অফবিট

মিশরের মাটি থেকে পুরো যেভাবে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তুলে নিয়ে চলে এসেছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দারা

২৬ ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সালের রাত, ইসরায়েল বায়ুসেনার তিনটি এসএ ৩২১ সুপার ফ্রেলনস হেলিকপ্টার সুয়েজ খালকে অতিক্রম করে মিশরের রাস ঘারিব মরুভূমিতে পৌঁছায়। হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতেই ইসরায়েলের ৩৫ তম প্যারাট্রুপার বিভাগের কম্যান্ডোরা আসন্ন অপারেশনের জন্য প্রস্তত হয়ে যায়। ওই রাতে ইসরায়েল একটি গুরুত্বপূর্ন অপারেশন করতে চলেছিল মিশরে। সেসময় মিশরের সাথে ইসরায়েলের অ্যাট্রিশনের যুদ্ধ চলছিল। ইসরায়েল ও আরবদেশ গুলোর মধ্যে হওয়া ছয়দিনের যুদ্ধের শেষে সিনাই উপত্যকা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রনে চলে আসে যার কারনে ইসরায়েল ও মিশরের সেনাবাহিনী একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, সেসময় মিশরে সুয়েজ খাল সংকটও চলছিলো। ইসরায়েল ও মিশরের যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসময় মিশরকে সহায়তা করছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন মিশরকে মিগ ২১ যুদ্ধবিমান, ১৮ টি বিশেষ অ্যান্টি এয়ারক্রাফট রকেট ডিভিশন, এস ৭৫, এস ১২৫ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম সরবরাহ করেছিল। ইসরায়েল বায়ুসেনার জন্য সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় ছিল মিশরের পি ১২ রেডার সিস্টেম যা সোভিয়েত ইউনিয়ন দিয়েছিল মিশরকে। পি ১২ রেডারের সবচেয়ে বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এটি কম উচ্চতায় ওড়া যুদ্ধবিমানকেও খুঁজে পেতে সক্ষম ছিল। মিশরের রাস ঘারিবে এই রেডার ইনস্টল করেছিল মিশরের সেনাবাহিনী। 

১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের বায়ুসেনা এই রেডারের উপর এয়ার স্ট্রাইক করে যাতে পুরো সিস্টেম ধ্বংস হয়ে যায় কিন্তু কিছুদিন পর ইসরায়েল অবাক হয়ে যায় যে পি ১২ রেডার পুনরায় কাজ করছিলো। আসলে মিশর পি ১২ রেডারের ডামি তৈরি করে রেখেছিল যাতে ইসরায়েলের বায়ুসেনা বুঝতে না পারে। দুই মাস ধরে ব্যাপক অনুসন্ধানের পর ইসরায়েলের সেনাবাহিনী খবর পায় মিশরের রাস ঘারিব মরুভূমিতে পি ১২ রেডার ইনস্টল করে রেখেছে মিশর। এই কারনেই ২৬ ডিসেম্বর রাতে ৩৫ তম প্যারাট্রুপার বিভাগকে মিশরে পাঠায় ইসরায়েল যাদের মিশন ছিল পি ১২ রেডারকে ইসরায়েলে নিয়ে আসা।

২২ ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সালে ইসরায়েল বায়ুসেনার বিশেষ বিমান রাস ঘারিবের উপর দিয়ে যায় উদ্দেশ্য পি ১২ রেডারের সঠিক অবস্থানকে নিশ্চিত করা। ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স বিভাগের দক্ষ অফিসার সার্জেন্ট রামি শালেভকে এই মিশনের জন্য বেছে নেওয়া হয়। রামি শালেভ পরে এক সাক্ষাৎকারে জানায় সে যখন রাস ঘারিব মরুভূমির উপর দিয়ে যাচ্ছিল নীচে দেখে অনেকটা ফাঁকা জায়গায় দুটি তাঁবু ও দুটি রাশিয়ান ট্রাক রয়েছে। পুরো জায়গায় তেমন কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থাই নেই, এমনকী রেডার স্টেশনের নিরাপত্তার জন্য কোন অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গানও ছিলনা, মিশরের কোন সেনাবাহিনীও ছিলনা সেই স্থানে। ওই স্থান থেকে কিছুটা উত্তরে মিশরের সেনাবাহিনীর মর্টার বিভাগ ছিল। প্রায় পরিত্যক্ত তাঁবু দেখে মনে হবে মিশরের সেনাবাহিনীর সাধারন কোন ব্যবস্থা হয়ত কিন্ত বাস্তবে ওখানেই পি ১২ রেডার রাখা ছিল, মিশর এমনভাবে রেখেছিল যাতে কোন সন্দেহ না হয়, তবে সার্জেন্ট রামি শালেভ এড়িয়ে যায়নি, তার মনে হয় হয়ত এখানেই রেডার আছে। কারন এর আগে যে স্থানে রেডারের ডামির উপর ইসরায়েলের বায়ুসেনা এয়ার স্ট্রাইক করেছিল সেখানে পঞ্চাশের বেশী মিশরীয় সেনা ছিল, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান ছিল। রাস ঘারিব মরুভূমিতে এমন ফাঁকা এলাকায় দুটি তাঁবু দেখে রামি শালেভ কিছুটা নিশ্চিত হয়ে যায়, মিশর ইচ্ছে করেই ইসরায়েলকে বুঝতে না দেওয়ার জন্য এভাবে রেডার স্টেশন অরক্ষিত রেখেছে যাতে কোনও সন্দেহ না হয়। ইসরায়েল বায়ুসেনার বিশেষ বিমান থেকে রাস ঘারিব মরুভূমির এসব ছবি পাঠানো হয় ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স বিভাগ ও ইসরায়েল বায়ুসেনার কার্যকারী প্রধান ডেভিড ইভরিকে পাঠানো হয়। ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স বিভাগ, সেনাবাহিনী ও বায়ুসেনার বৈঠকে প্রথমে ঠিক হয় রাস ঘারিব মরুভূমিতে পি ১২ রেডারের অবস্থানের সঠিক ভৌগোলিক অবস্থান তৈরি করা হবে যাতে বায়ুসেনা এবার পূর্নরূপে রেডার স্টেশন ধ্বংস করতে পারে। কিন্ত ওই বৈঠকে একজন কর্নেল বলে ওঠে বোম্বিং না করে গোপন অভিযানের মাধ্যমে পুরো রেডার সিস্টেমই ইসরায়েলে নিয়ে আসতে। এই পরিকল্পনায় অনেকেই সম্মতি দেয়। কিন্তু রাস ঘারিব মরুভূমিতে মিশরের সেনাবাহিনীর সামনে থেকে দুটি ভারী ট্রাকযুক্ত পি ১২ রেডার সিস্টেম সুয়েজ খাল অতিক্রম করে ইসরায়েলে নিয়ে আসাটা ছিল সবচেয়ে ঝুকিপূর্ন কাজ, একটি ভুলে পুরো মিশন নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। তবে দেশটার নাম যখন ইসরায়েল তখন বোধহয় কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। 

ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স বিভাগ, সেনাবাহিনী এমন সব অভিযান করেছে যার কারনে ইসরায়েলের ইনটেলিজেন্স বিভাগকে পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় ইনটেলিজেন্স সংস্থা গুলোর মধ্যে একটি বলা হয়। তৎকালীন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি পি ১২ রেডার যুদ্ধক্ষেত্রে রীতিমতো কার্যকরী ছিল। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে পি ১২ রেডার তৈরি করে সোভিয়েত ইউনিয়নের এসকেবি ডিজাইন ব্যুরো। সমস্ত পরীক্ষার পর ১৯৫৮ সালে পি ১২ রেডার পুরোপুরি সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়। প্রাথমিক ভাবে এই রেডারের রেঞ্জ ২০০ কিলোমিটার। তবে বেলগ্রেডে অবস্থিত মিলিটরি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে এই রেডারকে আপগ্রেড করে এর রেঞ্জ ৩৫০ কিলোমিটার করা হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক লড়াইয়ে পি ১২ তার সক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল। এই কারনে ইসরায়েল যেভাবেই হোক এই পি ১২ রেডার মিশরকে ব্যবহার করা থেকে বন্ধ করতে চেষ্টা করছিলো। পি ১২ রেডারকে রাস ঘারিব থেকে আনবার জন্য ইসরায়েল সেনাবাহিনী হেলিকপ্টার ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় কারন সেসময় ইসরায়েলের কাছে আমেরিকার তৈরি নতুন সিকরস্কি হেলিকপ্টার ছিল। ইসরায়েল বায়ুসেনার কমান্ডার মোতি হোড এই অপারেশনের তথ্য চীফ অফ ডিফেন্স স্টাফ হেম বার লেভকে দেয়। হেম বার লেভ অপারেশনের সবুজ সংকেত দিয়ে দেয়। মিশরে ইসরায়েলের এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন রুস্টার ৫৩. এই অপারেশনের জন্য ইসরায়েলের ৩৫ তম প্যারাট্রুপারদের একটি দল ২৪ ঘন্টা ধরে ডামি রেডার ও ট্রাককে এয়ার লিফট সহ পুরো অপারেশনের প্রশিক্ষন করে। 

ইসরায়েলি প্যারাট্রুপাররা প্রশিক্ষনের জন্য ডামি রেডার হিসাবে একটি রাশিয়ান রেডার ব্যবহার করে, এই রেডার ইসরায়েল ছয় দিনের যুদ্ধে আরব দেশগুলোর থেকে বাজেয়াপ্ত করেছিলো। ২৬ ডিসেম্বর রাত নয়টার সময় অপারেশন রুস্টর ৫৩ শুরু করা হয়। প্রথমে ইসরায়েল বায়ুসেনার কিছু এ৪ স্কাই হকস এবং এফ ৪ ফ্যান্টম যুদ্ধবিমান লোহিত সাগর ও সুয়েজ খালের পশ্চিম তীরে মিশরের সেনাবাহিনীর উপর আক্রমন শুরু করে। ইসরায়েল মিশরের সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখতে এই এয়ার স্ট্রাইক শুরু করে যাতে অপারেশন রুস্টার ৫৩ এর ব্যাপারে সন্দেহ না হয় মিশরের। এই সুযোগে তিনটি এসএ ৩২১ সুপার ফ্রেলনস হেলিকপ্টার রওনা হয় মিশরের উদ্দেশ্যে যাতে ইসরায়েলের ৩৫ তম প্যারাট্রুপার কম্যান্ডো বিভাগের ৬০ জন কম্যান্ডো ছিল। এই দলের প্রধান ছিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল এরি সিডন। রাস ঘারিবে নির্দিষ্ট জায়গায় ল্যান্ড করার পর রেডার স্টেশন ঘিরে ফেলে ইসরায়েলি প্যারাট্রুপাররা। সেসময় স্টেশন খুব কম সংখ্যক মিশরীয় সেনা ছিল। দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধে খানিকক্ষনের মধ্যে দুজন মিশরীয় সেনা মারা যায়, চারজন গ্রেফতার হয় এবং তিনজন পালিয়ে যায়, পুরো রেডার স্টেশন ইসরায়েল প্যারট্রুপারদের দখলে চলে যায়। এরপর দুটি সিএইচ ৫৩ হেলিকপ্টার এসে পৌঁছায় রেডার স্টেশনে। একটি হেলিকপ্টার ট্রাক ও অ্যান্টেনা এবং আরেকটি হেলিকপ্টার রেডার বহন করে সুয়েজ খাল অতিক্রম করে ইসরায়েল নিয়ে আসে। পি ১২ রেডারের ওজন ছিল প্রায় চার টন এবং ট্রাক সহ অ্যান্টেনার ওজন ছিল ২.২ টন। রেডার বহনকারী সিএইচ ৫৩ হেলিকপ্টার ইসরায়েলে ফিরে আসতে যথেষ্ট সমস্যায় পড়েছিল কারন সিএইচ ৫৩ হেলিকপ্টার সর্বোচ্চ ৩ টন ওজন বহন করতে সক্ষম ছিল কিন্ত রেডারের ওজন ছিল ৪.১ টন। 

সুতরাং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিক ওজন বহন করতে গিয়ে হেলিকপ্টারের উড়তে সমস্যা হচ্ছিল কিন্তু পাইলটের দক্ষতায় শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলে ফিরে আসে হেলিকপ্টারটি। অপর হেলিকপ্টারটি অবশ্য খুব সহজেই ইসরায়েলে ফিরে আসে। মিশন সম্পন্ন হওয়ার পর, তিনটি সুপার ফ্রেলনস হেলিকপ্টারও প্যারাট্রুপারদের নিয়ে ইসরায়েলে ফিরে আসে। মিশর বুঝতেও পারেনি ইসরায়েলি প্যারাট্রুপাররা তাদের দেশে এসেই তাদের অন্যতম শক্তিশালী অস্ত্রকে নিয়ে চলে গেছে। পি ১২ রেডার সিস্টেম পুরো পরীক্ষা করে ইসরায়েল এবং তারপর এর সম্পূর্ন তথ্য আমেরিকাকেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অপারেশন রুস্টার ৫৩ এর সাফল্য আরও একবার ইসরায়েলের দক্ষতা বিশ্বের সামনে প্রমান করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *