পঞ্চমদফা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র আবারও বাংলায়। নির্বাচনী প্রচারে এসে কি জানালেন?
চলতি লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আবারও পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারে এসেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদী। শনিবার সকালে ওড়িশা, ঝাড়খন্ডে ভোটপ্রচার করে শনিবার রাতেই শহর কলকাতায় এসে উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী। নিয়ম অনুযায়ী রাজভবনেই রাতে থাকেন তিনি। আগমাী ২০ মে পঞ্চম দফায় রাজ্যে বনগাঁ, ব্যারাকপুর, হাওড়া, হুগলী, আরামবাগ, উলুবেড়িয়া ও শ্রীরামপুর এই সাতটি লোকসভা কেন্দ্রে ভোটগ্রহন হবে। সেই জন্য প্রধানমন্ত্রী আবারও বাংলায় এসেছিলেন। রবিবার ব্যারাকপুর, হুগলী, আরামবাগ ও হাওড়াতে চারটি জনসভা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বাংলায় তাদের গড় মজবুত করতে বদ্ধপরিকর।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ১৮টি আসনে জয়ী হয়েছিল, এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩৫টি আসনে জেতার লক্ষ্য নিয়েছে। সেই জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বারবার রাজ্যে আসছেন জনসভা করতে। লোকসভা নির্বাচনের দিন ঘোষনার পর থেকে এই নিয়ে নবমবারের জন্য পশ্চিমবঙ্গে এলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রী মোদীর নির্বাচনী প্রচারকে কেন্দ্র করে পুরো শহর জুড়ে বিশেষ নিরাপত্তার আয়োজন করা হয়েছিল। শনিবার ও রবিবার রাজ্যের বিশেষ কয়েকটি এলাকার রাস্তায় যান নিয়ন্ত্রন করে পুলিশ।
রবিবার সকালে রাজভবন থেকে প্রথমেই ব্যারাকপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ব্যারাকপুরের ভাটপাড়ায় বিজেপি প্রার্থী অর্জুন সিং এর সমর্থনে জনসভা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তবে ব্যারাকপুরে সভা শুরু হওয়ার আগেই হঠাৎই রোডশো করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই রোডশো কর্মসূচির জন্য আগে থেকে কোনও প্রস্ততি ছিলনা, তবে প্রধানমন্ত্রীকে সামনে থেকে একবার দেখার জন্য রাস্তার দুধারে রীতিমতো জনপ্লাবন লক্ষ্য করা গেছে। রোডশোর শেষে জনসভা শুরু হয়। বক্তৃতার শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জয়মা দূর্গা জয় মা কালি বলে ব্যারাকপুর বাসীকে অভিনন্দন জানান। তিনি সভায় উপস্থিত মা বোনদেরও সম্মান জানান। এদিন প্রধানমন্ত্রীর জনসভাকে কেন্দ্র করে সাধারন মানুষের ঢল নেমেছিল যা দেখে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন এইবার পশ্চিমবঙ্গে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় আরও ভালো ফল করবে বিজেপি। তিনি জানান পশ্চিমবঙ্গ পূর্ব ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ন রাজ্য। কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী পঞ্চাশ বছর ধরে কংগ্রেসের শাসনে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ দারিদ্র্যতার স্বীকার হয়েছে। তিনি বলেন পশ্চিমবঙ্গ সহ বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খন্ড, অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্য যেখানে কোথাও খনিজ সম্পদ, কয়লার ভান্ডার রয়েছে, কোথাও পর্যটন শিল্পের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে আবার কোথাও বিশাল সামুদ্রিক সীমা, বন্দর এবং ব্লু ইকোনমি রয়েছে অর্থাৎ সামুদ্রিক সম্পদ রয়েই কিন্তু তাসত্বেও কংগ্রেসের ইন্ডি জোট দলগুলো পূর্ব ভারতের উন্নয়নের জন্য দীর্ঘ কয়েক দশক তেমন কোনও কাজই করেনি।
