অফবিট

পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের শরনার্থী সংকট

ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ ও বিবর্তনবাদের জনক চার্লস ডারউইন বলেছেন যোগ্যতমই বেঁচে থাকে। এই তত্ত্ব যেন ভূরাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যে দেশের আভ্যন্তরীন রাজনীতি এবং অর্থনীতি যত বেশী মজবুত, সেই দেশের ভূরাজনীতিতে প্রভাব তত বেশী। যদি কোনও দেশে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার না থাকে তাহলে সেই দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো অল্প সময়েই ভেঙে পড়ে। যার সবচেয়ে ভালো উদাহারন পাকিস্তান ও আফগানিস্তান। 

সম্প্রতি পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে শরনার্থী সংকট তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানের অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান আনওয়ার উল হক কক্কর সমস্ত বিদেশি শরনার্থীদের পাকিস্তান ছাড়বার নির্দেশ দিয়েছে। বলা হচ্ছে পাকিস্তান আফগানিস্তানের তালিবানের জন্য এই নির্দেশ দিয়েছে। কারন পাকিস্তানে বহু আফগান শরনার্থী রয়েছে। তালিবান ক্ষমতায় আসার পর থেকে আফগানিস্তানের অর্থনীতির অবস্থাও খারাপ, এরকম অবস্থায় পাকিস্তানে থাকা সমস্ত আফগানি শরনার্থী আফগানিস্তানে চলে গেলে তালিবানের পক্ষেও এত লোকের ব্যবস্থা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। পাকিস্তান সরকারের নির্দেশের পর থেকে এখনও অবধি ১,৭০,০০০ আফগানি ফিরে গেছে আফগানিস্তানে, তবে এখনও প্রচুর আফগানি রয়েছে পাকিস্তানে। মূলত তালিবানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে পাকিস্তান সমস্ত আফগানি শরনার্থীদের আফগানিস্তানে ফেরত পাঠাচ্ছে। 

আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে শরনার্থী আসা শুরু হয় ১৯৭৮ সাল থেকে। ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে সাউর বিদ্রোহ হয়, এরপরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের সমর্থিত সরকারকে আফগানিস্তানে রক্ষার জন্য সেনা পাঠায়। এইসময় প্রায় ২৫ লাখ আফগানি ইরান ও পাকিস্তানে শরনার্থী হিসাবে চলে আসে। ইরানে প্রায় দশ লাখ এবং পাকিস্তানে প্রায় পনেরো লাখ পাকিস্তানি পালিয়ে আসে দেশ ছেড়ে। দশ বছর আফগানিস্তানে তালিবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর অবশেষে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যায়। তখন পাকিস্তান ও ইরান থেকে অনেক আফগানি আবারও দেশে ফিরে আসে কিন্তু ১৯৯০ এর দশকে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। আবারও বহু আফগানি বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরই মধ্যে তালিবান সমর্থিত আল কায়েদা সংগঠনের নেতা ওসামা বিন লাদেনের আদেশে আল কায়েদা আমেরিকাতে সন্ত্রাসী হামলা চালায় যা ইতিহাসে ৯/১১ নামে কুখ্যাত। এরপরেই আমেরিকা ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সমরিক অভিযান শুরু করে এবং তালিবান সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয়। মজার ব্যাপার হল ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তালিবানকে সহায়তা করেছিল আমেরিকা ও পাকিস্তান, পরে সেই আমেরিকাই তালিবানের বিরুদ্ধে সেনা অভিযান শুরু করে। দেশের এরকম অস্থিতিশীল পরিস্থিতি দেখে বেশীরভাগ আফগান শরনার্থীই দেশে ফিরে আসেনি। পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে মূলত আফগানি শরনার্থীরা আশ্রয় নেয়। পাকিস্তানের কোয়েটা শহরের সাথে তালিবানের সংযোগও ছিল কারন আমেরিকার সেনাবাহিনীর উপর হামলার জন্য তালিবানের শীর্ষস্থানীয় নেতারা কোয়েটা শহরেই বৈঠক করতো। খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের সাথে আফগানিস্তানের সবচেয়ে বেশী ঘনিষ্ঠতা রয়েছে কারন খাইবার পাখতুনখাওয়াতে বসবাস করে মূলত পশতুন জাতির মানুষ। পশতুনদের বহুদিন ধরে একটা দাবী আছে স্বাধীন পশতুনিস্তান তৈরির অথবা আফগানিস্তানের সাথে যুক্ত হয়ে বৃহত্তর আফগানিস্তান গঠন করা। কারন পশতুনদের সংস্কৃতি পাকিস্তানের সিন্ধ ও পাঞ্জাব প্রদেশের মানুষদের থেকে আলাদা, পশতুনদের সংস্কৃতির সাথে সবচেয়ে বেশী মিল রয়েছে আফগানিস্তানের কিন্তু ব্রিটিশদের কারনে ডুরান্ড লাইনের মাধ্যমে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ আলাদা হয়ে গেছে আফগানিস্তান থেকে, এইজন্য তালিবান ডুরান্ড লাইন মানেনা।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে বাংলাদেশ গঠনের পর থেকে পাকিস্তান নিজেও তার খাইবার পাখতুনখাওয়া, বেলুচিস্তান, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর এলকা নিয়ে চিন্তায় থাকে কারন সময়ে সময়ে এইসব প্রদেশে স্বাধীনতার দাবি ওঠে যার কারনে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাঠিয়ে বিদ্রোহ দমন করায়। যদি খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বালুচিস্তান আলাদা হয়ে যায় পাকিস্তান থেকে তাহলে পাকিস্তানের এক তৃতীয়াংশ জায়গা চলে যাবে, বালুচিস্তানে পাকিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন গোয়াদর বন্দরও রয়েছে। এই কারনে পাকিস্তান সবসময় বিদ্রোহ দমানোর চেষ্টা করে সেনাবাহিনী দিয়ে। আফগানিস্তানের কান্দাহার, পাকিস্তানের কোয়েটা, পেশায়োর শহরে পশতুন জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে। তালিবানের চল্লিশ শতাংশ সদস্যই পশতুন, এমনকী তালিবানের নেতৃত্বেও পশতুনদের আধিক্য রয়েছে। খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পশতুনদের জাতীয়তাবাদকে বন্ধ করবার জন্য পাকিস্তান তালিবান সংগঠন তৈরি করে। তালিব কথার অর্থ ছাত্র। পাকিস্তান ভাবে তালিবান তৈরি হলে তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করবে তাহলে পশতুন জাতীয়তাবাদ নিয়ে কোন আন্দোলন হবেনা আর। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান থেকে চলে যাওয়ার পর এবং আফগানিস্তানে আমেরিকার সেনা অভিযানে সবচেয়ে বড় বিপদে পড়ে পাকিস্তান কারন পাকিস্তানের দরকার আমেরিকার অর্থ ও অস্ত্র অন্যদিকে তালিবানের বিরুদ্ধেও সরাসরি যাওয়া অসুবিধা ছিল পাকিস্তানের কারন তাহলে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পশতুনিস্তানের জন্য আন্দোলন শুরু হয়ে যেত। 

