্ত সড়ক নির্মান সম্পূর্ন হয়ে গেছে, বর্তমানে কালেতওয়া থেকে জোরিনপুই পর্যন্ত সড়ক নির্মান চলছে।
মায়ানমার ভারতের খুবই গুরুত্বপূর্ন প্রতিবেশী দেশ। ভারত যে দক্ষিন পূর্ব এশিয়ান দেশগুলোর সাথে বানিজ্যসম্পর্ক মজবুতের চেষ্টা করছে সেই দক্ষিন পূর্ব এশিয়াতে মূলত দশটি দেশ আসে কম্বোডিয়া, ব্রুনাই, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মায়ানমার, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম, এই দেশগুলোকে একত্রে আসিয়ান দেশ বলা হয়। ভারতের সাথে মায়ানমারের সীমানা থাকায় ভারতের জন্য মায়ানমার দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার জন্য প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করে। মায়ানমারে খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল ভান্ডার রয়েছে যা ভারতের শক্তির চাহিদা মেটাতে সক্ষম। চীনের সহায়তায় ভারতের উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোকে একটা সময় অশান্ত করার চেষ্টা করতো উলফার মতোন কিছু সন্ত্রাসী সংগঠন। এই সমস্ত সংগঠনের সদস্যরা মায়ানমারে রীতিমতো তাদের নিরাপদ ঘাঁটি তৈরি করেছিল। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনী মায়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে যৌথভাবে অপারেশনের মাধ্যমে এসব জঙ্গী সংঘটন গুলোর আস্তানা ধ্বংস করেছে। এই জন্য উত্তর-পূর্ব ভারতে শান্তি বজায় রাখতে মায়ানমারকে প্রয়োজন ভারতের।
বাংলাদেশ ভারতের বন্ধু দেশ হলেও বাংলাদেশ চীনের বিআরআই বা বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ, বাংলাদেশে চীনের অনেক বেশী বিনিয়োগ আসছে সুতরাং বাংলাদেশের বিকল্পও প্রয়োজন ভারতের। তাছাড়া সিটওয়ে বন্দরের মাধ্যমে মায়ানমারের সাথেও ভারতের বানিজ্যিক সম্পর্ক দৃঢ় হবে। কিন্ত কালাদান নদীর সাথে পালেতওয়া অঞ্চলে এই প্রজেক্টের সবচেয়ে বড় সমস্যা রোহিঙ্গা সমস্যা, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদকে কেন্দ্র করে আরাকান আর্মি, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির মতোন সংগঠনের সাথে মায়ানমার সেনাবাহিনীর লড়াই চলছে নিয়মিত। গত জানুয়ারি মাসে পালেতওয়া অঞ্চল পুরো দখল করে নিয়েছিল আরাকান আর্মি। তবে মায়ানামার সেনাবাহিনী ওই অঞ্চল পুনরায় তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসেছে। মায়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমনিতেই সংকটজনক, দেশটিতে সেনাবাহিনীর শাসন চলছে। আবার মায়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধেও দেশটির মধ্যে অনেক সংগঠনই অস্ত্র তুলে নিয়েছে। সবমিলিয়ে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে রয়েছে মায়ানমার। পালেতওয়া অঞ্চলে মূলত তিনটি গোষ্ঠী পরস্পরের বিরুদ্ধে রয়েছে আরাকান আর্মি, চীন প্রদেশের চীন সংগঠন এবং মায়ানমার সেনাবাহিনী। তবে আরাকান আর্মি ভারতকে জানিয়েছে তারা কালাদান প্রজেক্টে কোনওরকম বাধা দেবেনা। চীন সংগঠনও পুরো এলাকায় শান্তি স্থাপনে আগ্রহী। ভরত সরকার ১৯৯০ সাল থেকেই মায়ানমারের ক্ষমতায় যেই থাকুক সে গনতান্ত্রিক সরকার হোক কিংবা সেনা সরকার হোক তাদের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। যার জন্য কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্টে এখনও তেমন কোনও সমস্যা হয়নি ভারতের। তবে মায়ানমারে যেমন ভারত বিনিয়োগ করছে ঠিক তেমনি চীনও বিনিয়োগ করছে। দক্ষিন পশ্চিম চীনের উন্নয়নের জন্য মায়ানমার চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ন। এই জন্য ২০১৭ সালেই চীন ময়ানমার চীন অর্থনৈতিক করিডর তৈরি করেছে। মায়ানমারকে ভারত মহাসাগরের মালাক্কা সমস্যার বিকল্প হিসাবে দেখছে চীন। ইন্দোনেশিয়া, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছে মালাক্কা প্রনালী বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্র বানিজ্য পথ। চীনেরও অধিকাংশ বানিজ্য এখান দিয়েই হয়। কিন্তু এখানে চীনের সমস্যা হচ্ছে ভারতীয় নৌবাহিনী। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে ভারতের তিন বাহিনীর কেন্দ্র রয়েছে আবার ইন্দোনেশিয়ার সাবাং বন্দর ভারতীয় নৌবাহিনীর ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যতে ভারত চাইলে মালাক্কা প্রনালী অবরোধ করে দিতে পারে যাতে সমূহ সমস্যায় পড়বে চীন। সেজন্য চীন মায়ানমারকে মালাক্কা প্রনালীর বিকল্প হিসাবে বেছে নিয়েছে, মায়ানমারের কাইউকপিউ বন্দরে চীন দশ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। কাইউকপিউয়ে চীন গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি করছে, শিল্পাঞ্চল তৈরি করছে এবং বাড়ি তৈরি করছে।
কিন্তু এত বিশাল পরিমান অর্থ মায়ানামার যদি পরিশোধ করতে না পারে তাহলে ময়ানামার চীনের ঋনের ফাঁদে পড়ে যাবে এবং শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরের মতোন কাইউকপিউও চীনের অধীনে চলে যেতে পারে। তখন চীন চাইলে এখানে নৌ ঘাঁটিও তৈরি করতে পারবে যা ভারতের জন্য সমস্যার কারন। চীন ইতিমধ্যেই মায়ানামারের কোকো দ্বীপে তাদের রেডার স্থাপন করেছে। মায়ানামারে খনিজ সম্পদ, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস প্রচুর পরিমানে রয়েছে, এর বিনিময়েই চীন এতবেশী অর্থ বিনিয়োগ করছে মায়ানমারে। কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনামেও চীন একই ভাবে বিনিয়োগ করছে। চীন তার দক্ষিন পশ্চিম অংশের কুনমিং প্রদেশ থেকে কাইউকপিউ পর্যন্ত তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন তৈরি করছে মালাক্কা প্রনালীকে এড়িয়ে। সুতরাং চীনকে কাউন্টার করতে এবং মায়ানামারকে চীনের বলয়ে যেতে না দিতে ভারতেরও মায়ানমারে বিনিয়োগ আবশ্যক ছিল। এর পাশাপাশি ভারত মায়ানমারে আরও অনেক প্রজেক্টে যুক্ত আছে। মায়ানমার সরকার ভারতকে সিটওয়ে বন্দরের পূর্ন নিয়ন্ত্রনের অনুমোদন দিয়েছে। সিটওয়ে বন্দরে যে ভারতীয় সংস্থা
আইপিজিএল রয়েছে এই একই সংস্থা ইরানের চাবাহার বন্দরেও রয়েছে। তবে চাবাহার বন্দরের পাঁচটি টার্মিনালের মধ্যে দুটি ভারতের অধীনে রয়েছে এবং তিনটি চীনের অধীনে রয়েছে কিন্তু সিটওয়েতে এমন কিছু হয়নি, পুরো সিটওয়ে বন্দরই আইপিজিএলের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। সিটওয়ে বন্দর এব কাইউকপিউ বন্দরের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ৬৫ নটিক্যাল মাইল। সুরা চীন কাইউকপিউকে নৌঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে গেলে তার কাউন্টারও ভারতের কাছে রয়েছে।
আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও সিটওয়ে বন্দর ভারত মহাসাগরে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে স্ট্রাটেজিক সুবিধা দেবে। অর্থাৎ কালাদান মাল্টিমোডাল প্রজেক্ট উত্তর-পূর্ব ভারতের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পাশাপাশি স্ট্র্যাটেজিক কারনেও গুরুত্বপূর্ন।