প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন ২০১৪ সালে দেশের জনগন তাকে সেবা করার সুযোগ দিয়েছে। দায়িত্ব পেয়েই তিনি পূর্ব ভারতকে ভারতের গ্রোথ ইঞ্জিন তৈরির সংকল্প নিয়েছেন। বিজেপি সরকারের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সহ পূর্বভারতে রেল নেটওয়ার্ক, সড়কপথ, বিমানবন্দর, জলপথের জাল তৈরি হচ্ছে, পাশাপাশি ডেডিকেটেড ফ্রেড করিডর, গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশও হচ্ছে।
আগামী পাঁচ বছরে পূর্ব ভারতে আরও উন্নয়নের জন্য সাধারন মানুষের কাছে আশীর্বাদ চান তিনি। ব্যারাকপুরের মঞ্চ থেকেই রাজ্যের শাসকদল তৃনমূল কংগ্রেসেরও জোরালো সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তিনি জানান পশ্চিমবঙ্গের মহান ভূমি বিশেষ করে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ব্যারাকপুরের গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা ছিল। একটা সময় বাংলাদেশের অর্থব্যবস্থা মজবুত করতে বাংলার বড় ভূমিকা ছিল সেখানে আজ টিএমসি দূর্নীতির কেন্দ্র তৈরি করেছে, যে পশ্চিমবঙ্গে একটা সময় দেশে মহান বৈজ্ঞানিকদের জন্ম দিয়েছে সেখানে এখন বিম্ব তৈরির শিল্প হচ্ছে। আজ আবারও মঞ্চ থেকে প্রধানমন্ত্রী জানান টিএমসির এমএলএ হিন্দুদের ভাগীরথী জলে ফেলে দেবার হুমকী দিচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুদের দ্বিতীয় শ্রেনীর নাগরিক করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন কংগ্রেস ও ইন্ডি জোট তুষ্টিকরনের রাজনীতি করছে, এসসি, এসটি ও ওবিসিদের সংরক্ষন মুসলিমদের দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে তিনি কর্নাটকের উদাহারন দিয়ে জানান সেখানে ওবিসিদের সংরক্ষন মুসলিমদের দিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। তিনি আরও বলেন ভোটব্যাংকের এই রাজনীতির কারনেই সিএএ এর মতোন মহান জনহিতকর আইনকে রাতারাতি ভিলেন বানিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বিরোধীপক্ষ সিএএ আইনকে ধ্বংস করে মতুয়া ও নমশূদ্র মানুষদের নাগরিকত্বের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে। ব্যারাকপুরের জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গ বাসীর উদ্দেশ্যে পাঁচটি গ্যারান্টি দেনঃ—-
১) ধর্মের ভিত্তিতে সংরক্ষন হবেনা কোনওদিন।
২) এসসি, এসটি এবং ওবিসিদের সংরক্ষন কেউ কেড়ে নিতে পারবেনা।
৩) রামনবমী ও ভগবান শ্রীরামের পূজো করতে কেউ বাধা দিতে পারবেনা।
৪) রাম মন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত কেউ বদলাতে পারবেনা।
৫) সিএএ আইনকে কেউ আটকাতে পারবেনা।
প্রধানমন্ত্রী জানান ব্যারাকপুর পাটশিল্পের কেন্দ্র ছিল একটা সময়। মা গঙ্গার আশীর্বাদে ব্যারাকপুর কৃষিকাজের পাশাপাশি তুলো, কাগজ ও কারিগরি শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল কিংবা বর্তমানে এখানে পাটশিল্পের বেহাল দশা, শ্রমিকদের অবস্থা সম্পর্কে কেউ খোঁজ নেয়না। ভারত সরকার পাটের মূল্য বৃদ্ধি করেছে, শস্য ও চিনি পাটের ব্যাগে রাখা বাধ্যতামূলক করেছে কিন্তু তাসত্বেও ব্যারাকপুরে পাটশিল্পের অবনতি হয়েছে। এই জন্য তিনি বলেন পাটশিল্পের এই ভূমিতে টিএমসি শুধু মিথ্যা কথা বলছে। টিএমসির মতো ভ্রষ্ট দল ভারতের ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায় বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। শাসকদল তৃনমূল কংগ্রেসের দূর্নীতির সমালোচনা করে তিনি বলেন বাংলার মানুষই স্লোগান দিচ্ছে চোর ধরো, জেলে ভরো। তিনি আরও জানান ক্যাগের রিপোর্টে বলা হয়েছে টিএমসি সরকার দুই লাখ ত্রিশ হাজার কোটি টাকার কোনও হিসাবই দেয়নি। রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ দূর্নীতির কথাও উঠে আসে প্রধানমন্ত্রী মোদীর কন্ঠে। তিনি জানান রাজ্য সরকার শিক্ষক নিয়োগের জন্য রীতিমতো দাম ঠিক করে দিয়েছিল, ওএমআর সিট জ্বালিয়ে দেওয়া হয় এবং নকল ইন্টারভিউ নেওয়া হয়। এপ্রসঙ্গে শ্রী নরেন্দ্র মোদী আরও ঘোষনা করেন দূর্নীতির প্রতিটি পয়সার হিসাব নেবেন তিনি এবং এর পেছনে দায়ী কোনও ব্যক্তি ছাড় পাবেনা। মঞ্চ থেকে সন্দেশখালিতে মহিলাদের সাথে হওয়া অত্যাচারের কথা আবারও বলেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তিনি জনগনকে জানান সন্দেশখালি কান্ডে অভিযুক্ত শাহজাহানকে বাঁচানোর জন্য টিএমসির গুন্ডারা সন্দেশখালির মানুষকে ভয় দেখাচ্ছে। এজন্য তিনি সভা থেকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের উদ্দেশ্যে অনুরোধ করেন বাংলাকে এই অপশাসনের হাত থেকে রক্ষা করতে এবারের ভোটে বিজেপিকে জয়ী করতে।
ব্যারাকপুরে সভা শেষে প্রধানমন্ত্রী রওনা হন হুগলির চুঁচুড়ার উদ্দেশ্যে দ্বিতীয় সভার জন্য। হুগলি লোকসভা কেন্দ্রে বঙ্গ বিজেপির দাপুটে নেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায় গত লোকসভা নির্বাচনেও এই আসন থেকে জয়ী হয়েছিলেন। হুগলির জনসভায় একটি বিরল দৃশ্য লক্ষ্য করা গেল। দুই যুবক দুটি ছবি হাতে তুলে ধরে অনেকক্ষন ধরে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছবি দুটি ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে তার মা প্রয়াত হীরাবেন মোদীর। ১২মে আন্তর্জাতিক মাতৃ দিবস উপলক্ষে এমন ছবি উপহার পেয়ে রীতিমতো আপ্লুত হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার কম্যান্ডোদের ছবি দুটি সংগ্রহ করতে নির্দেশ দেন এবং ছবিগুলোর পিছনে ওই দুই যুবকের নাম ঠিকানাও লিখে দিতে বলেন। এরপর তৃতীয় সভার জন্য আরামবাগে যান প্রধানমন্ত্রী। আরামবাগ কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী অরূপকান্তি দিগরের সমর্থনে এই সভা থেকে রাজ্যে কৃষকদের বিরুদ্ধে হওয়া দূর্নীতি নিয়েও শাসকদলের সমালোচনা করেন। তিনি জানান কেন্দ্র সরকার কৃষক সম্মান নিধি দেয় বলে কিছুটা সুবিধা পায় বাংলার কৃষকরা নাহলে তারা আরও বিপদে পড়তো, ভবিষ্যতে রাজ্যের কৃষকদের আরও সুবিধা দেবার আশ্বাস দেন তিনি। আরামবাগের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী জানান বিগত দশ বছরে কেন্দ্রে থাকা বিজেপি সরকার তফসিলি পরিবারের বাচ্চাদের ৩২ হাজার কোটি টাকার বিত্তি দিয়েছে, পাঁচ কোটির বেশী বাচ্চা এই সুবিধা পেয়েছে। আরামবাগে জনসভা শেষ হওয়ার পরেই প্রধানমন্ত্রী চলে যান হাওড়ার সাকরাইলে চতুর্থ সভার জন্য। হুগলির জনসভার মতো সাকরাইলের জনসভাতেও দুজনকে লক্ষ্য করা যায় ছবি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর জন্য দাঁড়িয়ে আছে৷ উন্নতি শর্মা ও বানি শর্মা নামে দুই বোন প্রধানমন্ত্রীর বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি নিয়ে দাড়িয়ে ছিল। অসংখ্য মানুষের ভিড়েও ওই দুই কিশোরী পড়ুয়া দৃষ্টি এড়ায়নি প্রধানমন্ত্রীর। তিনি ওই দুই কিশোরীকে বলেন সভাশেষে তার দল ওই ছবিগুলো সংগ্রহ করে নেবে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এই কথা শুনে দুই বোন আবেগে কেঁদে ফেলেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে তাদের কাঁদতে মানা করেন এবং জানান ছবি তিনি পেয়ে যাবেন। সবমিলিয়ে পঞ্চমদফা ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলায় রীতিমতো সাড়া ফেলে গেলেন।