২০২১ সালে আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আবারও আফগানিস্তানে তালিবান সরকার ক্ষমতায় আসে। তালিবানের উপর অভিযোগ ছিল তারা আল কায়েদাকে সমর্থন করতো যার কারনে ২০ বছর ধরে আমেরিকা সামরিক অভিযান চালায় আফগানিস্তানে যাতে তালিবানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই এবার আর তালিবান ক্ষমতায় এসে সরাসরি আমেরিকার বিরুদ্ধে যায়নি। তবে আমেরিকার আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান করার সময়ে তালিবান সংগঠনের একাংশ লক্ষ্য করে পাকিস্তান আমেরিকাকে সহায়তা করছে যার কারনে তালিবানের একাংশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করবার জন্য টিটিপি বা তেহরিক ই তালিবান পাকিস্তান গঠন করে। ২০১৪ সালে পেশোয়ারে টিটিপি একটি নৃশংস হত্যাকান্ড চালায়। পেশোয়ারের সেনাবাহিনীর স্কুলে ১৪৯ জনকে হত্যা করে যার টিটিপি এর মধ্যে ১৩২ জনই স্কুলের ছাত্র ছিল। এরপর টিটিপি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন শুরু করে। পাকিস্তানের মূলত তালিবানকে নিয়ে দুটি সমস্যা একটি হচ্ছে টিটিপি এবং আরেকটি হচ্ছে তালিবানের ডুরান্ড লাইন না মানা। 

ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সময় ব্রিটিশ কুটনীতিবিদ মার্টিমার ডুরান্ড ও আফগানিস্তানের শাসক আমীর আবদুর রহমান খান ভারত ও আফগানিস্তানের সীমানা নির্ধারনের জন্য ২,৬৭০ কিলোমিটার লম্বা একটি রেখা অঙ্কন করে যার নাম দেওয়া হয় ডুরান্ড লাইন। তালিবান এই ডুরান্ড লাইন মানেনা। তবে যেহুতু তালিবান আফগানিস্তানে সরকার গঠন করেছে সেজন্য সরাসরি তারা পাকিস্তানের সাথে ঝামেলায় যাচ্ছেনা। তালিবান টিটিপিকে সমর্থন করছে, এই টিটিপি খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমন করছে। ডুরান্ড লাইনে প্রায়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তালিবানের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরকম পরিস্থিতিতে পাকিস্তান ইচ্ছে করেই আফগান শরনার্থীদের আফগানিস্তানে ফেরত পাঠাচ্ছে যাতে তালিবানের উপর চাপ প্রয়োগে টিটিপিকে দমানো যায়। এখন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়া ব্যস্ত আবার ইসরায়েল হামাস যুদ্ধের জন্য আমেরিকাও মধ্যপ্রাচ্যে ব্যস্ত যার কারনে পাকিস্তান ইচ্ছে করেই আফগান শরনার্থীদের এই সময়ে ফেরত পাঠাচ্ছে যাতে আন্তর্জাতিক স্তরে তেমন কোন আলোচনা না হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *